'মামাবাড়ির আবদার' গার্মেন্ট মালিকদের by আবুল কাশেম

আহ্লাদের শেষ নেই যেন গার্মেন্ট মালিকদের। শ্রম আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর শ্রমিকদের বঞ্চিত করে আসছেন তাঁরা। সরকার বারবার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিলেও প্রতিবারই 'শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে' অজুহাত তুলে মালিকরা উল্টো সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন।


সব শেষ তাঁরা 'মামাবাড়ির আবদার'-এর মতো এক দাবি তুলে মন্ত্রীর কাছে চিঠি হেঁকেছেন- পোশাক খাতের জন্য আলাদা শ্রম আইন করতে হবে এবং সেখানে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার বিধান রাখা যাবে না।
শিল্প-কারখানার মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা। অর্থাৎ, মালিক বছর শেষে ১০০ টাকা মুনাফা করলে সেখান থেকে পাঁচ টাকা পাবে শ্রমিকরা- এ কথা বলা আছে শ্রম আইন ২০০৬-এ। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন নামে ১৯৬৮ সালে করা শ্রম আইনেও আছে এ কথা। কিন্তু আইনে নেই যে এটা না মানলে শাস্তি কী। পোশাক শিল্প মালিকরা আইনের এই ফাঁককে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের লাভের ৫ শতাংশ টাকাসহ পুরোটাই পকেটে ভরেছেন। সরকার এখন এ আইন সংশোধন করে শাস্তির বিধান রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ (বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) শ্রমিকদের লাভের টাকাও দেবে না, শাস্তিও নেবে না। তাই তাদের আহ্লাদী দাবি হলো- পোশাক খাতের জন্য আলাদা শ্রম আইন করতে হবে, যেখানে শ্রমিকদের লাভের টাকা দেওয়ার কোনো 'বালাই' থাকবে না। কারণ হিসেবে বিজিএমইএ বলেছে, 'আইন মানুষের জন্য; আইনের জন্য মানুষ নয়।' তাদের যুক্তি শুনে অনেকে মন্তব্য করেছেন, মনে হয় শুধু মালিকরাই মানুষ, শ্রমিকরা নয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে পোশাক শিল্পের মালিকদের বৃহৎ সংগঠন বিজিএমইএ এক চিঠি দিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন চিঠিতে লিখেছেন, মানুষের প্রয়োজনে আইন তৈরি হয়ে থাকে; আইনের জন্য মানুষ নয়। চিঠিতে শ্রমিক কল্যাণে মুনাফা থেকে ৫ শতাংশ অর্থ খরচের বিধান না রেখে শুধু পোশাক খাতের জন্য আলাদা একটি শ্রম আইন প্রণয়নের আবদার করেছেন তিনি।
সভাপতির এ চিঠি সম্পর্কে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'চিঠির ধরন দেখে মনে হচ্ছে- গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা শুধু নিজেদেরই মানুষ মনে করেন, শ্রমিকদের নয়।' তিনি জানান, শ্রমিকদের মানুষ মনে করেই তাদের জন্য সরকার এ আইনে সংশোধন আনার কাজ শুরু করেছে। মালিকরা মুনাফার অংশ থেকে ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করবেন, এটা বহু পুরনো আইন। ২০০৬ সালের শ্রম আইনেও এটা বলা আছে। কিন্তু এ আইন এত দিন পোশাক কারখানার কোনো মালিক মানেননি। আর এ আইন অমান্যে শাস্তির কোনো বিধান নেই। তাই সরকার এবার শাস্তির বিধান রেখে আইন সংশোধন করছে। তিনি বলেন, শ্রমিকের ঘামে বছর শেষে ১০০ টাকা মুনাফা হলে সেখান থেকে পাঁচটি টাকা শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করা যাবে না- এটা সভ্য সমাজে কাম্য নয়। আর গার্মেন্ট মালিকরা শুধু চান আর চান, ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করে পাহাড় সমান সম্পদ গড়লেও একবারের জন্যও কেউ শিল্পের অবস্থা ভালো থাকার কথা স্বীকার করেননি।
মন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে অনেক আবদারের পাশাপাশি বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বড় ও মোটা হরফে লিখেছেন, 'কোনো অবস্থাতেই বর্তমান খরচের চেয়ে অতিরিক্ত কোনো বোঝা এই শিল্পের বহন করার ক্ষমতা নেই। কোনো অবস্থাতেই পোশাক শিল্পের ওপর বৈরী ও অসময়োপযোগী নীতি ও সিদ্ধান্ত দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সংগতিপূর্ণ নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড উদ্যোক্তাদের মধ্যে আগামী দিনে এই শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে।'
এ ছাড়াও চিঠিতে শুধু পোশাক শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা, ইটিপি ব্যবহার না করলেও শাস্তি বা জরিমানা না করা, বীমা রেটে ভর্তুকি রেট বহাল রাখার দাবিও করা হয়েছে। গত বাজেটে এ শিল্পে উৎসে কর বাড়ানোর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, 'উৎসে কর নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিল্প সম্পর্কে কতটুকু বাস্তব ধারণা রাখে, তা একটি বড় প্রশ্ন।' সরকারের এ উদ্যোগ নাকি 'গণতান্ত্রিক সরকারের নীতি ও লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সার কারখানায় গ্যাস না দিয়ে পোশাক শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবি করে তিনি লিখেছেন, শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে এসেছে। অন্যদিকে সার কারখানায় বাড়ছে। দেশ ও অর্থনীতির স্বার্থে যদি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে সাত হাজার ৪২৪ কোটি টাকা নগদ সহায়তা, এক লাখ কোটি টাকারও বেশি শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা, বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি আদায়, উচ্চ সুদের বাজারেও মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ঋণ, মন্দার সময় দুই হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা প্রাপ্তি, ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনতফসিল, ২৭০টি রুগ্ণ ও বন্ধ গার্মেন্ট কারখানার ব্যাংক ঋণের সম্পূর্ণ সুদ মওকুফসহ নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার পরও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি বলেছেন, 'পোশাক শিল্পের সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত গড়ে ওঠা পাঁচ হাজার ৩৩৯টি কারখানার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৫০০টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সে বিষয়ে কারো কোনো দায়িত্ব বা ভূমিকা কখনোই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।'
কিন্তু মন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে কারখানা বন্ধের পরিসংখ্যান তুলে ধরলেও বিজিএমইএর হিসাবে প্রতিবছরই নতুন নতুন ব্যবসায়ী তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ করছেন। প্রতিবছরই এ সংগঠনে নতুন নতুন সদস্য যোগ হচ্ছেন।
এ খাতে নাকি শ্রম আইন সম্পূর্ণভাবে মেনে চলা হয়- এমন দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি চিঠিতে বলেছেন, পোশাক শিল্প সরাসরি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় কারখানাগুলোকে দেশের শ্রম আইন ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করে চালাতে হয়। ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে কমপ্লায়েন্সের শর্ত না মেনে উপায় নেই। কমপ্লায়েন্স অডিটররা কারখানার শ্রম পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেন। এ ক্ষেত্রে শ্রম আইন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটলে কারখানার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
এ চিঠি প্রসঙ্গে সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, অন্য সব খাতের মতো পোশাক খাতের জন্য একই ধরনের শ্রম আইন হতে পারে না। আইন হতে হবে স্বচ্ছ। গার্মেন্ট শিল্প খাতে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ নেই। পোশা খাত দর্জির দোকানও নয়। জাহাজ নির্মাণের শ্রমিকের সুবিধা আর পোশাক খাতের শ্রমিকের সুবিধা এক হতে পারে না। এ খাতের জন্য আলাদা আইন দরকার। প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন খাতের জন্য আলাদা করে শ্রম আইন করতে হবে। তিনি বলেন, গার্মেন্ট শিল্প খাতের জন্য যে শ্রম আইন থাকবে, সেখানে মুনাফা থেকে ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা না রেখে তাদের জন্য একটি তহবিল গঠনের কথা থাকতে পারে। ৩৬ লাখ শ্রমিক রয়েছে এ খাতে। ১৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসে এ খাত থেকে। পোশাক শিল্পের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয়ও থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি আরো বলেছেন, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হলে যদি তা সব কারখানার পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়, তবে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, যখনই সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কোনো অধিকার বাস্তবায়ন কিংবা মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই বরাবরের মতো মালিকদের কণ্ঠে ভেসে উঠে 'সংঘাত' ও 'সেক্টর ধ্বংস হয়ে যাবে'-মূলক নানা ধরনের কথা। নূ্যনতম মজুরি কাঠামো প্রণয়নের সময় ৩০ দিন কাজের পর একজন শ্রমিকের বেতন তিন হাজার টাকা দেবে- এটা ফয়সালার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের পর মেনে নেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বলেছিলেন, 'আপনারা এক দিনে যে বাজার খরচ করেন, সেই টাকাটা একজন শ্রমিককে মাস শেষে বেতন দেন।' মজার কথা হলো, প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ মেনে নেওয়ার সময়ও উৎসে কর কমানোর শর্ত জুড়ে দিয়ে পরে সেটা আদায়ও করে নেন মালিকরা।
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মন্ত্রীকে বলেছেন, নতুন আইন করার আগে এর ঝুঁকির দিকগুলো খেয়াল রাখতে হবে। কোনো মালিক তা বাস্তবায়ন না করলে তাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এতে এ খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। যেহেতু শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা সরকারের লক্ষ্য নয়, তাই কোনোরূপ সাংঘর্ষিক নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। আগের আইন সংশোধনের উদ্যোগ শ্রমিকদের জন্য অধিকতর অনুকূল মনে হলেও এ শিল্পের সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন।
ওই চিঠির ব্যাপারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শ্রম আইনের বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। আর তৈরি পোশাক শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। হয়তো ওই দুটি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে বিজিএমইএ আমাকে একটি অনুলিপি দিয়েছে। বিষয়টি আমার মনে নেই। তবে পোশাক শিল্পের জন্য আলাদা শ্রম আইন করার দাবিটি একটি বিতর্কিত বিষয়। আর গার্মেন্ট মালিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের সুবিধা নিশ্চিত না করা বা সরকারের কাছ থেকে পোশাক শিল্পের বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।'
শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, কম্পানির মোট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন এবং ১০ শতাংশ কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ও বাকি ১০ শতাংশ সরকারের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু মালিকরা তা না মানায় গত ২৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে শাস্তির বিধান রেখে করা আইনের খসড়া অনুমোদন করে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, শাস্তির ধরন ও পরিমাণ কী হবে, তা নির্ধারণ করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধানসহ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মতামত দিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করবে। তিনি বলেন, অর্জিত মুনাফার একটি অংশ শ্রমিকদের জন্য রাখতে দেশে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন রয়েছে। কিন্তু তহবিলে অর্থ জমা না দিলে শাস্তির বিধান নেই। তাই মালিকরা তা বাস্তবায়ন করছেন না। সে জন্যই আইনটি সংশোধন করে শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.