সপ্তাহের হালচাল-প্রধান উপদেষ্টা: দুটি বিকল্প প্রস্তাব by আব্দুল কাইয়ুম
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আদালতের সম্পৃক্ততা থাকলে সেখানে দলীয়করণের প্রবণতা দেখা যায়। তাই আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষায় এ দুটিকে বিযুক্ত করার একটি কথা উঠেছে। এত দিন ভালোই চলছিল। ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি’ প্রধান উপদেষ্টা হয়ে আসছিলেন।
কিন্তু বিগত বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা হঠাৎ ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করায় প্রশ্ন দেখা দেয়। বিএনপি তাদের দলের সমর্থক (?) একজন বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি জটিল হলো। জরুরি আইন জারি ও ‘সেনা সমর্থিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম হলো।
কিন্তু এত কিছুর পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, উঠেছে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে। কারণ, দলের সমর্থক বলে বিবেচিত বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা সব সরকারই করতে চায়। সে জন্য সবাই বলছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে উপদেষ্টা নিয়োগের বিধানটি বদলানো দরকার।
১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবার আস্থা অর্জন করেছিল। তখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অনন্যসাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যদিও নির্বাচনে পরাজিত দল ও জোট তা স্বীকার করে না। প্রশ্ন উঠেছে ২০০৬ সালে গঠিত ও স্বল্প সময়েই পরিবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হয়, সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে। সুতরাং গলদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নয়, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপদ্ধতিতে।
আদালতে অ্যামিকাস কিউরিদের (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) প্রায় সবাই একবাক্যে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতেই হবে, এটি না হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে। এমনকি যাঁরা আগে বলতেন এ ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক, সংবিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, বিশ্বে নজির নেই ইত্যাদি, তাঁরাও বলছেন, এটা না হলে চলবে না। বিএনপি এ ব্যবস্থার ঘোরবিরোধী ছিল। এখন বলছে, এটা বাতিল করলে তারা মানবে না! এর একটি কারণ এই হতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে মহাজোট অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং তাতে বিএনপির নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই-ই চাই!
খুব ভালো কথা। তার মানে হলো, দলীয় সরকারের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা এখনো কেউ ভাবতে পারছেন না, যদিও নির্বাচন কমিশন এখন অনেক স্বাধীন। বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা ও ভোটার আইডি কার্ড হয়ে গেছে। এমনকি বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনেও উপনির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা প্রভৃতি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু তার পরও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
১৯৯৮ সালে এক অনুষ্ঠানে ইউএনডিপির ঢাকার আবাসিক সমন্বয়কারী ইয়র্গান লিজনারের সঙ্গে দেখা হলে রাজনৈতিক বিষয় আলোচনায় আসে। লিজনার বিস্ময়কর দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে তাদের দুটি নতুন আবিষ্কার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করবে। একটি হলো খাওয়ার স্যালাইন আর অপরটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা। প্রথমটি ইতিমধ্যে বিশ্ব লুফে নিয়েছে। দ্বিতীয়টি হয়তো বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। লিজনার অবসরে গেছেন। জানি না এখন তিনি কী ভাবছেন।
লিজনার বা আজকের উচ্চ আদালতে বড় বড় ব্যারিস্টার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে অবিচল অবস্থান নিয়েছেন। তার প্রধান কারণ হলো, এ ব্যবস্থাটি কোনো ব্যক্তিবিশেষের মাথা থেকে আসেনি, এটা এসেছে রাজপথে গণমানুষের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে এরশাদের বিরুদ্ধে দুই জোট অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। এর প্রথম দফাটি ছিল এরশাদের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। পরে অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে এটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিগত কয়েক মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকার অভিজ্ঞতায় এখন কিছু সংশোধনীর কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো মত না দিয়ে বলেন, ‘আমি “শত ফুল ফুটতে দাও” নীতিতে বিশ্বাস করি। সবার মতামত জানতে চাই।’ তিনি বলেন, বিরোধী দলের সদস্যদের কমিটির সভায় আসা দরকার, তাঁরা তাঁদের মতামত তুলে না ধরলে কোনো সংশোধনী আনা কঠিন হবে। তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় যেকোনো পরিবর্তন, সেটা যত ভালোর জন্যই করা হোক না কেন, যদি অন্তত বিএনপির সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে করা না হয়, তাহলে কোনো কাজে লাগবে না। সুতরাং প্রথম কাজ হলো মূল রাজনৈতিক দলগুলোকে বসে মতৈক্যে আসা।
কিন্তু মতটা কী হবে? প্রধান বিচারপতির বদলে অন্য কাউকে কি পাওয়া যাবে, যিনি সবার আস্থাভাজন হবেন? অনেকে নানা ফর্মুলা দিচ্ছেন। কোনোটিই ফেলে দেওয়া যায় না। ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলমের মতামত জানতে চাইলে তিনি সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি ‘সার্চ’ কমিটি গঠনের কথা বলেন, যাঁরা প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনিও এ রকম প্রস্তাব করেন। তাঁরা এ রকম মতও দেন, সাবেক তিনজন প্রধান বিচারপতি সমন্বিতভাবে একজন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করতে পারেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিন্তাও অনেকটা এ রকম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কায়কোবাদ এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নামের অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা দেবে, তাদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তির নাম দুই তালিকায়ই থাকবে, তিনিই হবেন প্রধান উপদেষ্টা। এ রকম নানা চিন্তা আসছে।
আমরা কি একটি সহজ উপায়ের কথা চিন্তা করতে পারি না? অন্তত দুটি বিকল্প নিয়ে ভাবতে পারি। প্রথমটি এ রকম: প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কখনো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা যাবে না এবং বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রভাবিত করার কোনো কলাকৌশল, অবসরের বয়স পরিবর্তন প্রভৃতি করা যাবে না—এ রকম একটি বিধান যদি করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থেকে আদালতও বাঁচবে, আর প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপ্রক্রিয়াটিও রক্ষা পাবে। এ চিন্তাটি ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলমের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে এসেছে। কিছু আপত্তি সত্ত্বেও তিনি এটা সমর্থন করেন।
তবে ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, প্রধান বিচারপতিকে প্রশাসনিক কাজেও দক্ষ হতে হয়। তাই জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করা হলে হয়তো উচ্চ আদালত অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা ঠিক। কিন্তু এটাও ঠিক, সাধারণত জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনও আদালত সমর্থন করেন না। ১৯৭৭ সালে ভারতে বিচারপতি খান্না রাজনৈতিক কারণে অতিক্রান্ত হলে তিনি পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে সাধারণত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয় না। এ ব্যাপারে ভারতীয় আদালতের একটি রায়ও আছে।
আদালত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও সার্বিক বিবেচনায় গণতন্ত্রের কথা মনে রেখে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করে কি একটি সংশোধনী গ্রহণ করা যায় না? অনেকেই আপত্তি করবেন। কারণ এ ধরনের বাঁধাধরা আইন করা নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি নিজে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত জ্যেষ্ঠতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এটাই কনভেনশন (প্রচলিত রীতি)। সুতরাং জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করা হলে সেটা খুব একটা রীতিবহির্ভূত হবে না।
এখানে কথা উঠবে, বিচারপতি নিয়োগে এত দিন যে রাজনৈতিক পক্ষপাত করা হয়েছে, তাতে এখন জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করলে তো দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘নির্দলীয়’ হবে কি? হ্যাঁ, এই সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, একজন ব্যক্তি যখন কোনো উচ্চপদে বসেন, তখন তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসে। পদ তাঁকে নতুন অবস্থানে নিয়ে যায়। সুতরাং কোন বিচারপতিকে কোন সরকারের আমলে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সেসব বিবেচনা প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। কারণ দায়িত্বশীল পদ ব্যক্তির ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনে, এটা প্রকৃতিরই নিয়ম।
তার পরও বলব, এ ব্যবস্থায় যদি খুব আপত্তি ওঠে, তাহলে দ্বিতীয় একটি বিকল্প আছে। প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে আমরা সংশোধনী এনে বলতে পারি, ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি’ হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন কি না, সেটা বিবেচনায় আনা হবে না। রাজনৈতিক কারণে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি যোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা না-ও হয়ে থাকে, প্রধান উপদেষ্টা হতে তাঁর বাধা থাকবে না। এ দুটি বিকল্প নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।
তবে শুধু প্রধান উপদেষ্টা নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সংবিধানের ২ক পরিচ্ছেদের ৫৮খ থেকে ৫৮ঙ পর্যন্ত অনুচ্ছেদগুলোর বেশ কয়েকটিতে সংশোধনী দরকার। সেসব বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, সুপারিশ আসছে। বিশেষভাবে একটি বিধান করা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের বেশি থাকতে পারবে না, তবে যুদ্ধাবস্থা বা ওই ধরনের পরিস্থিতিতে আরও ৯০ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। আরেকটি, এক-এগারোর আবির্ভাব রোধে এটা দরকার। দ্বিতীয়ত, দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতির কাছে যে কয়েকটি বিষয়ে নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণের বিধান রয়েছে, তা সংসদীয় সরকারব্যবস্থার প্রচলিত বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদকালে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদেও একই বিধান বলবত রাখা হোক, যেখানে ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হবে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ দ্বারা।
এ কয়েকটি সংশোধনী আনা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রধান সমস্যাগুলো দূর হবে, আবার বিচার বিভাগও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার হাত থেকে রেহাই পাবে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্পের কথা ভাবা যায় না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
কিন্তু এত কিছুর পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, উঠেছে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে। কারণ, দলের সমর্থক বলে বিবেচিত বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা সব সরকারই করতে চায়। সে জন্য সবাই বলছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে উপদেষ্টা নিয়োগের বিধানটি বদলানো দরকার।
১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবার আস্থা অর্জন করেছিল। তখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অনন্যসাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যদিও নির্বাচনে পরাজিত দল ও জোট তা স্বীকার করে না। প্রশ্ন উঠেছে ২০০৬ সালে গঠিত ও স্বল্প সময়েই পরিবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হয়, সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে। সুতরাং গলদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নয়, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপদ্ধতিতে।
আদালতে অ্যামিকাস কিউরিদের (আদালতের আইনি সহায়তাকারী) প্রায় সবাই একবাক্যে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতেই হবে, এটি না হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে। এমনকি যাঁরা আগে বলতেন এ ব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক, সংবিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, বিশ্বে নজির নেই ইত্যাদি, তাঁরাও বলছেন, এটা না হলে চলবে না। বিএনপি এ ব্যবস্থার ঘোরবিরোধী ছিল। এখন বলছে, এটা বাতিল করলে তারা মানবে না! এর একটি কারণ এই হতে পারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না থাকলে মহাজোট অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং তাতে বিএনপির নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই-ই চাই!
খুব ভালো কথা। তার মানে হলো, দলীয় সরকারের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা এখনো কেউ ভাবতে পারছেন না, যদিও নির্বাচন কমিশন এখন অনেক স্বাধীন। বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা ও ভোটার আইডি কার্ড হয়ে গেছে। এমনকি বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনেও উপনির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা প্রভৃতি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু তার পরও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
১৯৯৮ সালে এক অনুষ্ঠানে ইউএনডিপির ঢাকার আবাসিক সমন্বয়কারী ইয়র্গান লিজনারের সঙ্গে দেখা হলে রাজনৈতিক বিষয় আলোচনায় আসে। লিজনার বিস্ময়কর দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে তাদের দুটি নতুন আবিষ্কার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করবে। একটি হলো খাওয়ার স্যালাইন আর অপরটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা। প্রথমটি ইতিমধ্যে বিশ্ব লুফে নিয়েছে। দ্বিতীয়টি হয়তো বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। লিজনার অবসরে গেছেন। জানি না এখন তিনি কী ভাবছেন।
লিজনার বা আজকের উচ্চ আদালতে বড় বড় ব্যারিস্টার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে অবিচল অবস্থান নিয়েছেন। তার প্রধান কারণ হলো, এ ব্যবস্থাটি কোনো ব্যক্তিবিশেষের মাথা থেকে আসেনি, এটা এসেছে রাজপথে গণমানুষের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে এরশাদের বিরুদ্ধে দুই জোট অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। এর প্রথম দফাটি ছিল এরশাদের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। পরে অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে এটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিগত কয়েক মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকার অভিজ্ঞতায় এখন কিছু সংশোধনীর কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো মত না দিয়ে বলেন, ‘আমি “শত ফুল ফুটতে দাও” নীতিতে বিশ্বাস করি। সবার মতামত জানতে চাই।’ তিনি বলেন, বিরোধী দলের সদস্যদের কমিটির সভায় আসা দরকার, তাঁরা তাঁদের মতামত তুলে না ধরলে কোনো সংশোধনী আনা কঠিন হবে। তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় যেকোনো পরিবর্তন, সেটা যত ভালোর জন্যই করা হোক না কেন, যদি অন্তত বিএনপির সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে করা না হয়, তাহলে কোনো কাজে লাগবে না। সুতরাং প্রথম কাজ হলো মূল রাজনৈতিক দলগুলোকে বসে মতৈক্যে আসা।
কিন্তু মতটা কী হবে? প্রধান বিচারপতির বদলে অন্য কাউকে কি পাওয়া যাবে, যিনি সবার আস্থাভাজন হবেন? অনেকে নানা ফর্মুলা দিচ্ছেন। কোনোটিই ফেলে দেওয়া যায় না। ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলমের মতামত জানতে চাইলে তিনি সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি ‘সার্চ’ কমিটি গঠনের কথা বলেন, যাঁরা প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনিও এ রকম প্রস্তাব করেন। তাঁরা এ রকম মতও দেন, সাবেক তিনজন প্রধান বিচারপতি সমন্বিতভাবে একজন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন করতে পারেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিন্তাও অনেকটা এ রকম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কায়কোবাদ এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নামের অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা দেবে, তাদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তির নাম দুই তালিকায়ই থাকবে, তিনিই হবেন প্রধান উপদেষ্টা। এ রকম নানা চিন্তা আসছে।
আমরা কি একটি সহজ উপায়ের কথা চিন্তা করতে পারি না? অন্তত দুটি বিকল্প নিয়ে ভাবতে পারি। প্রথমটি এ রকম: প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কখনো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা যাবে না এবং বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রভাবিত করার কোনো কলাকৌশল, অবসরের বয়স পরিবর্তন প্রভৃতি করা যাবে না—এ রকম একটি বিধান যদি করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থেকে আদালতও বাঁচবে, আর প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপ্রক্রিয়াটিও রক্ষা পাবে। এ চিন্তাটি ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলমের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে এসেছে। কিছু আপত্তি সত্ত্বেও তিনি এটা সমর্থন করেন।
তবে ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, প্রধান বিচারপতিকে প্রশাসনিক কাজেও দক্ষ হতে হয়। তাই জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করা হলে হয়তো উচ্চ আদালত অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা ঠিক। কিন্তু এটাও ঠিক, সাধারণত জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনও আদালত সমর্থন করেন না। ১৯৭৭ সালে ভারতে বিচারপতি খান্না রাজনৈতিক কারণে অতিক্রান্ত হলে তিনি পদত্যাগ করেন। এর পর থেকে সাধারণত প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয় না। এ ব্যাপারে ভারতীয় আদালতের একটি রায়ও আছে।
আদালত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও সার্বিক বিবেচনায় গণতন্ত্রের কথা মনে রেখে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করে কি একটি সংশোধনী গ্রহণ করা যায় না? অনেকেই আপত্তি করবেন। কারণ এ ধরনের বাঁধাধরা আইন করা নীতি ও রীতিবিরুদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি নিজে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি সাধারণত জ্যেষ্ঠতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এটাই কনভেনশন (প্রচলিত রীতি)। সুতরাং জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করা হলে সেটা খুব একটা রীতিবহির্ভূত হবে না।
এখানে কথা উঠবে, বিচারপতি নিয়োগে এত দিন যে রাজনৈতিক পক্ষপাত করা হয়েছে, তাতে এখন জ্যেষ্ঠতা অলঙ্ঘনীয় করলে তো দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘নির্দলীয়’ হবে কি? হ্যাঁ, এই সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, একজন ব্যক্তি যখন কোনো উচ্চপদে বসেন, তখন তাঁর চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসে। পদ তাঁকে নতুন অবস্থানে নিয়ে যায়। সুতরাং কোন বিচারপতিকে কোন সরকারের আমলে কেন নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সেসব বিবেচনা প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। কারণ দায়িত্বশীল পদ ব্যক্তির ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনে, এটা প্রকৃতিরই নিয়ম।
তার পরও বলব, এ ব্যবস্থায় যদি খুব আপত্তি ওঠে, তাহলে দ্বিতীয় একটি বিকল্প আছে। প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে আমরা সংশোধনী এনে বলতে পারি, ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারপতি’ হবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন কি না, সেটা বিবেচনায় আনা হবে না। রাজনৈতিক কারণে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে যদি যোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা না-ও হয়ে থাকে, প্রধান উপদেষ্টা হতে তাঁর বাধা থাকবে না। এ দুটি বিকল্প নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।
তবে শুধু প্রধান উপদেষ্টা নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সংবিধানের ২ক পরিচ্ছেদের ৫৮খ থেকে ৫৮ঙ পর্যন্ত অনুচ্ছেদগুলোর বেশ কয়েকটিতে সংশোধনী দরকার। সেসব বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, সুপারিশ আসছে। বিশেষভাবে একটি বিধান করা উচিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের বেশি থাকতে পারবে না, তবে যুদ্ধাবস্থা বা ওই ধরনের পরিস্থিতিতে আরও ৯০ দিন সময় বাড়ানো যেতে পারে। আরেকটি, এক-এগারোর আবির্ভাব রোধে এটা দরকার। দ্বিতীয়ত, দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতির কাছে যে কয়েকটি বিষয়ে নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণের বিধান রয়েছে, তা সংসদীয় সরকারব্যবস্থার প্রচলিত বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদকালে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদেও একই বিধান বলবত রাখা হোক, যেখানে ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হবে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ দ্বারা।
এ কয়েকটি সংশোধনী আনা হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রধান সমস্যাগুলো দূর হবে, আবার বিচার বিভাগও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার হাত থেকে রেহাই পাবে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্পের কথা ভাবা যায় না।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
No comments