এভারেস্ট জয়ের বর্ষপূর্তি-সামর্থ্যটা যদি বোঝাতে পারি by মুসা ইব্রাহীম

এভারেস্টকে জয় করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সেখানে নিজের সামর্থ্যের বাধাকে জয় করতে হয়। কেউ হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন, মানেটা কী? মানেটা হলো, পর্বতারোহণে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি এক ভিন্নরূপে হাজির হয়—সমতলে আমরা একে যেভাবে পাই, পর্বতে তার ঠিক উল্টো।


সেখানে তীব্র তুষারপাত আর শূন্য থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মাঝে বাতাস বয়ে চলে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে। এর সঙ্গে যোগ হয় উচ্চতাজনিত নানান শারীরিক সমস্যা—মস্তিষ্কে আর ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ার কারণে মাথা ও বুকে তীব্র ব্যথা, খাওয়ার অরুচি, ঝিমঝিম ভাব, ঘুম না হওয়া ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা অক্সিজেন-স্বল্পতা। এর কারণে মানুষ সেখানে স্বাভাবিক চিন্তাটাও করতে পারে না। আর এভারেস্টে ২৬ হাজার ফুট উচ্চতা থেকেই শুরু হয় ‘ডেথ জোন’। অর্থাৎ, এ উচ্চতার পর যেকোনো জীবন্ত প্রাণ দ্রুত প্রাণশক্তি হারাতে থাকে অক্সিজেন কম থাকার কারণে। সব মিলিয়ে মনের শক্তি দ্রুতই ক্ষয় হতে থাকে এভারেস্ট অভিযানে। তাই এই অভিযানে মনের দিক থেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী হতে হয়।
এই পুরো পরিস্থিতিতে এভারেস্টের ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উচ্চতার চূড়ায় পৌঁছানোটা আসলে সেই চূড়াকে জয় করা নয়, এটা প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে ব্যক্তির নিজের সীমাবদ্ধতাকে জয়—এই উপলব্ধিই এখন প্রবল।
আরেকটি যে বিষয় রয়েছে, তা মনস্তাত্ত্বিক। অর্থাৎ এভারেস্ট সামিটে পৌঁছাতে যেহেতু অনেক বাধা পার হয়ে যেতে হয়, সুতরাং এ কাজটিতে সফল হয়ে এখন আরেকটি উপলব্ধি হলো, কোনো কাজই এখন আর অসাধ্য নয়। আমিও পারি, আমরাও পারি—এ বিশ্বাসটা এখন তীব্র।
২০১০ সালের ২২ মে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতার ক্যাম্প টু থেকে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতার ক্যাম্প থ্রি আরোহণের সময় সবার আগে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। অন্য সব পর্বতারোহী আর শেরপার থেকে একটু হলেও আগে ক্যাম্প থ্রি পৌঁছানোর বিষয়টি মানসিক দিক থেকে আমাকে চাঙা রেখেছিল। এটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। ঘটনাটা এখানে নয়। ক্যাম্প থ্রিতে গিয়ে দেখি, একদল পর্বতারোহী বসে চকলেট চিবুচ্ছে আর পানি খাচ্ছে। তারা কি আমার মতোই ক্যাম্প টু থেকে ক্যাম্প থ্রিতে পৌঁছাল, নাকি এভারেস্ট সামিট করে ফিরে এল? তাই অভিবাদন বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের দেশ কোথায়? তোমরা কি মাত্রই ক্যাম্প থ্রিতে পৌঁছালে, নাকি সামিট করে এসেছ? দেশ আমেরিকায় জানিয়ে একজন যেই বলল যে তারা সামিট করে ফিরছে, তখন অভিনন্দন জানালাম। তিনি বলেছিলেন, না, একা তিনি আসেননি। তিনি তাঁর পাশে দুজনকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে দেখো আমার মেয়ে, আমার ছেলে। আমরা ছুটি কাটাতে এভারেস্ট অভিযানে এসেছি। এখন সবাই সামিট করে বাড়ি ফিরছি।’
শুনে আমি হাসব না কাঁদব, কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় চিন্তাচেতনা লোপ পেয়ে গেল। বলে কী! বাবা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে রীতিমতো এভারেস্ট জয় করে ছুটি উদ্যাপন করছেন। ভাবছিলাম, এই আমি এভারেস্ট অভিযানে এসেছি, তাতেই যে পরিমাণ ঠাট্টা আর টিটকারি সহ্য করতে হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর এরা আমাদের চিন্তার গণ্ডি ছাপিয়ে অন্য এক উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে গেছে। এখানেই আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য।
এভারেস্টে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা চলে গেছে, এমন উচ্চতায় আমরা পৌঁছে গেছি, যা আগে কখনোই ঘটেনি, আমার স্বপ্ন, সর্বক্ষেত্রেই সামনে এগিয়ে যাওয়া: সেটা সমাজ পরিবর্তনে, সমাজের কোনো সমস্যা সমাধানে, তরুণদের মাদক থেকে ফেরাতে, কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রকে সেবামুখী করাতে বা রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দুর্নীতি দূর করতে এবং মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে। কিন্তু এখনো বহু মানুষের আশ্চর্যের বিষয় এই এভারেস্ট জয়। তাঁরা বলেন, ‘ওরে বাবা! বলেন কী, এভারেস্ট অভিযানে পদে পদে এত বিপদ, তাহলে গেলেন কেন? ভয় করেনি? ভাই, আর যাইয়েন না, আর এসব করার দরকার নাই, এখন ঘরসংসারের দিকে মন দেন।’
সুতরাং এভারেস্ট জয়টাকে প্রতীকী ধরে আমরা নিজেদের উন্নয়ন করতে পারিনি। এখনো চিন্তার গণ্ডিটাকে, চিন্তার সীমাটাকে, চিন্তার আগলটাকে খুলে দিতে পারিনি। এখনো অনেককেই ভাবতে দেখি, এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার যারা করে, তারা নেহাত পাগল। না হলে কি আর ঘরসংসার ফেলে এভারেস্টে যায়! এই ফাঁকে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রশাসন ও পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি। ৪ জুলাই, ২০১০ তারিখে সেখানে দেওয়া সংবর্ধনার সময় বলেছিলাম, ‘এই ঠাকুরগাঁও আমার আরেক জায়গা, যা আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর প্রতিটি অলিগলি আমার চেনা। আমি জানি, এখানে কোথায় কোথায় মাদক বেচাকেনা হয়। আর এ তথ্য মনে হয় এ জেলার প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগও জানে। তাই তাদের কাছে আমার আশা, ঠাকুরগাঁওকে মাদকমুক্ত করুন।’ এ অনুরোধের পর ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী জেলা ঠাকুরগাঁওকে তাঁরা মাদকমুক্ত করেছিলেন। তাঁদের অভিনন্দন। আমি চাই, সারা জীবনের জন্য এই জেলা মাদকমুক্ত হোক, সারা দেশ মাদকমুক্ত হোক।
তারুণ্য মানেই জ্বলে ওঠার সময়, অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার সময়। তরুণদের এখন জ্বলে উঠতে হবে। তরুণদের চাওয়া—সমাজ যেন তাদের মূল্য দেয়, যেন তাদের চাওয়াটাকে সবাই বোঝে। এর জন্য আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমরা যারা তরুণ, যারা অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই, যারা এ সমাজকে বদলাতে চাই, যাঁরা চান যে এই সমাজ সুস্থ ধারায় চলবে, আমাদের প্রধান কাজ হলো—এই কাজগুলো যে আমরা করতে পারি, সেটা এই সমাজকে বুঝিয়ে দেওয়া। ‘আমার শক্তিটা যদি সবাইকে বুঝিয়ে দিতে পারি, নিজের সামর্থ্যের সঙ্গে যদি সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি, তাহলে সবাই আমাকে গুরুত্ব দেবে, আমাদের মূল্য বুঝবে।’ এই বিশ্বাস এখন আমার সঙ্গী। নিজেকে সব সময়ই বলি, ‘বি আ পজিটিভ থ্রেট’। এবং অবশ্যই তা বিনয়ের সঙ্গে। নিজের পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করার ভাষা হতে হবে বিনয়ী কিন্তু শক্তিশালী। তাহলে এই ‘পজিটিভ থ্রেট’টা সবাই ইতিবাচক হিসেবেই নেবে। নিজের ভেতর কোনো সম্ভাবনা তৈরি না করে হম্বিতম্বি করা বা আস্ফাালন আমরা কেউই পছন্দ করি না, করি কি?
এভারেস্ট জয়টাই শেষ নয়। এর মধ্যেই টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত বাংলা চ্যানেল জয় সম্ভব হয়েছে। আমাদেরই একজন লিপটন এই চ্যানেল পার হয়েছেন ছয়বার। এখন সময় ‘সেভেন সামিট’-এ বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর (সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয়, এর মধ্যে অবশ্য এশিয়া মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় হয়েছে)। বাংলাদেশের একজন নারী পর্বতারোহীকেও সহায়তা করতে চাই এভারেস্ট জয়ে। দেশে ১৬ কোটি মানুষকে নিয়ে প্রতিবছর ১৬ কোটি করে গাছ লাগানোর অভিযান চালাতে চাই, যেখানে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে। এসব কাজের উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের পক্ষে যে অনেক কিছু করা সম্ভব এবং অনেক কিছুই যে আমরা করি, করেছি এবং করব—এটাই সবার সামনে তুলে ধরা। আমাদের প্রজন্ম যেন গর্ব করে বলতে পারে, ‘আমরাও পারি’।
মুসা ইব্রাহীম: এভারেস্ট বিজয়ীপ্রথম বাংলাদেশি।

No comments

Powered by Blogger.