বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস, ২০১১-অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে by ফরিদা আখতার
৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এই দিনে কোনো একটি প্রতিপাদ্য থাকে, সেটি জানার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট দেখলাম। এবারের প্রতিপাদ্য দেখে আঁতকে উঠলাম। ইংরেজিতে যেভাবে রয়েছে, আগে সেটাই বলি, Antimicrobial resistance : No action today, no cure tomorrow (বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায়,
‘জীবাণুনাশকের প্রতিরোধ: আজ কিছু না করলে কাল রেহাই নেই’)। আমি কোনো চিকিৎসক নই, কাজেই সহজভাবে ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল’ অনুবাদ করা সম্ভব নয়। ভেবেছিলাম, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে কিছু পাব। না, সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস সম্পর্কে কিছুই নেই। আছে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক বিষয় কিংবা মাইক্রোবাস কেনার টেন্ডারের কথা। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট দেখলাম, সেখানেও এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস নিয়ে কিছু নেই। তবে বলতেই হবে, সেখানে স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্যান্য তথ্য আছে, যা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তুলনায় অনেক বেশি। ধন্যবাদ।
দেশে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা ভালো নয়, ভালো করার কোনো ইচ্ছাও কারও আছে কি না, জানি না। স্বাস্থ্যনীতি হয়েও হয় না, জনগণের পক্ষ থেকে পরামর্শ এলেও তা অবজ্ঞাভরে ফেলে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যবিষয়ক সভা-সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি সচিব, যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের সম্মান করে প্রধান বা বিশেষ অতিথি করতে চাইলে তাঁরা আসেন না। অনেক সময় আসবেন বলে কথা দিয়েও কার্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও অনুপস্থিত থাকেন। এতে আয়োজকদের কী ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। তবে এ কথা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতাও অনেক সময় পেয়েছি, যা কৃতজ্ঞতাভরেই স্বীকার করছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস প্রসঙ্গে এসব কথা বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু বলছি এ কারণে যে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারের কথা জানানোর এবং কীভাবে তা কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে তাঁদের কথা শোনার জন্যই নীতিনির্ধারক হিসেবে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, কিন্তু জনগণের স্বার্থের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ন্যূনতম মেলবন্ধন ঘটানোর উদ্যোগগুলো তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে বরবাদ হয়ে যায়। তার পরও আশা করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটগুলো সর্বশেষ তথ্য যেন দিয়ে রাখে, তাতে অন্তত কী হচ্ছে, তা জানার উপকারটুকু হয়। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার অর্থ শুধু মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া নয়, তথ্য দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ আসলে কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের (সংক্ষেপে এএমআর) সংজ্ঞা হিসেবে বলছে, জীবাণুনাশক ওষুধের প্রতি কোনো জীবাণুর অকার্যকর বা প্রতিরোধী হয়ে যাওয়া। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিম্যালেরিয়ার নির্দিষ্ট চিকিৎসায় সেই ওষুধটি আর কাজে লাগছে না। রোগসংক্রমণ বা ইনফেকশন বেড়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সবখানেই বিপজ্জনক পর্যায়ে ঠেকে গেছে। তাই এত দিনে স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই বোধোদয় ঘটেছে।
এই শঙ্কা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। যেকোনো জ্বর-কাশি, পেটের অসুখ থেকে শুরু করে নরম-শক্ত যেকোনো অসুখের জন্য ডাক্তারের কাছে গেলেই ওষুধের ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক না লিখলে তিনি আর ডাক্তার কিসের? রোগীদের মধ্যেও তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার তাগিদে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিলে খুশি হয়, এমনকি অনেকে ওষুধের দোকানে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের নাম জানা থাকলে তা-ই কিনে আনে। এ ব্যাপারে কোথাও কোনো বাধা নেই, কোনো নজরদারিও নেই। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে (৩ এপ্রিল ২০১০) এ বিষয়ে শিশির মোড়ল একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। যেখানে দেখানো হয়েছে, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে যেমন অ্যান্টিবায়োটিক আছে, তেমনই কোনো প্রকার ব্যবস্থাপত্র ছাড়াও ফার্মেসিগুলোয় অ্যান্টিবায়োটিক কেনাবেচা হচ্ছে। এটা আমাদের সবারই জানা। আরও একটি তথ্য বহু পুরোনো হলেও (২০০৫ সালের) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বা ভুল ব্যবহারের কারণে ব্যক্তি ও সমাজকে বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। জাতীয়ভাবে ওষুধের যে খরচ হয়, তার ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য, যার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা।
কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন—অ্যারিথ্রোমাইসিন ও এজিথ্রোমাইসিন নিউমোনিয়া নিরাময়ে কার্যকর ছিল, কিন্তু ঢালাও ব্যবহারের ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি ওষুধের কার্যকারিতা কমেছে বলে জানা গেছে। এর কারণ, নিউমোনিয়ার ব্যাক্টেরিয়া ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে গেছে। এই তথ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক আজাদ চৌধুরীর গবেষণায় পাওয়া গেছে। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কর্মশালায় বলা হয়েছে, দেশের প্রায় সব হাসপাতালে ৯০ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগী ডাক্তারের পরামর্শে অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের সংক্রমণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও সহিংস ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় (যায়যায়দিন, ২৩ ডিসেম্বর ২০১০)।
এর আগে যায়যায়দিন পত্রিকায় (১৯ অক্টোবর, ২০১০) আরেকটি প্রতিবেদনে আইসিডিডিআরবির গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার ৯৫ শতাংশ চিকিৎসক সর্দি-জ্বর, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার মতো অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। আশ্চর্য যে আইসিডিডিআরবি নিজেই তাদের ঢাকার হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীকে অ্যারিথ্রোমাইসিন দিয়ে থাকে। অ্যারিথ্রোমাইসিন এমন একটি ওষুধ, যা হার্ট পর্যন্ত স্তব্ধ করে দিতে পারে। স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে সেমিনারে এ তথ্যটি চিকিৎসক জাফরুল্লাহ চৌধুরী দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের একটি কর্মশালায় বলা হয়েছে, ব্যাক্টেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে গেলে চিকিৎসা খরচ ২০০ গুণ বেড়ে যায় এবং ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য সময় দ্বিগুণের বেশি লাগে (নয়া দিগন্ত, ৩ এপ্রিল ২০১১)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এবার যেভাবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, তাতে এ কথা পরিষ্কার যে অ্যান্টিবায়োটিকসহ ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসের ওষুধের অতি ব্যবহারের বড় সমস্যা হচ্ছে যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যাক্টেরিয়া-প্রতিরোধী বা রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাওয়া। পরবর্তী সময়ে রোগী আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে সুস্থ হতে পারে না। কারণ, তা আর কাজ করে না। আমাদের দেশে খুব কম চিকিৎসক আছেন, যাঁরা রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, এর আগে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক সে খেয়েছে কি না। আর গ্রামগঞ্জের রোগী হলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন কি না, জানি না। ব্যাক্টেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেলে চিকিৎসক আরও উচ্চমানের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রোগীকে সাময়িকভাবে সুস্থ করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তাঁকে বিকল করে দেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কয়েকটি তথ্য তুলে ধরছি। এক. প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণের কারণে রোগী সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হতে পারে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। দুই. প্রতিবছর নতুন করে চার লাখ ৪০ হাজার মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা (MDR-TB) রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার মৃত্যুবরণ করছে। তিন. ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশে ম্যালেরিয়া রোগে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন ওষুধ যেমন—ক্লোরোকুইন ও সালফাডক্সিন পাইরিমিথামাইনের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন উদ্বিগ্ন যে সংক্রামক রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে এই অবস্থা বড় ধরনের সংকট ও বিপদ সৃষ্টি করবে, এমনকি ১৯৪০ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের কারণে সংক্রামক রোগ নিরাময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হতে পারে, ফলে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। শুধু তা-ই নয়, এতে স্বাস্থ্য খরচ বেড়ে যাবে এবং আধুনিক ওষুধের ইতিবাচক কার্যকারিতা থেকে রোগীদের বঞ্চিত হতে হবে।
আমাদের স্বাস্থ্যসেবা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসানির্ভর এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার বহু রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে। অথচ এখন সেই অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দায়িত্বহীন ও মুনাফালোভী চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত স্বাস্থ্য-বাণিজ্যের কারণে মানুষকে ভয়ানক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এর দায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও নিতে হবে। আশা করি, সরকার সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
দেশে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা ভালো নয়, ভালো করার কোনো ইচ্ছাও কারও আছে কি না, জানি না। স্বাস্থ্যনীতি হয়েও হয় না, জনগণের পক্ষ থেকে পরামর্শ এলেও তা অবজ্ঞাভরে ফেলে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যবিষয়ক সভা-সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি সচিব, যুগ্ম সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের সম্মান করে প্রধান বা বিশেষ অতিথি করতে চাইলে তাঁরা আসেন না। অনেক সময় আসবেন বলে কথা দিয়েও কার্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও অনুপস্থিত থাকেন। এতে আয়োজকদের কী ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। তবে এ কথা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বিভাগের সহযোগিতাও অনেক সময় পেয়েছি, যা কৃতজ্ঞতাভরেই স্বীকার করছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস প্রসঙ্গে এসব কথা বলার প্রয়োজন নেই, কিন্তু বলছি এ কারণে যে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারের কথা জানানোর এবং কীভাবে তা কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে তাঁদের কথা শোনার জন্যই নীতিনির্ধারক হিসেবে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, কিন্তু জনগণের স্বার্থের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের ন্যূনতম মেলবন্ধন ঘটানোর উদ্যোগগুলো তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে বরবাদ হয়ে যায়। তার পরও আশা করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটগুলো সর্বশেষ তথ্য যেন দিয়ে রাখে, তাতে অন্তত কী হচ্ছে, তা জানার উপকারটুকু হয়। ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার অর্থ শুধু মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া নয়, তথ্য দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ আসলে কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধের (সংক্ষেপে এএমআর) সংজ্ঞা হিসেবে বলছে, জীবাণুনাশক ওষুধের প্রতি কোনো জীবাণুর অকার্যকর বা প্রতিরোধী হয়ে যাওয়া। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিম্যালেরিয়ার নির্দিষ্ট চিকিৎসায় সেই ওষুধটি আর কাজে লাগছে না। রোগসংক্রমণ বা ইনফেকশন বেড়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সবখানেই বিপজ্জনক পর্যায়ে ঠেকে গেছে। তাই এত দিনে স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই বোধোদয় ঘটেছে।
এই শঙ্কা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। যেকোনো জ্বর-কাশি, পেটের অসুখ থেকে শুরু করে নরম-শক্ত যেকোনো অসুখের জন্য ডাক্তারের কাছে গেলেই ওষুধের ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক না লিখলে তিনি আর ডাক্তার কিসের? রোগীদের মধ্যেও তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার তাগিদে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিলে খুশি হয়, এমনকি অনেকে ওষুধের দোকানে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের নাম জানা থাকলে তা-ই কিনে আনে। এ ব্যাপারে কোথাও কোনো বাধা নেই, কোনো নজরদারিও নেই। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে (৩ এপ্রিল ২০১০) এ বিষয়ে শিশির মোড়ল একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। যেখানে দেখানো হয়েছে, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে যেমন অ্যান্টিবায়োটিক আছে, তেমনই কোনো প্রকার ব্যবস্থাপত্র ছাড়াও ফার্মেসিগুলোয় অ্যান্টিবায়োটিক কেনাবেচা হচ্ছে। এটা আমাদের সবারই জানা। আরও একটি তথ্য বহু পুরোনো হলেও (২০০৫ সালের) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বা ভুল ব্যবহারের কারণে ব্যক্তি ও সমাজকে বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে। জাতীয়ভাবে ওষুধের যে খরচ হয়, তার ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিকের জন্য, যার পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা।
কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন—অ্যারিথ্রোমাইসিন ও এজিথ্রোমাইসিন নিউমোনিয়া নিরাময়ে কার্যকর ছিল, কিন্তু ঢালাও ব্যবহারের ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি ওষুধের কার্যকারিতা কমেছে বলে জানা গেছে। এর কারণ, নিউমোনিয়ার ব্যাক্টেরিয়া ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে গেছে। এই তথ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের শিক্ষক আজাদ চৌধুরীর গবেষণায় পাওয়া গেছে। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কর্মশালায় বলা হয়েছে, দেশের প্রায় সব হাসপাতালে ৯০ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগী ডাক্তারের পরামর্শে অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করছে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের সংক্রমণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও সহিংস ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় (যায়যায়দিন, ২৩ ডিসেম্বর ২০১০)।
এর আগে যায়যায়দিন পত্রিকায় (১৯ অক্টোবর, ২০১০) আরেকটি প্রতিবেদনে আইসিডিডিআরবির গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার ৯৫ শতাংশ চিকিৎসক সর্দি-জ্বর, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার মতো অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। আশ্চর্য যে আইসিডিডিআরবি নিজেই তাদের ঢাকার হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীকে অ্যারিথ্রোমাইসিন দিয়ে থাকে। অ্যারিথ্রোমাইসিন এমন একটি ওষুধ, যা হার্ট পর্যন্ত স্তব্ধ করে দিতে পারে। স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে সেমিনারে এ তথ্যটি চিকিৎসক জাফরুল্লাহ চৌধুরী দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের একটি কর্মশালায় বলা হয়েছে, ব্যাক্টেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে গেলে চিকিৎসা খরচ ২০০ গুণ বেড়ে যায় এবং ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য সময় দ্বিগুণের বেশি লাগে (নয়া দিগন্ত, ৩ এপ্রিল ২০১১)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে এবার যেভাবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, তাতে এ কথা পরিষ্কার যে অ্যান্টিবায়োটিকসহ ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসের ওষুধের অতি ব্যবহারের বড় সমস্যা হচ্ছে যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যাক্টেরিয়া-প্রতিরোধী বা রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাওয়া। পরবর্তী সময়ে রোগী আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে সুস্থ হতে পারে না। কারণ, তা আর কাজ করে না। আমাদের দেশে খুব কম চিকিৎসক আছেন, যাঁরা রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, এর আগে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক সে খেয়েছে কি না। আর গ্রামগঞ্জের রোগী হলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন কি না, জানি না। ব্যাক্টেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেলে চিকিৎসক আরও উচ্চমানের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রোগীকে সাময়িকভাবে সুস্থ করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তাঁকে বিকল করে দেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কয়েকটি তথ্য তুলে ধরছি। এক. প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণের কারণে রোগী সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হতে পারে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। দুই. প্রতিবছর নতুন করে চার লাখ ৪০ হাজার মাল্টিড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা (MDR-TB) রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার মৃত্যুবরণ করছে। তিন. ম্যালেরিয়াপ্রবণ দেশে ম্যালেরিয়া রোগে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন ওষুধ যেমন—ক্লোরোকুইন ও সালফাডক্সিন পাইরিমিথামাইনের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন উদ্বিগ্ন যে সংক্রামক রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে এই অবস্থা বড় ধরনের সংকট ও বিপদ সৃষ্টি করবে, এমনকি ১৯৪০ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের কারণে সংক্রামক রোগ নিরাময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হতে পারে, ফলে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। শুধু তা-ই নয়, এতে স্বাস্থ্য খরচ বেড়ে যাবে এবং আধুনিক ওষুধের ইতিবাচক কার্যকারিতা থেকে রোগীদের বঞ্চিত হতে হবে।
আমাদের স্বাস্থ্যসেবা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসানির্ভর এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার বহু রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে। অথচ এখন সেই অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দায়িত্বহীন ও মুনাফালোভী চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত স্বাস্থ্য-বাণিজ্যের কারণে মানুষকে ভয়ানক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। এর দায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও নিতে হবে। আশা করি, সরকার সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments