দেশ-জাতি-উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি চাই by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

যুগে যুগে একটি দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য নেতারা নতুন নতুন উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতির সূচনা করেছেন, দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অনেক সময় ন্যূনতম ভোগকে ত্যাগ করে জনগণকে উৎসাহিত করেছেন।


আমাদের মতো সীমিত সম্পদ ও বিশাল চাহিদার দেশে অপ্রয়োজনীয় ভোগকে নিরুৎসাহিত ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করার কোনো বিকল্প নেই। এরই কিছু উদাহরণ এবং আমাদের দেশের গতানুগতিক উন্নয়ন প্রতিকূল সংস্কৃতির খণ্ডচিত্র নিচে তুলে ধরছি।
১. কথিত আছে, কমরেডরা লেনিনের কাছে গিয়ে তাঁর জন্মদিন পালনের আগ্রহ ব্যক্ত করলে লেনিন সানন্দে রাজি হয়ে তাঁর জন্মদিনের কাছাকাছি সপ্তাহান্তের ছুটির দিন শনিবার নিজের অবসরের সময় ত্যাগ করে নিকটস্থ রাস্তাঘাট ও পার্ক পরিষ্কার করার পরামর্শ দিলেন। কী চমৎকারভাবে নেতার জন্মদিন পালন! পক্ষান্তরে নেতাদের জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবস পালন করতে আমরা কাজের পরিবর্তে ছুটি নিয়ে থাকি। শুধু তাই-ই নয়, এই দিবসগুলো পালনের নামে প্রয়োজনে চাঁদাবাজি করে বাড়তি ভোগ নিশ্চিত করি। আমাদের মতো উন্নয়নকামী সীমিত সম্পদের দেশে যেকোনো উপলক্ষে অনুৎপাদনশীল ও ভোগী হতে উৎসাহিত করা কাম্য নয়।
২. ভারতের প্রায় ৮০ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ি হাঁটুর অপারেশনের জন্য চিকিৎসাস্থল হিসেবে মুম্বাই শহর বেছে নিয়ে দেশের নাগরিকদের জানিয়ে দিলেন, নিজ দেশে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার চেয়ে অধিকতর মর্যাদার কোনো কাজ নেই। তা ছাড়া তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়ে কীভাবে নিজের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে ছোট করতে পারেন? ভারতীয় নেতাদের নিজ দেশের গাড়ি ব্যবহার করাও সুস্থ সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমের একটি চমৎকার উদাহরণ।
৩. অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক চলন্ত গাড়ির পেছনের আসনে বেল্ট না পরা অবস্থায় টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন বলে তাঁকে ১০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। জরিমানার হাত থেকে রেহাই পাননি রাষ্ট্রীয় অতিথি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের নেতা বারাক ওবামার গাড়ির বহর যখন তা লন্ডনের রাস্তার যানজটের কারণ হলো। নেতারা অবলীলায় আইন অমান্য করে কখনো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। তবে পর্যাপ্ত শাস্তি ভোগ করে অবশ্যই সাধারণ মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উৎসাহিত করতে পারেন। আইনের শাসন নিয়ে আমাদের ঢাক পেটানো অন্তহীন হলেও এর থেকে অনন্ত দূরত্বে আমাদের বাস আর কত দিন?
৪. বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের স্পিকার সোমনাথকে দামি গাড়ি দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি করাতে না পেরে কমাতে কমাতে যখন ১৩ লাখ রুপি দামের গাড়ির প্রস্তাব করা হলো, তখনো তিনি অতিরিক্ত দামি বলে প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষকে নির্ভোগ হতে উৎসাহিত করলেন। পক্ষান্তরে সাত গুণ ছোট অধিকতর ছোট অর্থনীতির বাংলাদেশে একই সময়ে স্পিকারদের জন্য ৫০ লাখ টাকার গাড়ি কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশে নেতারা কবে ত্যাগের সুস্থ ধারায় ফিরে আসবেন?
৫. শুনেছি মহাসম্পদশালী জাপানেও নাকি বিশ্বকাপ ফুটবলে কেবল জাপানের খেলা দেখানো হয়, তা-ও আবার অফিস-আদালত বন্ধ না করে, রাস্তা বন্ধ না করে, উৎপাদন বিঘ্নিত না করে। পক্ষান্তরে, বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের সংগীত কবে বাজবে, তা নিয়ে দারুণ আশাবাদীরাও আশার কথা শোনাতে না পারলেও তা দেখতে স্কুল-কলেজ বন্ধ, অধিক রাত জেগে তা দেখা এবং পরবর্তী দিন কর্মস্থলে সময়মতো না যাওয়া, গেলেও কাজ না করার নৈতিক সাহসও আমাদের অর্জিত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক দিনের ক্রিকেট খেলার ওভারের সংখ্যা কমিয়ে আনলে আকাশবাণী থেকে বলা হলো, শস্যের জন্য ওই বৃষ্টি নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পক্ষান্তরে, আমাদের দেশে ক্রিকেট খেলা দেখাটা নির্বিঘ্ন করতে লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত বন্ধ করা হয়, কর্মস্থলে পৌঁছার পথ রোধ করা হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের খেলা দেখা নির্বিঘ্ন করতে এমনকি সেচযন্ত্র বন্ধ করার নির্দেশ আসে টেলিভিশনের পর্দায়—উৎপাদন বন্ধ করা যেতে পারে, তাই বলে ভোগ ও উপভোগ কীভাবে বন্ধ করা যায়, বিশেষ করে বিদেশি ঋণ ছাড়া যে দেশের চলে না!?
৬. হরতালের উন্নয়ন-প্রতিকূল সংস্কৃতি আমাদের জন্য অভিশাপস্বরূপ। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়, ভোগ নয়। সরকারি দলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে বিরোধী দল হরতাল করে থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের ক্ষোভ দেখায় না খেয়ে, নতুন কাপড় না পরে, নিজে বঞ্চিত হয়ে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ রকম সংস্কৃতি অনুসরণ করলে তারা তাদের সত্যিকার ক্ষোভ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারত, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমর্থনও। একইভাবে শুধু সংসদ বর্জন নয়, সঙ্গে সঙ্গে সংসদের নানা সুবিধা বর্জন করলেও সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত হতো। বিরোধী দলের অঙ্গীকারের প্রতি মানুষ অধিকতর আস্থাশীল হতো। এ দুর্বল অর্থনীতির দেশে জনপ্রতিনিধিরা ভোগে সাধারণ হলেও ত্যাগে অসাধারণ না হলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন কীভাবে?
৭. বার্ড ফ্লুর কারণে থাই পোলট্রি ফার্মের অবস্থা যখন করুণ, তখন থাই প্রধানমন্ত্রী এই শিল্প বাঁচাতে টেলিভিশন প্রোগ্রামে নিজে মুরগির মাংস খেয়ে দেশবাসীকে জানালেন যে মুরগির মাংস খাওয়া এখন নিরাপদ। কলকারখানা, শিল্প উৎপাদন এবং উৎপাদিত সামগ্রী বিপণন করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। এই অবস্থায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন না।
আমাদের নানা সমস্যায় জর্জরিত সীমিত সম্পদের দেশের নেতারা সাধারণ্যের থেকে ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের ত্যাগ দিয়ে, উদারতা দিয়ে সারা দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করুন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের দেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য সফলভাবে নেতৃত্ব দিন, সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.