সাময়িক প্রসঙ্গ-মনমোহনের উক্তি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হবে না by ইমতিয়াজ আহমেদ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ। তিনি বিদগ্ধজন ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কথা বলেন কম, কিন্তু যা বলেন তাতে ওজন থাকে। গুণী মানুষের কদর হয় না, এমন কথা অনেক সময় বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এটা কোনোভাবেই প্রযোজ্য বলা চলে না।


বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যেসব সমাবেশে তিনি উপস্থিত থাকেন, তার মতামত গুরুত্ব পায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।
তিনি বুধবার কথা বলেছেন ভারতের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে। এ আয়োজন ছিল রুদ্ধদ্বার। তবে তিনি সূচনা-বক্তব্যে যা বলেছেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের যা যা উত্তর দিয়েছেন তার ভাষ্য পরে সংবাদমাধ্যমে প্রদান করা হয়। দীর্ঘ এ আলাপচারিতাকালে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তার কাছে প্রতিবেশীদের নিয়ে কিছু বলার অনুরোধ ছিল। উত্তরে তিনি প্রথমে বলেন শ্রীলংকা প্রসঙ্গে। তারপরই এলো বাংলাদেশের কথা। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক চমৎকার। শেখ হাসিনার সরকার দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় লিপ্ত সংগঠনগুলোকে দমনে ভারতকে সহায়তা দিচ্ছে। এ সবকিছুর পরও দেশটির পরিস্থিতি খুবই সংবেদনশীল। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক, যারা অত্যন্ত ভারতবিদ্বেষী। এছাড়া দেশটিতে ছড়িয়ে রয়েছে আইএসআইর নানা রকম চক্রান্তের জাল। তাই যে কোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে।'
ড. মনমোহন সিং বেশি শব্দ ব্যয় করেননি। কিন্তু অর্থপূর্ণ কথা বলেছেন, এমনটি বলাই যায়। আবার এ প্রশ্নও করা যায়, আদৌ কি তিনি কূটনীতির সূত্র অনুসরণ করে কথা বলেছেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, প্রতিবেশী একটি দেশ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন কি যথার্থ হয়েছে?
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন দুর্নীতি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। কমনওয়েলথ গেমস ও টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি বিশেষভাবে জনমনকে আলোড়িত করছে। এ দুটি ঘটনার সঙ্গেই কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং অনেকের বিশ্লেষণে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং নিজেও তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের অন্যায়ের দায় এড়াতে পারেন না।
এটা আমাদের জানা আছে যে, ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীই প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হচ্ছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি 'অন্তরাত্মার ডাক শুনে' সরে দাঁড়ান এবং মনমোহন সিংকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরের কয়েকটি বছর তিনি দেশ পরিচালনায় দক্ষতা দেখান এবং স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এ কারণে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হতে তার কোনো সমস্যাই হয়নি। ভোটারদের কাছে তিনিই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম্বার ওয়ান চয়েস। কিন্তু এখন তার নিজের কর্তৃত্বই প্রশ্নবিদ্ধ। এমন প্রশ্নও তাকে প্রকাশ্যে করা হচ্ছে যে, রাহুল গান্ধীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দেবেন কি-না। বলা যায়, সময়টি তার জন্য ভালো যাচ্ছে না। বুধবার সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনায় কি এর প্রতিফলন ঘটেছে? তাকে কি হতাশা গ্রাস করেছে?
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। তথ্যগতভাবে যা সঠিক নয়। তার এ বক্তব্যের দুটি অর্থ হতে পারে। এক. তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত নন। স্পষ্টতই তাকে ভুল তথ্য জোগানো হয়েছে। কিংবা এটাও হতে পারে যে, তিনি আসলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয়ের কথাই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কৌশলগতভাবে বিএনপির নাম বলেননি। তার উক্তির প্রেক্ষাপট যাই থাকুক না কেন তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ঠিক মন্তব্য করেননি। এটাও হতে পারে যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার কিংবা সার্বিকভাবে ভারতের হতাশার প্রকাশ ঘটেছে এ মন্তব্যে। বাংলাদেশের কাছে ভারতের হয়তো এমন কিছু প্রত্যাশা ছিল যা পূরণ হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের কথা। এ সফর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং এ সময়ে অমীমাংসিত বেশ কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে বলে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী 'বাংলাদেশে রাজনৈতিক দৃশ্যপট যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে' কিংবা এখানের '২৫ শতাংশ লোক ভারতবিদ্বেষী' এমন মন্তব্যে কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে না। দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও তা কাজ দেবে বলে মনে হয় না।
ভারতে গণতন্ত্র টেকসই হয়েছে। বাংলাদেশেও চলছে গণতান্ত্রিক শাসন। প্রতিটি দেশের জনমতের থাকে পৃথক বৈশিষ্ট্য। সরকার কাজ করে জনমতকে বিবেচনায় রেখে। এ জনগণকে কোনো দেশের পক্ষ বা বিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা অনুচিত। বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রত্যাশা ব্যক্ত করবেই। কেউ ভারতের সঙ্গে এক বা একাধিক ইস্যুতে ভিন্ন মত প্রকাশ করলেই তাকে ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা চলে না। এভাবে মত ব্যক্ত করা হলে ভারতবিরোধী শক্তিও তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে, যারা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কাজ করছে তাদের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বিরোধীরা তাদের চিহ্নিত করবে ভারতপন্থি হিসেবে।
মনমোহন সিং এখন রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রাজ্ঞ। কেন বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তিনি এমন মন্তব্য করবেন তার ব্যাখ্যা আশা করব। কোন প্রেক্ষাপটে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন, সেটা জানা জরুরি। সামনে রয়েছে তার ঢাকা সফরের কর্মসূচি। তিনি এ দেশের জনগণের মন জয় করে ফিরে যাবেন, এমনটিই প্রত্যাশা থাকবে। যেমনটি ঘটেছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়। তার মন্তব্যের কারণে সফরের প্রস্তুতি পর্যায়ে যেন অস্বস্তি বিরাজ না করে। তিনি নিজে ব্যর্থতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার সমস্যা অনেক। এর সঙ্গে যদি বৈদেশিক বিষয়টিও ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারার অভিযোগ ওঠে সেটা কি ভালো হবে?
বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন বীণা সিক্রি। তিনি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, 'অন্য দেশের জনগণকে এভাবে বলা যথাযথ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। বিএনপি বলছে, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করছে না। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদার করতে আগ্রহী। কারণ তিনি মনে করেন এর পেছনে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে।'
বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ লোক জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক_ এ তথ্যের উৎস সম্পর্কে বীণা সিক্রি প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৩৩ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছে বিএনপি। প্রায় সমপরিমাণ ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ। বাকি ৩৩ শতাংশ লোককে বলা যায় ভাসমান, যারা বিভিন্ন ইস্যু স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই বলা যায় না যে ২৫ শতাংশ লোক ভারতবিরোধী। এভাবে ক্যাটাগরি করা যায় না, যেমন বলা যায় না পাকিস্তান সম্পর্কেও। শাসক কিংবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এ কথা বলা যায়, কিন্তু জনগণ সম্পর্কে বলা যায় না। তিনি বলেন, আইএসআইর প্রভাব পূর্ববর্তী শাসকদের সময়ে জোরালো ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিংবা ডিজিএফআইর মতো প্রতিষ্ঠান জনমতের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল, যা পাকিস্তানের মতো নয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা দেখেছে যে, জনমত নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূল এবং তারা চমৎকার কাজ করেছে। বীণা সিক্রি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আরও ভালো জীবন চায় এবং তাদের অনেকেই মনে করেন যে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এটা সম্ভব।
মনমোহন সিং সম্পাদকদের বলেছেন, 'ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে প্রয়াসী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে ন্যায্য ও স্থায়ী বোঝাপড়া গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা ধনী দেশ নই। তবু পড়শি দেশটির (বাংলাদেশের) উন্নয়নযজ্ঞে শামিল হয়ে আমরা ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সদয় বিবেচনা আমাদের মধ্যে কাজ করছে। আমরা তাদের আরও কিছু একতরফা ছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছি। আমি নিজে সে দেশে যাওয়ার কথা ভাবছি। এ সপ্তাহে যাচ্ছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থাৎ আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার।' তার এ প্রত্যাশার সঙ্গে কিন্তু অন্যান্য উক্তি কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দুঃখজনকভাবে হলেও বলতে চাই যে, তিনি যেভাবে বলেছেন তাতে কিন্তু কেউ কেউ ধরে নিতে পারেন যে তার কণ্ঠে ছিল হতাশার সুর এবং তার কারণ অভ্যন্তরীণ। এটাও বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশে নয়, বরং ভারতই একটি পরিবর্তনের কাছাকাছি এবং সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই রয়েছেন নাজুক অবস্থানে। সেখানে শীর্ষ পদে পরিবর্তন প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে এবং বিকল্প নামও রয়েছে এজেন্ডায়।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্ল্নেষক এবং অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.