ওরা ডাকাতি করতে যাচ্ছিল-‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাটি সাজানো! by গোলাম মর্তুজা ও মনিরুজ্জামান

নরসিংদীতে র‌্যাবের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আহত ব্যক্তিরা বলেছেন, র‌্যাব তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছে। তবে র‌্যাব বলছে, বাছ-বিচার করার সুযোগ ছিল না। সন্ত্রাসীদের গুলিতে র‌্যাব সদস্যরাও হতাহত হতে পারতেন।


আহত ব্যক্তিরা বলেছেন, তাঁরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হলেও ছিনতাই করেননি। আর ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাটি র‌্যাবের সাজানো। এদিকে ঘটনাস্থল ঘুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনার সত্যতা মেলেনি। গতকাল পর্যন্ত ছিনতাইয়ের অভিযোগে কোনো মামলাও হয়নি।
গত সোমবার দুপুরে নরসিংদী শহরের অদূরে নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কের মাঝামাঝি ৫ নম্বর ব্রিজের সামনে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন ছয়জন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার হন তিনজন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন: জামাল মিয়া (৩৫), নাহিদ মোল্লা (১৮), মোশাররফ হোসেন (৩৫), আরিফ মিয়া (১৮), মাসুদ আফ্রাদ (৩০) ও মোবারক আলী (২৮)। তাঁদের পরিবারের দাবি, ঘটনাটি র‌্যাবের সাজানো। র‌্যাব চাইলে তাঁদের সন্তানদের জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার করতে পারত।
গতকাল নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, এক কক্ষেই পুলিশ ও র‌্যাব হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন পায়ে গুলিবিদ্ধ অমর বিশ্বাস (৩৫) ও মাসুম মিয়া (২৭) এবং কাঁধে গুলিবিদ্ধ শাওন মিয়া (২০)। এখানে কথা হয় অমর ও মাসুমের সঙ্গে।
র‌্যাব-পুলিশের পাহারা অবস্থায় আহত ব্যক্তিরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে মদনগঞ্জ সড়কে যাচ্ছিলেন। তবে তাঁরা কোনো ব্যবসায়ীর ৪০ হাজার টাকা ছিনতাই করেননি। তাঁদের মাইক্রোবাসে ছিলেন সাতজন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন মোশাররফ, তাঁর পাশে বসে ছিলেন জামাল। মাঝের আসনে বসে ছিলেন অমর, মাসুম মিয়া ও শাওন মিয়া। আর পেছনের আসনে ছিলেন নাহিদ ও আরিফ। মাঝের আসনে বসা তিনজনই দরজা খুলে দৌড় দিতে পারায় বেঁচে গেছেন বলে জানান অমর। নিহত মোবারক ও মাসুদ আফ্রাদ মাইক্রোবাসে ছিলেন না। মনির হোসেন নামে আরেকজন অক্ষত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে নরসিংদী আদালতে পাঠানো হয়।
বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়নি: ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অমর বলেন, ‘আমাগো সামনে ছিল একটা হাইয়েস মাইক্রো। ৫ নম্বর ব্রিজে আসার পর সামনে দিয়া একটা ট্রাক খাড়াইল। হাইয়েস গাড়িডা থামল। আমাগো গাড়িডা ওইডার পিছে গিয়া থামল। গাড়ি থামার লগে লগেই সামনে থিকা আমাগো দিকে শুরু হইল গুলি। গুলি মানে গুলির বৃষ্টি। আমি দরজা খুইলা খিচ্চা দৌড় দিলাম খেতের দিকে। হেইহানেও র‌্যাব গুলি করতাছিল। পরে আমার পায়ে গুলি লাগে। তার পরও আমি দৌড়ায়া পাবলিকের কাছে চইলা যাই। পরে পাবলিক আমাকে ধইরা র‌্যাবে দিছে।’
র‌্যাবের দুজন সদস্য কী করে গুলিবিদ্ধ হলেন, জানতে চাইলে অমর বলেন, ‘কেডা গুলি করব। আমরা তো খাড়ানোরই সুযোগ পাইনি। আমরা যহন পলাইতাছিলাম আমাগো কেউ থামতেও কয়নি। ডাইরেক গুলি।’
হাসপাতালের বিছানায় কথোপকথনের সময় একজন র‌্যাব সদস্য ও চারজন পুলিশ সদস্যও ছিলেন। কথোপকথনের সময় র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্য পরিচয়দানকারী মনির হোসেন বলেন, অমরের কাছে একটি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। জবাবে অমর বলেন, ‘বন্দুক আইব কোইত্থিকা। আমার হাতে একটা ছুরি ছিল। আমি ওইডা নিয়াই গাড়িত উঠছি।’
অমর বলেন, গাড়িতে চাপাতি ছিল কয়েকজনের কাছে। কিন্তু কারও কাছেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। তবে র‌্যাবের করা মামলায় দেশে তৈরি এলজি, ১২ বোরের একটি কার্তুজ, ম্যাগাজিনসহ গুলিভর্তি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পিস্তল আর ছোরা উদ্ধার করার কথা উল্লেখ আছে।
হাসপাতালের বিছানায় তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে শুয়েছিলেন মাসুম মিয়া। তিনি বলেন, তিনি গাড়ির মাঝের আসনে ছিলেন। তাঁর হাতেও ধারালো অস্ত্র ছিল। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি শুরু হয়।
আহত শাওন বলেন, তাঁকে নাহিদ ও আরিফ পাঁচদোনা যাওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে যান। ভেলানগরে তিনি মাইক্রোবাসে ওঠেন। ভেলানগর থেকে পাঁচদোনা হয়ে শাহেপ্রতাপ যান তাঁরা। সেখান থেকে মদনগঞ্জ সড়কে যাওয়ার পথেই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
তবে র‌্যাব-১১ নরসিংদী ক্যাম্পের (সিপিসি-৩) কোম্পানি কমান্ডার মেজর খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, সন্ত্রাসীরা মাইক্রোবাস থেকে নেমেই গুলি ছুড়তে ছুড়তে র‌্যাবের মাইক্রোবাসের দিকে এগোতে থাকে। সে ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে র‌্যাবকে গুলি ছুড়তে হয়েছে।
ছিনতাই হয়নি: আহত তিনজনই গোলাগুলির ঘটনার আগে ছিনতাইয়ের কথা অস্বীকার করেছেন। অমর বলেন, ‘৪০ হাজার ট্যাকা আমরা কহন লইলাম। কিছু করার আগেই তো ছয়জনরে মাইরালাইল।’ অমর দাবি করেন, তাঁদের ডাকাতির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেটা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই র‌্যাবের গুলির মুখে পড়েন তাঁরা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিনতাইয়ের অভিযোগে সদর থানায় কেউ মামলা করেনি।
তবে ছিনতাইয়ের শিকার ব্যবসায়ী মারুফ হোসেনের মতে, তিনি ট্যাক্সিক্যাবে করে ঢাকা আসার পথে সালিধা ঈদগা মাঠ এলাকায় একটি সাদা মাইক্রোবাস তাঁর গাড়ি আটকিয়ে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। অন্য কয়েকজন বলেছেন, তাঁরা শুনেছেন মাধবদী এলাকায় ছিনতাই হয়েছে। মাধবদী এলাকাটি সদর থানার মধ্যে কিন্তু নরসিংদী শহরের বাইরে।
র‌্যাবের মামলার ভাষ্য: র‌্যাবের উপসহকারী পরিচালক জামালউদ্দীনের দায়ের করা ডাকাতির চেষ্টা মামলায় বলা হয়েছে, র‌্যাব-১১ আদমজী নগর নারায়ণগঞ্জের অধিনায়ক আবু হেনা মো. মোস্তফা গোপন সূত্রে খবর পান যে একদল ডাকাত নরসিংদী শহরে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ছিনতাই করে নরসিংদী শহর বা এর আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে ওই টাকা উদ্ধার এবং ডাকাতদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশে র‌্যাবের একটি দল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান চালায়।
ঘটনাস্থল এলাকার বাসিন্দারা যা বলেন: গতকাল দিনভর ঘুরেও ঘটনার সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। তবে গোলাগুলি শুনে এগিয়ে আসা ঘটনাস্থলসংলগ্ন একটি পুকুরের পাহারাদার ১০ বছরের বালক উসমান জানায়, গুলির শব্দ শুনে সে বের হয়ে দেখে কয়েকজন ধানখেত দিয়ে দৌড়াচ্ছে আর র‌্যাব গুলি করছে। উসমান জানায়, প্রায়ই ওই পথে র‌্যাবের সদস্যরা গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ান। মাঝেমধ্যে তার পুকুরপাড়ে গাছতলায় বসে তাঁরা বিশ্রাম নেন। সোমবার দুপুরে পুকুরের সামনে র‌্যাবের একটি গাড়ি কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর তার পুকুরপাড়ের সামনে থামতে দেখে উসমান ভেবেছিল, তাঁরা সেখানে বসবেন। তাই উসমান পুকুরপাড়ে ঢোকার দরজার তালাও খুলে রেখে খেতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরই শোনা যায় গোলাগুলির শব্দ।
উসমানের সঙ্গে থাকা ৫৫ বছরের হযরত আলী বলেন, তিনি গরু নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে আসছিলেন। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে গরু দৌড় দিলে তিনি গরুর পিছু ধাওয়া করেন। পরে এসে দেখেন ধানখেতে লাশ পড়ে রয়েছে।
ট্রাকের মালিক পাওয়া যায়নি: নরসিংদী থানা চত্বরে পড়ে থাকতে দেখা যায় চকচকে নতুন একটি তিন টনি ট্রাক। র‌্যাব জানিয়েছে, এই ট্রাক আড়াআড়ি করে রেখে ব্যারিকেড দিয়েই ‘ডাকাতেরা’ ডাকাতি করতে চেয়েছিল। ট্রাকের সামনের কাচে দুটি আর পেছনের লোহার ডালায় পাঁচটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। এই ট্রাকের ভেতর থেকে মাসুদ আফ্রাদের লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব। তবে ট্রাকের আসনে রক্তের কোনো দাগ দেখা যায়নি।
র‌্যাবের দায়ের করা তিনটি মামলারই (ডাকাতির চেষ্টা, সরকারি কাজে বাধা ও র‌্যাবের ওপর হামলা, অস্ত্র মামলা) তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী সদর থানার উপপরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তবে ট্রাকের মালিকের খোঁজ মেলেনি।
ট্রাকের মালিকের খোঁজ দিতে পারেননি শিবপুর বাস-ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মৃধাও।
গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মাইক্রোবাসটি রয়েছে নরসিংদী পুলিশ লাইনের ভেতরে। এই মাইক্রোবাসের মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, মাত্র ১৭ দিন আগে স্থানীয় তারা মিয়ার কাছ থেকে তিনি মাইক্রোবাসটি সাড়ে ১১ লাখ টাকায় কেনেন। ওই গাড়িটি তারা মিয়ার মালিকানাধীন থাকা অবস্থাতেই মোশাররফ গাড়িটি চালাতেন। ভালো চালক হিসেবে মোশাররফের সুনাম আছে। তাই তিনি চালক বদলাননি।

No comments

Powered by Blogger.