শেকড়ের সন্ধানে-সুন্দরবন নেই সুন্দরবনে by ফরহাদ মাহমুদ

এখন আর তেমনভাবে গ্রামাঞ্চলে পুঁথিপাঠের প্রচলন নেই। অথচ পঞ্চাশ, ষাটের দশকেও গ্রামাঞ্চলে পুঁথিপাঠের ব্যাপক প্রচলন দেখেছি। একটি গ্রামে এক-দুজনই পুঁথি পাঠ করতে পারতেন। তাঁরা খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না, অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন বলা চলে। তবে তাঁরা সুর করে পুঁথি পড়ার চমৎকার ক্ষমতা রাখতেন।


গ্রামে তখন আসর জমিয়ে গল্প বলারও প্রচলন ছিল। কয়েক গ্রামের মধ্যে একজন বা দুজন থাকতেন, যাঁরা ভালো গল্প বলতে পারতেন। সেসব গল্প ও পুঁথির মধ্যে গাজী কালু-চম্পাবতীর কাহিনী খুবই জনপ্রিয় ছিল। কথিত আছে, সেই কাহিনীর নামচরিত্র চম্পাবতী একসময় সুন্দরবনের গভীরে চলে গিয়েছিলেন নির্জন বসবাসের জন্য। সে সময়ের সেই নির্জন স্থানটি বর্তমানে সাতক্ষীরা যাওয়ার পথেই পড়ে। তার মানে সে সময় গভীর সুন্দরবন সাতক্ষীরা শহর থেকে অনেক উত্তরে ছিল। ঝিনাইদহেরও একটি বড় অংশ ছিল সুন্দরবনের মধ্যে। আর এখন সাতক্ষীরা থেকে ৬০-৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে পর্যন্ত লোকালয় বিস্তৃত। এরপর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর_যে ৫০-৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বন আছে, সেই বনের একটি বড় অংশই সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে মাত্র পাঁচ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। এগুলো পলি জমে নতুন করে গড়ে ওঠা ভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে, ২০ বছর পর সেগুলোতে বন থাকবে কি না, সেই বনে বন্য প্রাণী থাকতে পারবে কি না, তা বলা মুশকিল।
চম্পাবতীর কাহিনী তো গেল কয়েক শ বছর আগের কথা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে সুন্দরবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট শহরের দক্ষিণ ঘেঁষে। পটুয়াখালী, বরগুনারও বিরাট অংশ ছিল সুন্দরবনে। মাত্র ৫০-৬০ বছরে সেই সুন্দরবন গুটিয়ে এসে এখন বঙ্গোপসাগরের কোলে থাকা ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। সেই অবশিষ্ট সুন্দরবনেও মানুষের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়ছে। ভেতরে ভেতরে গড়ে উঠছে বিচ্ছিন্ন জনপদ। বাগেরহাট থেকে মংলা হয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত নদীর পূর্ব পাড়ে এখন আর সুন্দরবন নেই। কেবলই জনবসতি। খুলনার দক্ষিণে দাকোপ, কয়রা কিংবা সাতক্ষীরার দক্ষিণে শ্যামনগর পর্যন্ত সুন্দরবন হারিয়ে গেছে। মানুষের দীর্ঘ কাফেলা সুন্দরবনকে ঝেঁটিয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলছে, আর বীরদর্পে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করছে। কিন্তু এ বিজয় বিজয় নয়। এই শীর্ণকায়, অতি দুর্বল সুন্দরবন এখনো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দক্ষিণাঞ্চলকে রক্ষা করে চলেছে। সিডর-আইলার সময় আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। শুধু আগ্রাসী মানুষের কাফেলা নয়, বনখেকো বন কর্মকর্তারাও সুন্দরবন ধ্বংসে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন এবং রেখে চলেছেন। এ ছাড়া আছে চোরাশিকারিদের উৎপাত। এরা বাঘ-কুমির মেরে চামড়া পাচার করছে। নির্বিচারে হরিণ মেরে পার্শ্ববর্তী জনপদে নিয়ে মাংস বিক্রি করছে। মানুষও নিঃশব্দে তা গলাধঃকরণ করছে। ডাকাতের ভয়ে বিদেশি পর্যটক দূরে থাক, দেশের পরিবেশ-প্রকৃতিপ্রেমীরাও সুন্দরবনে যেতে ভয় পান।
মানুষের আগ্রাসনের পাশাপাশি প্রকৃতির আগ্রাসনও বাড়ছে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, সিডর ও আইলার মূল আঘাত হয়েছিল সুন্দরবনে। বন বিভাগের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, কেবল সিডরে সুন্দরবনের পূর্বাংশে ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ গাছপালা ভেঙে গিয়েছিল। বন্য প্রাণীদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোনা জলে পুরোপুরি ডুবে যাচ্ছে সুন্দরবনের মাটি। উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দুই-এক দশকের মধ্যেই সুন্দরবনের বহু প্রজাতির গাছপালা হারিয়ে যাবে। সেখানকার স্থলচর বন্য প্রাণীরা হারিয়ে যাবে। অপূরণীয় ক্ষতি হবে সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সুন্দরবনের বৃক্ষবর্মের কারণে পেছনের জনপদগুলোতে সিডরের ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে। বলা হয়, ঝড়কে নিজের বুকে ধারণ করে জনপদগুলোকে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। কিন্তু এ ঝড়ই তো শেষ ঝড় নয়, যেকোনো মুহূর্তে আবারও ধেয়ে আসতে পারে আরো কোনো ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়। তখন এই বিধ্বস্ত সুন্দরবন কি পারবে আমাদের রক্ষা করতে? তাই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না করে কেবল প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য করার জন্য ভোট দিয়ে গেলে কোনো লাভ হবে না। এ ছাড়া ডুমুরিয়া, শ্যামনগর ও অন্যান্য এলাকায় সুন্দরবন ধ্বংস করে যে জনপদ গড়ে উঠেছে, সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটারের এক-দশমাংশ বাড়লেই সেখানে মানুষের বসবাস কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ এসব এলাকার অধিকাংশ স্থানই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ সেন্টিমিটার উচ্চতার মধ্যে। সুন্দরবনের জন্য আরেকটি বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে বনভূমি দখল করে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ির চাষ।
সুন্দরবনের বড় এবং সমৃদ্ধ অংশটাই ছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশে সুন্দববনের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা অনেক কমে গেছে। বর্তমানে এই বনের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের অধীন সুন্দরবনের চেয়েও অনেক খারাপ। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় বন বিভাগের আগ্রহ নেই বললেই চলে। তদুপরি এই সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকার ওপর বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণও নেই। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে জানা যায়, সুন্দরবনের এই বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি ডাকাতদল। সুন্দরবনে বন বিভাগের ৮০টির মতো টহল ফাঁড়ি ছিল। ডাকাতদের ভয়ে অনেক টহল ফাঁড়ির অস্ত্রপাতি বন বিভাগ সরিয়ে নিয়েছে। এখন সেসব ফাঁড়ির অধিকাংশই ডাকাতদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এমনও শোনা যায়, পেশাদার বনজীবীরা সরকারকে যত বনকর দেয়, ডাকাতদের দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সেই টাকা উঠিয়ে আনতে নির্বিচারে তাদের বন কেটে সাফ করতে হয়। আবার বনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তাও অবৈধ অর্থের বিনিময়ে বন ধ্বংসে সহায়তা করে। এ কারণে অনেকেই মনে করেন, বর্তমান বন বিভাগের অধীনে থাকলে সুন্দরবন রক্ষা করা যাবে না, এর বন্য প্রাণীও সংরক্ষণ করা যাবে না। তাঁরা মনে করেন, সুন্দরবনের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সেখানে সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে।
আমাদের সুন্দরবনের অবস্থা যতটা খারাপ, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের অবস্থা ততটাই ভালো। ফলে বেঙ্গল টাইগারের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আমাদের সুন্দরবনে নির্বিচারে হরিণ নিধনের ফলে বাঘ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে। ফলে বাধ্য হচ্ছে লোকালয়ে ঢুকে গরু-ছাগল মারতে। আর তখন গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে পিটিয়ে বাঘ মারছে। ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে। সেখানকার বাঘের খাদ্যসংকট প্রবল নয়। তার পরও কদাচিৎ বাঘ লোকালয়ে চলে এলেও মানুষ মিলিতভাবে বাঘটিকে তাড়া করে আবার বনে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানকার বন বিভাগও এ ব্যাপারে যথেষ্ট তৎপর। বছর কয়েক আগে সেখানে একটি বাঘকে একটানা ৯ দিন অনুসরণ করেছিলেন বনকর্মীরা। তারপর ঘুমপাড়ানি বন্দুক দিয়ে অজ্ঞান করে বাঘটিকে আবার সুন্দরবনে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানকার সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য উভয়ই অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অনেক ভালো। চোরাশিকারিদের বনের আশপাশে থাকা লোকজন বা বনজীবীরাই প্রতিরোধ করতে পারে। পর্যটকদেরও ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করার প্রয়োজন হয় না। তাদের জন্য সুন্দরবনের ভেতরেই থাকা-খাওয়া ও ঘুরে বেড়ানোর মতো অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতিবছর সেখানকার সুন্দরবনে হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। লাখ লাখ ডলার আয় হয় পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন থেকে, যে অর্থ আবার তারা সুন্দরবনের উন্নয়নে ব্যয় করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের সুন্দরবনে তার কিয়দংশও নেই।
বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনকে সত্যিই যদি আমরা প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যে দেখতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের এই বনকে রক্ষা এবং উন্নয়নের পদক্ষেপ আগে নিতে হবে। এখানে বন্য প্রাণীদের আবাসযোগ্যতা উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সুন্দরবন যেহেতু বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অংশবিশেষ জুড়ে বিস্তৃত_তাই সুন্দরবন সংরক্ষণে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রয়োজন, বাঘ চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট নিয়ন্ত্রণ করা। সে ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগও খুবই জরুরি। বাংলাদেশে বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে বাঘ যেন বাঘের মতোই বেঁচে থাকতে পারে, সে ব্যাপারে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে_এটাই সবার প্রত্যাশা। প্রয়োজনে আলাদা বন্য প্রাণী বিভাগ গঠন করে শুধু বাঘ নয়, এ দেশে অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে থাকা আরো বহু বন্য প্রাণীকে রক্ষা করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.