আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৬)-সমাজ ক্রমাগত জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে by আলী যাকের
আমি এর আগে লিখেছিলাম, আমাদের তারুণ্যের সময় অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ কখনোই পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে কোনো তারতম্যের সৃষ্টি করত না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমার অত্যন্ত অবস্থাপন্ন বন্ধু যেমন ছিল, তেমন হতদরিদ্র বন্ধুরও অভাব ছিল না। নবু বা নবদ্বীপ ছিল এ রকমই একটি অতিদরিদ্র পরিবারের ছেলে।
ওরা একটি খালি প্লটে বেড়ার ঘর বানিয়ে সেখানেই বাস করত। নবুর বাবা ছিলেন পেশায় একজন ঘরামি অর্থাৎ বাঁশ দিয়ে কাঁচাঘর তৈরি করা অথবা মেরামত করাই ছিল তাঁর কাজ। সে সময় এ রকম ঘরের অভাব ছিল না ঢাকায়। অনেক মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাসায় গরু কিংবা ছাগল পোষা হতো। এসব গৃহপালিত পশুর জন্য বাড়ির পেছনের আঙিনায় একটা গোয়ালঘরের প্রয়োজন পড়ত। নবুর বাবা ওই ঘর বানানোর কাজ করতেন। ওদের বাসায় আমি দিব্যি দুপুরের খাবার খেয়েছি অনেকবার। ডাঁটার চচ্চড়ি, ডাল আর ভাত, মনে হতো যেন অমৃত। এখন এই বয়সে এসে ভাবি, আমাদের কৈশোর-তারুণ্যের ওইসব সম্পর্কই মানুষ সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করেছে। এখনো সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ প্রচুর এবং সেই আগ্রহ থেকেই আমি যেকোনো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণে অনেক বেশি নিরপেক্ষ হতে পারি। সময়ের অগ্রযাত্রায় আমাদের সমাজের ওপর দিয়ে একটা প্রলয়ঙ্করী ঝড় বয়ে গেছে এবং সেই ঝড়ের কারণে যে সমাজ ছিল নানা পেশা অথবা মানুষের দ্বারা পরিচালিত, সেই সমাজটি যেন কেবল ধনী ও দরিদ্র_এই দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আরো একটি বিষয়, যা উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো, আমাদের এই ভূখণ্ডের সর্বত্র একসময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত এবং মূল্যবোধকে রক্ষা করত। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি ক্রমেই নির্জীব, নির্বীর্য হয়ে পড়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সমাজ ক্রমেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এক দল অতি ধনী এবং অন্য দল ক্রমাগত চেষ্টা করা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিমজ্জিত। এই দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে স্বভাবতই কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ আছে, যারা প্রাচুর্যের প্রতি ক্রমবর্ধমান লোভের কারণে নানা রকম অনভিপ্রেত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে গা ভাসিয়ে দেয়, যাতে সমাজের মধ্যে দুর্নীতি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আজকের বাংলাদেশের সমাজ ক্রমাগতই উদ্দেশ্যহীন, প্রাচুর্যলোভী, অশিক্ষিত ও ভারসাম্যহীন জরাগ্রস্ত সমাজে পরিণত হচ্ছে।
বন্ধুবর ইমরুল চৌধুরী একসময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি এবং বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক। কিছুদিন ধরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি আমাদের ঢাকার প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান 'বিউটি বোর্ডিং'-এর সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে প্রায়ই বাংলাবাজার রোডে বিউটি বোর্ডিংয়ে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এই বিউটি বোর্ডিং একটি অতি পুরনো চায়ের রেস্তোরাঁ, যেখানে বাংলাদেশের তাবৎ বিদগ্ধ মানুষ একসময় আড্ডা দেওয়ার জন্য জড়ো হতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী ও খালেদ চৌধুরী। এই শীর্ষস্থানীয়রা ছাড়াও থাকতেন ইমরুল চৌধুরী এবং তাঁর সমবয়সী কবি-সাহিত্যিকরা।
আমাদের দেশটি এমনই হতভাগা যে এ ধরনের হাতেগোনা যায় এমন কয়েকটি জায়গাকেও আমরা স্মরণীয় করে রাখতে পারছি না। অথচ কলকাতার কফি হাউসকে ঘিরে নিত্যই কত লেখালেখি, এমনকি অতি জনপ্রিয় গানও রচিত হয়ে যায়। ইমরুল এবং বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে আমার সেই গেণ্ডারিয়াপাড়ায়। এ পাড়ার ইস্ট এন্ড ক্লাবের আঙিনায় বার দুয়েক বাহারি মেলা বসেছিল পর পর দুই বছর শীতকালে। সেই সময় আমি খুব সম্ভবত স্কুলের শেষ প্রান্তে অথবা কলেজে ঢুকেছি কেবল। এ মেলায় খোপ খোপ করে স্টল তৈরি করা হয়েছিল এবং এসব স্টলে বই, হাতে আঁকা ছবি এবং অন্য কুটিরশিল্প সামগ্রীও প্রদর্শিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমীর বইমেলার অনেক আগেই অতি ক্ষুদ্র আকারের হলেও এ আয়োজন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় ইমরুলের নিজস্ব উদ্যোগে হ-য-ব-র-ল নামে একটি দেয়াল পত্রিকা টাঙানো হয় ইস্ট এন্ড ক্লাবের আঙিনার বাইরে। এই পত্রিকাটি ইমরুল তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে নিজেই লিখতেন এবং নানাজনের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা হতো এই পত্রিকার জন্য। প্রতিদিন বিকেলে পাড়ার অনেক আগ্রহী পাঠক ওই পত্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে সেই লেখা পাঠ করতেন। ইমরুলের অনুপ্রেরণায় আমি তখনকার দৈনিক আজাদ পত্রিকার মুকুলের মহফিলের অফিসে যাই। আমার বোন ঝুনু অবশ্য এরই মধ্যে মুকুলের মহফিলে লেখালেখি শুরু করে দিয়েছে। ওর গদ্য অত্যন্ত উঁচুমানের ছিল। বস্তুতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে ঝুনুর আগ্রহই আমাকে লেখালেখির দিকে আগ্রহী করে তুলেছিল। ইমরুলের সঙ্গে মুকুলের মহফিলে গিয়ে পরিচয় হলো অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে। নিয়ামত হোসেন, হেদায়েত হুসাইন মোরশেদ, মাসুদ আহ্মেদ, আরো কত নাম ভিড় করে আসে মনে। তবে সবার মধ্যমণি হয়েছিল সে সময়কার মুকুলের মহফিলের পাতার বাগবান কবি হাবিবুর রহমান। হাবিব ভাইয়ের সদা হাসিমাখা মুখটি আমি কোনোকালেই ভুলব না। আমার ইচ্ছে অসীম হলেও লেখালেখিতে হাত তখনো খোলেনি। আমি আজও যেমন বলি আমি আকাশতলের মানুষ, ছাদের তলার নই। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে মুকুলের মহফিলের কাজ সারা প্রদেশে (তখনো পূর্ব পাকিস্তান) ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য 'মুকুল মেলা' শিরোনামে একটা মাঠপর্যায়ের সংগঠন গড়ে তোলা হবে। ওই সংগঠনের শাখা-প্রশাখা থাকবে সর্বত্র। তবে শুরু হবে ঢাকা দিয়েই। তখন গেণ্ডারিয়ায় জন্ম হলো প্রান্তিক মুকুল মেলার।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
বন্ধুবর ইমরুল চৌধুরী একসময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি এবং বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক। কিছুদিন ধরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি আমাদের ঢাকার প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান 'বিউটি বোর্ডিং'-এর সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে প্রায়ই বাংলাবাজার রোডে বিউটি বোর্ডিংয়ে নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এই বিউটি বোর্ডিং একটি অতি পুরনো চায়ের রেস্তোরাঁ, যেখানে বাংলাদেশের তাবৎ বিদগ্ধ মানুষ একসময় আড্ডা দেওয়ার জন্য জড়ো হতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী ও খালেদ চৌধুরী। এই শীর্ষস্থানীয়রা ছাড়াও থাকতেন ইমরুল চৌধুরী এবং তাঁর সমবয়সী কবি-সাহিত্যিকরা।
আমাদের দেশটি এমনই হতভাগা যে এ ধরনের হাতেগোনা যায় এমন কয়েকটি জায়গাকেও আমরা স্মরণীয় করে রাখতে পারছি না। অথচ কলকাতার কফি হাউসকে ঘিরে নিত্যই কত লেখালেখি, এমনকি অতি জনপ্রিয় গানও রচিত হয়ে যায়। ইমরুল এবং বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে আমার সেই গেণ্ডারিয়াপাড়ায়। এ পাড়ার ইস্ট এন্ড ক্লাবের আঙিনায় বার দুয়েক বাহারি মেলা বসেছিল পর পর দুই বছর শীতকালে। সেই সময় আমি খুব সম্ভবত স্কুলের শেষ প্রান্তে অথবা কলেজে ঢুকেছি কেবল। এ মেলায় খোপ খোপ করে স্টল তৈরি করা হয়েছিল এবং এসব স্টলে বই, হাতে আঁকা ছবি এবং অন্য কুটিরশিল্প সামগ্রীও প্রদর্শিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমীর বইমেলার অনেক আগেই অতি ক্ষুদ্র আকারের হলেও এ আয়োজন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় ইমরুলের নিজস্ব উদ্যোগে হ-য-ব-র-ল নামে একটি দেয়াল পত্রিকা টাঙানো হয় ইস্ট এন্ড ক্লাবের আঙিনার বাইরে। এই পত্রিকাটি ইমরুল তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে নিজেই লিখতেন এবং নানাজনের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা হতো এই পত্রিকার জন্য। প্রতিদিন বিকেলে পাড়ার অনেক আগ্রহী পাঠক ওই পত্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে আগ্রহভরে সেই লেখা পাঠ করতেন। ইমরুলের অনুপ্রেরণায় আমি তখনকার দৈনিক আজাদ পত্রিকার মুকুলের মহফিলের অফিসে যাই। আমার বোন ঝুনু অবশ্য এরই মধ্যে মুকুলের মহফিলে লেখালেখি শুরু করে দিয়েছে। ওর গদ্য অত্যন্ত উঁচুমানের ছিল। বস্তুতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে ঝুনুর আগ্রহই আমাকে লেখালেখির দিকে আগ্রহী করে তুলেছিল। ইমরুলের সঙ্গে মুকুলের মহফিলে গিয়ে পরিচয় হলো অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে। নিয়ামত হোসেন, হেদায়েত হুসাইন মোরশেদ, মাসুদ আহ্মেদ, আরো কত নাম ভিড় করে আসে মনে। তবে সবার মধ্যমণি হয়েছিল সে সময়কার মুকুলের মহফিলের পাতার বাগবান কবি হাবিবুর রহমান। হাবিব ভাইয়ের সদা হাসিমাখা মুখটি আমি কোনোকালেই ভুলব না। আমার ইচ্ছে অসীম হলেও লেখালেখিতে হাত তখনো খোলেনি। আমি আজও যেমন বলি আমি আকাশতলের মানুষ, ছাদের তলার নই। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে মুকুলের মহফিলের কাজ সারা প্রদেশে (তখনো পূর্ব পাকিস্তান) ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য 'মুকুল মেলা' শিরোনামে একটা মাঠপর্যায়ের সংগঠন গড়ে তোলা হবে। ওই সংগঠনের শাখা-প্রশাখা থাকবে সর্বত্র। তবে শুরু হবে ঢাকা দিয়েই। তখন গেণ্ডারিয়ায় জন্ম হলো প্রান্তিক মুকুল মেলার।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments