দুই দু’গুণে পাঁচ-আইজাক আসিমভের রসবোধ by আতাউর রহমান
এটা এপ্রিল মাস। এ মাসেরই ৬ তারিখে ১৯৯২ সালে বিখ্যাত আমেরিকান (জন্মগতভাবে রাশান) লেখক ও হিউমারিস্ট আইজাক আসিমভের জীবনাবসান ঘটে। ইহুদি বংশোদ্ভূত এই লেখক ছিলেন একাধারে জীববিজ্ঞান, রসায়নের অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখক, রম্যলেখক ও রম্যকথক। অথচ আমাদের এতদঞ্চলে তাঁর নাম খুব বেশি শোনা যায় না।
তবে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় দু-একবার আসিমভের নাম উচ্চারিত হয়েছে। আর তাঁর সুযোগ্য অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বোধ করি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখায় আসিমভ কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবেন এবং তাতে দোষের কিছু নেই।
আইজাক আসিমভের মৃত্যুর ঘটনাও বেশ রহস্যময়। তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর তাঁর স্ত্রী কর্তৃক প্রকাশিত স্বামীর আত্মজীবনীতে জানা যায়, ১৯৯২ সালে মৃত্যুর সাড়ে আট বছর পূর্বে একটি অস্ত্রোপচারের সময় দূষিত রক্ত গ্রহণে তাঁর শরীরে এইডসের সংক্রমণ ঘটে, যেটা পরে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বহুলপ্রজ এই লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, যেগুলোর শতকরা ৯৯ ভাগই বিজ্ঞানভিত্তিক। তবে হিউমারের ওপর তাঁর দুটো প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে ট্রেজারি অব হিউমার ও আসিমভ লাফস এগেইন। দুটো গ্রন্থই আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। হেন কোনো বিষয় নেই, যেটা নিয়ে তিনি ওই দুটি গ্রন্থে হিউমার করেননি। অধিকন্তু অন্তর্ভুক্ত করেছেন অগুনতি ‘লিমেরিক’ তথা পাঁচ লাইনের ছন্দোবদ্ধ কবিতা, যেগুলোর প্রায় পুরোটাই আমাদের মাপকাঠিতে অশ্লীল ও অপাঠ্য, তবে পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে সেটা সিদ্ধ।
আইজাক আসিমভের মতে, একটি ভালো জোক নাকি কয়েক ঘণ্টার দার্শনিক আলোচনার চেয়ে অধিকতর চিন্তা-চেতনার উদ্রেক করতে পারে। তাই তিনি নিজেকে, আপনজনদের নিয়ে অসংখ্য জোক তো করেছেনই, নিজ ধর্মাবলম্বী তথা ইহুদিদের নিয়েও অনেক মজার জোক বানিয়েছেন। স্থানাভাব হেতু তাঁর রচিত মাত্র একটি নাতিদীর্ঘ জোক এখানে পরিবেশন করছি। পরে স্বীয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর জোকসের কতক পরিবেশনের ইচ্ছে রইল। প্রসঙ্গত, যে নিজেকে নিয়ে নির্দ্বিধায় হিউমার করতে পারে, সে-ই তো সত্যিকারের হিউমারিস্ট।
মধ্যযুগে রোমের মধ্যস্থিত ভ্যাটিকান রাজ্যের শাসক পোপ তাঁর অধস্তন চার্চনেতাদের চাপে একবার স্থির করলেন, রোম থেকে তিনি ইহুদিদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন। অতএব এ নিয়ে ওখানকার ইহুদিদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল এবং ওরা পোপকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য করজোড়ে আবেদন জানাল।
পোপ তখন খানিকটা রগড় করার উদ্দেশে বললেন, তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের যেকোনো একজনের সঙ্গে ধর্মসম্পর্কিত বিতর্কে অবতীর্ণ হতে রাজি, তবে বিতর্কটা হতে হবে নির্বাক অভিনয় তথা অঙ্গভঙ্গিসহকারে এবং সে যদি জেতে, তাহলেই কেবল ইহুদিরা রোমে থাকতে পারবে। নয়তো ওদের রোম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ইহুদিরা উপায় না দেখে তাতেই রাজি হয়ে গেল। অতঃপর ওরা সিনেগোগ তথা ওদের প্রার্থনালয়ে একত্র হয়ে কাকে পাঠানো যায়, পরামর্শ করতে লেগে গেল। নিয়মানুযায়ী একজন রাব্বি তথা ইহুদি ধর্মযাজকের বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার কথা।
কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বাদানুবাদের পরও তেমন কাউকে রাজি করানো গেল না। সিনেগোগের জেনিটর তথা পাহারাদার যে এতক্ষণ প্রার্থনালয়ের প্রাঙ্গণ ঝাড়ু দিচ্ছিল ও বাদানুবাদ শুনছিল, এগিয়ে এসে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা যখন কেউই যেতে রাজি হচ্ছেন না, তখন আমিই না-হয় যাব।’ সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
যথাসময়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। পোপ গম্ভীরভাবে এক আঙুল তুলে আকাশের দিকে নির্দেশ করতেই জেনিটর তৎক্ষণাৎ তার এক আঙুল দ্বারা মাটির দিকে নির্দেশ করল। পোপ বিস্মিত হয়ে আবার তাঁর এক আঙুল জেনিটরের মুখের সামনে তুলে ধরতেই সে ঝটপট পোপের মুখের সম্মুখে তিন আঙুল তুলে ধরল। পোপ এবার অধিকতর আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাঁর পোশাকের পকেট হাতড়িয়ে একটি আপেল বের করে তুলে ধরতেই জেনিটর তার পকেট থেকে একটা পেপারব্যাগ টেনে এনে সেটার অভ্যন্তর থেকে এক টুকরো মসৃণ পাউরুটি বের করল।
পোপ অতঃপর সজোরে বলে উঠলেন, ইহুদিদের প্রতিনিধি বিতর্কে জয়লাভ করেছে। ইহুদিরা রোমে অবস্থান করতে পারবে।
জেনিটর বিজয়ীর বেশে প্রস্থান করতেই চার্চনেতারা পোপকে ঘিরে ধরল। ‘লোকটি বিতর্কে খুবই পারঙ্গম।’ পোপ বলতে লাগলেন, ‘আমি যখন আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বোঝাতে চাইলাম, ঈশ্বরই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে শাসন করছেন, তখন সে মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বুঝিয়ে দিল যে নিম্নস্থ জগতে কিন্তু ডেভিল তথা শয়তানই রাজত্ব করছে। তখন আমি তার মুখের সামনে এক আঙুল তুলে ধরলাম এটা বলতে যে, ঈশ্বর কেবল একজনই। সে সঙ্গে সঙ্গে তিন আঙুল তুলে ধরে আমাদের ডকট্রিন-অব-ট্রিনিটি তথা ত্রিত্ববাদ স্মরণ করিয়ে দিল। অতঃপর আমি পকেট থেকে আপেল বের করে পৃথিবীটা গোলাকার মর্মে সদ্য উদ্ঘাটিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা জানালে সেও তাঁর পকেট থেকে পাউরুটির সমতল টুকরো বের করে বোঝাল যে, এ সত্ত্বেও পৃথিবীটা দেখতে সমতলই দেখায়। সবকিছুরই উত্তর ওর জানা। আমি কী আর করতে পারি?’
ওদিকে ইহুদিরা জেনিটরকে ঘিরে দাঁড়ালে সে বলল, ‘পুরো ব্যাপারটাই ননসেন্স! প্রথমে পোপ আঙুলের ইশারায় বলতে চাইলেন, ইহুদিদের অবশ্যই রোম ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রত্যুত্তরে আমি তাঁকে জানালাম, ‘আমরা কোথাও যাচ্ছি না, এখানেই তথা এই মাটিতেই থাকব। অঙ্গুলি তুলে বোঝাতে চাইলাম, তিন সত্যি, আমরা মোটেই ভীত নই। তারপর কেন জানি তিনি হঠাৎ পকেট থেকে তাঁর দুপুরের নাশতা বের করলেন, দেখে আমিও বের করলাম।’
বি.দ্র.: নিবন্ধটি আজকের দিনে একজন মহান শিল্পীর প্রতি তাঁর একজন ভক্ত ভাবশিষ্যের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
আইজাক আসিমভের মৃত্যুর ঘটনাও বেশ রহস্যময়। তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পর তাঁর স্ত্রী কর্তৃক প্রকাশিত স্বামীর আত্মজীবনীতে জানা যায়, ১৯৯২ সালে মৃত্যুর সাড়ে আট বছর পূর্বে একটি অস্ত্রোপচারের সময় দূষিত রক্ত গ্রহণে তাঁর শরীরে এইডসের সংক্রমণ ঘটে, যেটা পরে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বহুলপ্রজ এই লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, যেগুলোর শতকরা ৯৯ ভাগই বিজ্ঞানভিত্তিক। তবে হিউমারের ওপর তাঁর দুটো প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে ট্রেজারি অব হিউমার ও আসিমভ লাফস এগেইন। দুটো গ্রন্থই আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। হেন কোনো বিষয় নেই, যেটা নিয়ে তিনি ওই দুটি গ্রন্থে হিউমার করেননি। অধিকন্তু অন্তর্ভুক্ত করেছেন অগুনতি ‘লিমেরিক’ তথা পাঁচ লাইনের ছন্দোবদ্ধ কবিতা, যেগুলোর প্রায় পুরোটাই আমাদের মাপকাঠিতে অশ্লীল ও অপাঠ্য, তবে পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে সেটা সিদ্ধ।
আইজাক আসিমভের মতে, একটি ভালো জোক নাকি কয়েক ঘণ্টার দার্শনিক আলোচনার চেয়ে অধিকতর চিন্তা-চেতনার উদ্রেক করতে পারে। তাই তিনি নিজেকে, আপনজনদের নিয়ে অসংখ্য জোক তো করেছেনই, নিজ ধর্মাবলম্বী তথা ইহুদিদের নিয়েও অনেক মজার জোক বানিয়েছেন। স্থানাভাব হেতু তাঁর রচিত মাত্র একটি নাতিদীর্ঘ জোক এখানে পরিবেশন করছি। পরে স্বীয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁর জোকসের কতক পরিবেশনের ইচ্ছে রইল। প্রসঙ্গত, যে নিজেকে নিয়ে নির্দ্বিধায় হিউমার করতে পারে, সে-ই তো সত্যিকারের হিউমারিস্ট।
মধ্যযুগে রোমের মধ্যস্থিত ভ্যাটিকান রাজ্যের শাসক পোপ তাঁর অধস্তন চার্চনেতাদের চাপে একবার স্থির করলেন, রোম থেকে তিনি ইহুদিদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন। অতএব এ নিয়ে ওখানকার ইহুদিদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল এবং ওরা পোপকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য করজোড়ে আবেদন জানাল।
পোপ তখন খানিকটা রগড় করার উদ্দেশে বললেন, তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের যেকোনো একজনের সঙ্গে ধর্মসম্পর্কিত বিতর্কে অবতীর্ণ হতে রাজি, তবে বিতর্কটা হতে হবে নির্বাক অভিনয় তথা অঙ্গভঙ্গিসহকারে এবং সে যদি জেতে, তাহলেই কেবল ইহুদিরা রোমে থাকতে পারবে। নয়তো ওদের রোম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ইহুদিরা উপায় না দেখে তাতেই রাজি হয়ে গেল। অতঃপর ওরা সিনেগোগ তথা ওদের প্রার্থনালয়ে একত্র হয়ে কাকে পাঠানো যায়, পরামর্শ করতে লেগে গেল। নিয়মানুযায়ী একজন রাব্বি তথা ইহুদি ধর্মযাজকের বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার কথা।
কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বাদানুবাদের পরও তেমন কাউকে রাজি করানো গেল না। সিনেগোগের জেনিটর তথা পাহারাদার যে এতক্ষণ প্রার্থনালয়ের প্রাঙ্গণ ঝাড়ু দিচ্ছিল ও বাদানুবাদ শুনছিল, এগিয়ে এসে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনারা যখন কেউই যেতে রাজি হচ্ছেন না, তখন আমিই না-হয় যাব।’ সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
যথাসময়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। পোপ গম্ভীরভাবে এক আঙুল তুলে আকাশের দিকে নির্দেশ করতেই জেনিটর তৎক্ষণাৎ তার এক আঙুল দ্বারা মাটির দিকে নির্দেশ করল। পোপ বিস্মিত হয়ে আবার তাঁর এক আঙুল জেনিটরের মুখের সামনে তুলে ধরতেই সে ঝটপট পোপের মুখের সম্মুখে তিন আঙুল তুলে ধরল। পোপ এবার অধিকতর আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাঁর পোশাকের পকেট হাতড়িয়ে একটি আপেল বের করে তুলে ধরতেই জেনিটর তার পকেট থেকে একটা পেপারব্যাগ টেনে এনে সেটার অভ্যন্তর থেকে এক টুকরো মসৃণ পাউরুটি বের করল।
পোপ অতঃপর সজোরে বলে উঠলেন, ইহুদিদের প্রতিনিধি বিতর্কে জয়লাভ করেছে। ইহুদিরা রোমে অবস্থান করতে পারবে।
জেনিটর বিজয়ীর বেশে প্রস্থান করতেই চার্চনেতারা পোপকে ঘিরে ধরল। ‘লোকটি বিতর্কে খুবই পারঙ্গম।’ পোপ বলতে লাগলেন, ‘আমি যখন আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বোঝাতে চাইলাম, ঈশ্বরই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে শাসন করছেন, তখন সে মাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বুঝিয়ে দিল যে নিম্নস্থ জগতে কিন্তু ডেভিল তথা শয়তানই রাজত্ব করছে। তখন আমি তার মুখের সামনে এক আঙুল তুলে ধরলাম এটা বলতে যে, ঈশ্বর কেবল একজনই। সে সঙ্গে সঙ্গে তিন আঙুল তুলে ধরে আমাদের ডকট্রিন-অব-ট্রিনিটি তথা ত্রিত্ববাদ স্মরণ করিয়ে দিল। অতঃপর আমি পকেট থেকে আপেল বের করে পৃথিবীটা গোলাকার মর্মে সদ্য উদ্ঘাটিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা জানালে সেও তাঁর পকেট থেকে পাউরুটির সমতল টুকরো বের করে বোঝাল যে, এ সত্ত্বেও পৃথিবীটা দেখতে সমতলই দেখায়। সবকিছুরই উত্তর ওর জানা। আমি কী আর করতে পারি?’
ওদিকে ইহুদিরা জেনিটরকে ঘিরে দাঁড়ালে সে বলল, ‘পুরো ব্যাপারটাই ননসেন্স! প্রথমে পোপ আঙুলের ইশারায় বলতে চাইলেন, ইহুদিদের অবশ্যই রোম ছেড়ে চলে যেতে হবে। প্রত্যুত্তরে আমি তাঁকে জানালাম, ‘আমরা কোথাও যাচ্ছি না, এখানেই তথা এই মাটিতেই থাকব। অঙ্গুলি তুলে বোঝাতে চাইলাম, তিন সত্যি, আমরা মোটেই ভীত নই। তারপর কেন জানি তিনি হঠাৎ পকেট থেকে তাঁর দুপুরের নাশতা বের করলেন, দেখে আমিও বের করলাম।’
বি.দ্র.: নিবন্ধটি আজকের দিনে একজন মহান শিল্পীর প্রতি তাঁর একজন ভক্ত ভাবশিষ্যের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।
No comments