সত্যজিৎ রায়ের নিষিদ্ধ ছবি-সিকিম by জাহিদুর রহিম অঞ্জন

সত্যজিৎ রায় সিকিম ছবিটি নির্মাণের পর প্রায় ৪০ বছর এটি ভারতে নিষিদ্ধ ছিল। আর চোগিয়াল রাজপ্রাসাদের বাইরে সিকিমেও ছবিটি কখনো প্রদর্শিত হয়নি। ফলে সিকিম নিয়ে অনেক গল্পগাছা চালু ছিল। সত্যজিৎ রায় অনেকগুলো প্রামাণ্য ছবি বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। ইলোরার নৃত্যশিল্পী, রাজস্থানের লোকসংগীত ইত্যাদি।


এ তালিকায় সিকিমও ছিল। ১৯৭১ সালে যখন রায় এ ছবি নির্মাণ করেন, তখন সিকিম হিমালয়ের একমাত্র ‘প্রিন্সলি এস্টেট’ হিসেবে নামগিয়াল চোগিয়াল রাজত্ব করছেন। সত্যজিৎ রায়ের এক জ্ঞাতি ভাইয়ের মাধ্যমে রাজা নামগিয়াল ও তাঁর আমেরিকান স্ত্রী হোপ কুকের সঙ্গে রায়ের পরিচয় হয় এবং সেই সুবাদে সিকিম ছবির কাজ শুরু।
ছবি শেষ হওয়ার পর ভারতের কোথাও এর প্রদর্শনী হয়নি। এবং ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত হলে সিকিম ছবিটি ভারত সরকার নিষিদ্ধ করে এবং ছবির সব কপি ধ্বংস করা হয়।
অনেক দিন পর্যন্ত ধারণা ছিল, সিকিম ছবিটির কোথাও কোনো প্রিন্ট নেই। ২০০৩ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম একাডেমির আর্কাইভসে একটা পুরোনো ৫২ মিনিটের কপি পাওয়া যায়, যার অনেক জায়গায় রং জ্বলে গেছে। শোনা যায়, রায়ের মূল কপি ৬০ মিনিটের ছিল। সেখান থেকে কিছু দৃশ্য চোগিয়াল রাজপরিবার বাদ দিয়ে দেয়। বিশেষ করে, রাজপ্রাসাদের ভোজের উচ্ছিষ্ট অংশ যখন সাধারণ মানুষ খাচ্ছে—এমন দৃশ্য। ২০১০ সালে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি এবং স্বাভাবিকভাবেই সিকিম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এটা হচ্ছে মোটামুটি সিকিম ছবির পশ্চাৎপট।
সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য প্রামাণ্য ছবির মতোই সিকিম সরলরৈখিক দৃশ্যাবলি এবং ধারাবর্ণনার ভেতর দিয়ে সিকিম সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা তুলে ধরেছে। আধুনিক নগর-সভ্যতার বাইরে হিমালয়ের পাদদেশে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে সিকিম প্রকৃত সৌন্দর্যে ভরপুর। পরিশ্রমী সরল মানুষ, হাসিমাখা সুখী মুখ—অন্যান্য পাহাড়ি দেশের মানুষের মতোই। এটাই সম্ভবত সত্যজিৎ রায়ের ছবির মূল সুর।
দেখুন, রায় নিজে কী বলছেন, ‘যখন তারা (দুটি কেবল কার) একটা জায়গাতে পৌঁছাল, আমি দৃশ্যটি টেলিগ্রাফের তারের শটের সঙ্গে কাট করলাম। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। তারে জমে থাকা কয়েক ফোঁটা পানি আস্তে আস্তে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে...ছবির প্রথম সাত মিনিট, অনেকটা কবিতার মতো। আর ছবিটি বেশ আশা নিয়ে শেষ হয়েছে। খুবই জীবন্ত কয়েকটা মুহূর্ত—অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে, সুখী, হাসছে, সিগারেট ফুঁকছে, গান গাইছে। পুরো ছবিটা সিকিমের সৌন্দর্য-বন্দনা।’
আর ছবির দ্বিতীয় ভাগে আছে চোগিয়াল রাজপ্রাসাদ আর তাদের পাশ্চাত্য আভিজাত্য, অনুষ্ঠানাদি ও সিকিমিজদের বৌদ্ধধর্ম আচারে নতুন বর্ষবরণের সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠান, মুখোশ নৃত্য ও পান ভোজ।
ছবির এ অংশে রাজকীয় অতিথি ও সাধারণ মানুষের দৃশ্যের মধ্যে ইন্টারকাট এবং ডিটেলের শট রাজার সঙ্গে সাধারণের পার্থক্য খোলা চোখেও ধরা পড়ে, যেন ইতরজনেরা ভাত, শুয়োরের মাংস আর সস্তা পানীয়তেই তুষ্ট। এটুকুই শুধু ছবির অস্বচ্ছন্দের অংশ।
ছবির ক্যামেরা করেছেন সৌভেন্দু রায়। তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁদের খুবই কম সুবিধার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। তাঁর তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য, রোডডেনড্রন আর নাম না-জানা অসংখ্য হিমালয়ের ফুল-গাছ ও সরল-সুখী পাহাড়ি মানুষের মুখ। অনেক সময় হাতে ক্যামেরা নিয়ে সুন্দর প্রবহমান মুহূর্তকে তুলে ধরেছেন, যা আমাদের অনেক দিন স্মরণে থাকবে।
ছবির সংগীত পরিচালক রায় নিজেই। সমবেত কণ্ঠের পাহাড়ি গান কিংবা ছোট কোনো যন্ত্রের মধুর শব্দ মুহূর্তে পাহাড়ের আবহাওয়াকে তুলে এনেছে, ছবি শেষ হওয়ার পরও যার রেশ থেকে যায়। আর দৃশ্যগুলো মনে রেখে যায় দূর কোনো পাহাড়ি রাজ্যে ভ্রমণের স্মৃতির মতো নস্টালজিয়া।

No comments

Powered by Blogger.