মানুষের মুখ-মনের আলো দিয়ে দেখা by মানসুরা বেগম

পায়ে চাপ দিলে মাথা, পিঠ বা কোমরের ব্যথা ভালো হয়। হাতে চাপ দিলেও শরীরের বিভিন্ন জায়গার ব্যথা কমে। এ কাজটি শুধু আঙুল ও হাতের তালু দিয়ে করতে হয়। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলে চিকিৎসা। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু কাজটি যিনি করেন, তিনি চোখে না দেখে অন্যের শরীরের সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে হাজির হলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাহবুব আহসানের ক্লিনিকে।


গুলশানের নিকেতনে এক রুমের ক্লিনিকে রোগী দেখেন মাহবুব। ঘরে আসবাব বলতে চাদর বিছানো শক্ত চৌকি আর টেবিল-চেয়ার। একদমই সাদামাটা। তবে মানুষটির শৈশব, কৈশোর এবং জীবনের বিভিন্ন অলিগলি ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো মোটেই সাদামাটা নয়।
এ ধরনের পেশা বেছে নিলেন কেন, প্রশ্নটি করেই ফেললাম তাঁকে। আড়াই বছর বয়সী এক সন্তানের বাবা মাহবুব বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলে কখনো পিছিয়ে থাকতে চাইনি। নিজে কিছু একটা করে স্বনির্ভর হতে চেয়েছি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করে ফেলি।’
বাংলাদেশ আকুপ্রেশার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে মাহবুব আহসান প্রতিদিন দেশি-বিদেশি রোগী দেখেন। গড়ে প্রতিদিন পাঁচজন রোগী আসে। শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার অপরাধে গত দেড় বছরের বেশি সময়ে দুজন রোগী চিকিৎসা না নিয়ে চলে গেছেন। তবে মাহবুব দৃঢ় কণ্ঠেই বললেন, ‘আমার ওপর ভরসা করে কেউ চিকিৎসা শুরু করলে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকেন। পরবর্তী সময়ে সেই রোগীই অন্যদের আমার ঠিকানা দেন। এভাবেই পরিচিতি বাড়ছে।’
আলাপ চলছে, কিন্তু মনে সন্দেহ রয়েই গেছে। এ মনোভাব বুঝতে পেরেই কি না, হঠাৎ মাহবুব আহসান বললেন, ‘আপা, আপনার পা-টা একটু দেন। কিছু বলার আগেই প্রায় লোহার মতো শক্ত হয়ে যাওয়া হাত দিয়ে পায়ে চাপ দিতে লাগলেন। ব্যথায় অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। বেশি ব্যথা হওয়া মানে নাকি সমস্যা থাকার লক্ষণ। হঠাৎ এই আকুপ্রেশার চিকিৎসক পায়ের একটি জায়গায় চাপ দিলেন। চাপ দিয়েই একটি সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। যে সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছি, কেন জানি না, আস্তে আস্তে তাঁর প্রতি অবিশ্বাস কমতে শুরু করল। ততক্ষণে এই চিকিৎসা-পদ্ধতিটি সম্পর্কে জানার ইচ্ছাও ডালপালা মেলতে শুরু করল।
আকুপ্রেশার বিষয়ে মাহবুব জাপান ও চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ বিষয়ে মিরপুরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একটি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করছেন।
আকুপাংচারের (সুঁই দিয়ে করতে হয়) জন্ম সুদূর চীনে। জাপান এ পদ্ধতিকে আরও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জাপানি ‘শিয়াটসু’ (SHIATSU) শব্দের ‘শি’ মানে হচ্ছে আঙুল আর ‘আটসু’ মানে হচ্ছে চাপ দেওয়া। অর্থাৎ আঙুল দিয়ে চাপ দেওয়া চিকিৎসা-পদ্ধতিকে আকুপ্রেশার বলা হচ্ছে।
এ পদ্ধতিতে শরীরের কোনো হাড়ে, দুই হাড়ের সংযোগস্থলে, মাংসপেশিতে ব্যথা থাকলে, হজমে সমস্যা থাকলে উপকার পাওয়া যায়। একইভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, মানসিক রোগ, অনিদ্রায় ওষুধের পাশাপাশি পদ্ধতিটি কার্যকর ভূমিকা রাখে। শরীরের ওজন কমাতে, রক্ত চলাচল বাড়াতে, শুধু অসুস্থ নয় সুস্থ ব্যক্তিকে নিরোগ ও কর্মক্ষম রাখতে বা নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে চাইলেও যে কেউ এ চিকিৎসা নিতে পারেন। পদ্ধতিটির প্রায় কোনোই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে একেকজন রোগীর পেছনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিতে হয়।
মাহবুব আহসানের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাজমুল হাসান। এর আগে ব্যাক পেইন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। কিন্তু লাভ হয়নি। সুঁই দিয়ে আকুপাংচারও করান। অফিসের একজন সহকর্মীর মাধ্যমে এ চিকিৎসকের কথা জানতে পারেন। নাজমুল বলেন, ‘ব্যথায় শরীর সব সময় আড়ষ্ট হয়ে থাকত। আকুপ্রেশার নেওয়ার পর থেকে শরীরটা অনেকটা জীবন্ত মনে হচ্ছে।’
মাহবুব একসময় চোখে দেখতেন। কিন্তু রেটিনার সমস্যায় নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে দেখতে পাচ্ছেন না। সময়টি ছিল ১৯৮৫ সাল। এরপর নারায়ণগঞ্জে সরকারের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে এসএসসি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ পাস করেন।
মাহবুব বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়তে পারে, তা-ই জানা ছিল না। চোখে দেখি না, বাইরে গিয়ে যদি বিপদে পড়ি, তাই বাবাও চাইতেন না আমি পড়াশোনা করি। নিজের ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত যাত্রাবাড়ীর বাসা থেকে ঢাকা কলেজে একাই যাতায়াত করে পড়াশোনা শেষ করি। একা বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণও নিই।’
২০০৩ সালে জাপানের জাইকার সহায়তায় আকুপ্রেশার কর্মসূচিতে মাহবুব সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। জাইকার সহায়তায় বিভিন্ন দেশের মোট ১০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র মাহবুবই জাপানে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান। তারপর বিষয়টিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। মাহবুব বলেন, ‘চীন-জাপানে প্রাকৃতিক এ চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয়। তবে দেশে বিষয়টি এখনো পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পরিস্থিতি আসেনি। তবে আমি আশাবাদী।’ তিনি জানান, এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল মাসাজ কমিশন বোর্ডের সদস্য হিসেবে বর্তমানে আকুপ্রেশার চিকিৎসাকে আরও উন্নততর করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
মাহবুব আহসানের কাছ থেকে এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে। যাঁদের দৃষ্টি আছে, তাঁরাও আগ্রহী হলে বিষয়টি শেখার সুযোগ পাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.