ক্রিকেট কূটনীতি-২২ গজি সম্পর্কের সেতু by এ কে এম জাকারিয়া
পারভেজ মোশাররফ তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, ২০০৫ সালের ঘটনা। দিল্লিতে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ। সেখানে গিয়ে খেলাটি দেখার শখ মোশাররফের। ভারতের উদ্দেশে খোলাখুলিভাবেই বললেন, আমন্ত্রণ পেলে খেলা দেখতে যেতে চান তিনি। কী করবে ভারত? দুই দেশের সম্পর্ক তখন খুবই খারাপ।
সেখানকার গণমাধ্যমে তখন এ নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। প্রায় মাসখানেক আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর মোশাররফকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। এই ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ খেলা দেখতে মোশাররফের দিল্লি যাওয়াকে ভারত-পাকিস্তান শীর্ষ বৈঠকের রূপ দিয়েছিল। মনমোহন সিং তখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কাশ্মীর সীমান্তে তখন যুদ্ধ-পরিস্থিতি। শীর্ষ বৈঠকে দুই নেতা তখন সেই সীমান্ত খুলে দিতে রাজি হয়েছিলেন।
এবারের উপলক্ষও ক্রিকেট, তবে এবারের এই কূটনীতিকে ক্রিকেট কূটনীতি না বলে ‘মনমোহনীয় কূটনীতি’ হিসেবেই দেখতে চাইছেন অনেকে। কূটনীতি নিয়ে যাদের কাজকারবার সেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকাই ছিল না এতে। এমনকি তারা জানতও না বিষয়টি। এবারের বিশ্বকাপে যখন ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনালের বিষয়টি নিশ্চিত হলো, আর খেলাটিও ভারতে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজের উদ্যোগেই খেলা দেখতে আমন্ত্রণ জানালেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি এই ‘সুযোগ’ গ্রহণ করতে ভুল করেননি। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা জড়িত—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর দুই দেশের যোগাযোগের দরজাটিতে সিটকানি তুলে দেয় ভারত। দীর্ঘদিন পর সেই দরজার অন্তত সিটকানি খুলতে দেশ দুটি একমত হয়েছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ক্রিকেট অথবা ‘মনমোহনীয় কূটনীতি’—যা-ই বলি না কেন, ভারত-পাকিস্তানের খেলা দরজাটি পুরো খোলার একটি সুযোগ এনে দিল। ‘এটা অত্যন্ত সময়োপযোগী একটা সুযোগ। এখানে দুই দেশের সরকার সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারবে যে তারা একসঙ্গে যেমন খেলা দেখতে পারে, তেমনি একই সঙ্গে বসে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ জড়িত।’ ভারত সফরের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার সময় এমন বক্তব্য দিয়ে মনমোহন সিংকে ধন্যবাদ জানান গিলানি। বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থেই এই সুযোগ নিতে চাইছি।’
গিলানি সে সুযোগ নিয়েছেন। মনমোহনের সঙ্গে তিনি মাঠে নেমেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রী হাত মিলিয়েছেন দুই দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। এরপর মহেন্দ্র সিং ধোনি ও শহীদ আফ্রিদি যখন ক্রিকেট লড়াই শুরু করে দিয়েছেন মোহালির মাঠে তখন পাশাপাশি বসে মনমোহন ও গিলানি। ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নানা দিক সরিয়ে রেখে তাঁরা হাত মিলিয়েছেন, দুই দেশের জাতীয় সংগীতের পর তালি বেজেছে দুজনের হাতেই। টিভির পর্দায় ভারতের ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ সোনিয়াকে দেখা গেছে সাধারণ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে, কিন্তু এর আগেই তিনি কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ সেরে এসেছেন গিলানির সঙ্গে। ছিলেন রাহুলও। রাতে নৈশভোজ। পুত্র রাহুলকে নিয়ে সেখানেও উপস্থিত ছিলেন সোনিয়া। মনমোহন ও সোনিয়া দুজনকেই পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানালেন গিলানি। নৈশভোজের ভাষণে আশার কথাই শোনালেন মনমোহন। ‘অতীতের বিদ্বেষ ভুলে আমাদের বর্তমান সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ধৈর্য আছে, ইচ্ছাশক্তিও আছে। এখন আমাদের উচিত পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। একটা স্থায়ী সমাধানের সূত্র বের করা, যাতে আমরা সম্মানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি।’ ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে গিলানিও ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো’ নিয়ে ‘ইতিবাচক’ আলোচনার কথা জানিয়ে গেছেন।
‘ক্রিকেট কূটনীতি’র আপাতত অগ্রগতি এটুকুই। ‘কূটনীতি হচ্ছে দুটি গোষ্ঠী বা দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সমঝোতার একটি আর্ট ও চর্চা’—কূটনীতির একটি সাধারণ সংজ্ঞা অনেকটা এ রকম। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবস্থাটা এমনই যে ‘সাধারণ কূটনীতি’ এখানে সব সময় কাজ করে না। সাধারণ কূটনীতি শুরুর আগে তাই মাঝেমধ্যে ক্রিকেট কূটনীতির ওপর সওয়ার হতে হয়। ২০০৫ সালে মোশাররফ-মনমোহন ক্রিকেট কূটনীতির আগেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে আরও এক দফা ক্রিকেট কূটনীতি হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। সেই কূটনীতির দুই নেতা ছিলেন জিয়াউল হক ও রাজীব গান্ধী। তখনো সীমান্তে দুই দেশের সেনারা ছিল অনেকটা মুখোমুখি অবস্থায়। ক্রিকেট কূটনীতি তখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছিল।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আবার স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে একমত হয় দেশ দুটি। সেই অনুযায়ী মোহালির এই খেলার আগেই সফলভাবে শেষ হয়েছে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক। বৈঠক শুরুর আগেই সবাই জেনে গিয়েছিল যে ভারতে আসছেন গিলানি। বৈঠকের যা ফলাফল তাতে এটা মানতেই হবে যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আসার সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছিল আলোচনায়। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ঘটনা তদন্তে পাকিস্তানে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন পাঠানোর যে প্রস্তাব ভারত অনেক দিন ধরেই দিয়ে আসছিল, তাতে রাজি হয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া হামলার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের কণ্ঠস্বরের নমুনা ভারতকে দেওয়ার ব্যাপারে আদালতের কাছে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে পাকিস্তান। আলোচনার পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে জঙ্গি হামলা নিয়ে দ্রুত তথ্যবিনিময় করতে ‘হটলাইন’ চালুর প্রসঙ্গটিও স্থান পেয়েছে। ভারতের জন্য এগুলো পাকিস্তানের কাছ থেকে বড় পাওয়া। বিনিময়ে ভারতও সমঝোতা এক্সপ্রেসে (ভারতে দিল্লি ও পাকিস্তানের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেন) ২০০৭ সালে ঘটা বিস্ফোরণের ব্যাপারে পাকিস্তানকে তথ্য দিতে রাজি হয়েছে। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ভারতের জেলে বন্দী ২৯ পাকিস্তানি নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে গিলানি ভারত পৌঁছানোর আগেই। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকের পর ভারতে কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়েছে, এমন ইতিবাচক আলোচনা ও যৌথ বিবৃতি সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক আগেই ঠিক করা ছিল, কিন্তু এ ধরনের একটি বৈঠকের পরপরই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কোনো যোগাযোগের বা দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা এর সপ্তাহখানেক আগেও কেউ ভাবেনি। ক্রিকেট সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির কাছে ক্রিকেট পিচের ২২ গজ তো এখন বিবেচিত ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সেতু’ হিসেবে।
ক্রিকেট কূটনীতি নিয়ে যাঁরা আশাবাদী তাঁরা বলছেন, এটা দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার পথ তৈরি করল। এই প্রক্রিয়া অবশ্য আগেই শুরু হয়েছিল। আগের সময়সূচি অনুযায়ী এ মাসেই বাণিজ্যসচিব পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা। এরপর পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে। এসব শেষ হলে পাকিস্তান যাবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মনমোহন-গিলানি আলোচনায় ঠিক হয়েছে আরও কিছু বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল করবে সফরবিনিময়। দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কেও গতি আনতে রাজি হয়েছেন দুজন। মনমোহন ও সোনিয়ার সঙ্গে গিলানির সাক্ষাৎ, নৈশভোজে সোনিয়া ও রাহুলের উপস্থিতি, মনমোহন ও সোনিয়াকে পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রণ—এগুলো সামনের ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বাড়তি প্রভাব ফেলবে, এমন আশা করা কি খুব বেশি হবে? তবে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট কূটনীতি আর নতুন কোনো বিষয় নয়, সে অভিজ্ঞতা বলছে, এই কূটনীতির মেয়াদ খুবই কম। ‘ক্রিকেট কূটনীতি মানে এমন নয় যে একসঙ্গে বসে খেলা দেখলেন আর সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। তবে সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে।’ ক্রিকেট কূটনীতি নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বোধোদয় এমনই। কোনো কূটনীতি যদি সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করে দেয় সেটাই বা কম কিসে!
খেলাকে উপলক্ষ মেনে কূটনীতি নতুন কিছু নয়। টেবিল টেনিস খেলার ‘পিং-পং কূটনীতি’ সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই কূটনীতি তখন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। তবে ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ এখন একান্তই এই উপমহাদেশের একটি বিষয়। ক্রিকেট বিষয়টিই যেন এখন অনেকটা উপমহাদেশীয় হয়ে উঠেছে। ‘ক্রিকেট একটি ভারতীয় খেলা, যা ঘটনাচক্রে আবিষ্কৃত হয়েছে ইংল্যান্ডে। এটা অনেকটা মরিচের মতো, যা আবিষ্কৃত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়, সেখান থেকে ভারতে এসেছিল মধ্যযুগে। এখন ভারতীয় খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ এই মরিচ। ভারতে ক্রিকেটকে বিদেশি খেলা হিসেবে দেখতে পান শুধু ইতিহাসবিদ আর ভারতবিদ্যার বিশেষজ্ঞরা। অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে ক্রিকেট এখন ইংলিশদের চেয়ে বেশি ভারতীয়’ (দ্য তাও অব ক্রিকেট: অন গেমস অব ডেস্টিনি অ্যান্ড দ্য ডেস্টিনি অব গেমস, আশিষ নন্দী)। ভারতের রাজনৈতিক মনোবিশ্লেষক ও সমাজতাত্ত্বিক আশিষ নন্দীর কাছে ক্রিকেট এখন পুরোপুরি ‘ভারতীয়’ খেলা। আমরা আরও একটু উদার হয়ে ক্রিকেটকে ‘উপমহাদেশীয়’ খেলা বলে দাবি করতে পারি। ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ এখন শুধু এই উপমহাদেশে কার্যকর থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাজীব গান্ধী-জিয়াউল হক, বা মনমোহন- মোশাররফ ক্রিকেট কূটনীতির পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের দশা দেখে যাঁরা এই কূটনীতির ওপর খুব ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁদের একটি বিষয় ধরিয়ে দিতে চাই। জিয়াউল হক ও মোশাররফ দুজনই ছিলেন সামরিক শাসক, স্বৈরশাসকও। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। গিলানি ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট কূটনীতিতে জড়ালেন একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এ যাত্রায় কিছু ভিন্ন ফল তো আমরা আশা করতেই পারি।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
এবারের উপলক্ষও ক্রিকেট, তবে এবারের এই কূটনীতিকে ক্রিকেট কূটনীতি না বলে ‘মনমোহনীয় কূটনীতি’ হিসেবেই দেখতে চাইছেন অনেকে। কূটনীতি নিয়ে যাদের কাজকারবার সেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকাই ছিল না এতে। এমনকি তারা জানতও না বিষয়টি। এবারের বিশ্বকাপে যখন ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনালের বিষয়টি নিশ্চিত হলো, আর খেলাটিও ভারতে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজের উদ্যোগেই খেলা দেখতে আমন্ত্রণ জানালেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি এই ‘সুযোগ’ গ্রহণ করতে ভুল করেননি। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা জড়িত—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর দুই দেশের যোগাযোগের দরজাটিতে সিটকানি তুলে দেয় ভারত। দীর্ঘদিন পর সেই দরজার অন্তত সিটকানি খুলতে দেশ দুটি একমত হয়েছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ক্রিকেট অথবা ‘মনমোহনীয় কূটনীতি’—যা-ই বলি না কেন, ভারত-পাকিস্তানের খেলা দরজাটি পুরো খোলার একটি সুযোগ এনে দিল। ‘এটা অত্যন্ত সময়োপযোগী একটা সুযোগ। এখানে দুই দেশের সরকার সারা দুনিয়াকে দেখাতে পারবে যে তারা একসঙ্গে যেমন খেলা দেখতে পারে, তেমনি একই সঙ্গে বসে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ জড়িত।’ ভারত সফরের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার সময় এমন বক্তব্য দিয়ে মনমোহন সিংকে ধন্যবাদ জানান গিলানি। বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থেই এই সুযোগ নিতে চাইছি।’
গিলানি সে সুযোগ নিয়েছেন। মনমোহনের সঙ্গে তিনি মাঠে নেমেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রী হাত মিলিয়েছেন দুই দেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। এরপর মহেন্দ্র সিং ধোনি ও শহীদ আফ্রিদি যখন ক্রিকেট লড়াই শুরু করে দিয়েছেন মোহালির মাঠে তখন পাশাপাশি বসে মনমোহন ও গিলানি। ভারত-পাকিস্তান বিরোধের নানা দিক সরিয়ে রেখে তাঁরা হাত মিলিয়েছেন, দুই দেশের জাতীয় সংগীতের পর তালি বেজেছে দুজনের হাতেই। টিভির পর্দায় ভারতের ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ সোনিয়াকে দেখা গেছে সাধারণ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে, কিন্তু এর আগেই তিনি কথাবার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ সেরে এসেছেন গিলানির সঙ্গে। ছিলেন রাহুলও। রাতে নৈশভোজ। পুত্র রাহুলকে নিয়ে সেখানেও উপস্থিত ছিলেন সোনিয়া। মনমোহন ও সোনিয়া দুজনকেই পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানালেন গিলানি। নৈশভোজের ভাষণে আশার কথাই শোনালেন মনমোহন। ‘অতীতের বিদ্বেষ ভুলে আমাদের বর্তমান সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ধৈর্য আছে, ইচ্ছাশক্তিও আছে। এখন আমাদের উচিত পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। একটা স্থায়ী সমাধানের সূত্র বের করা, যাতে আমরা সম্মানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারি।’ ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে গিলানিও ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলো’ নিয়ে ‘ইতিবাচক’ আলোচনার কথা জানিয়ে গেছেন।
‘ক্রিকেট কূটনীতি’র আপাতত অগ্রগতি এটুকুই। ‘কূটনীতি হচ্ছে দুটি গোষ্ঠী বা দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সমঝোতার একটি আর্ট ও চর্চা’—কূটনীতির একটি সাধারণ সংজ্ঞা অনেকটা এ রকম। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবস্থাটা এমনই যে ‘সাধারণ কূটনীতি’ এখানে সব সময় কাজ করে না। সাধারণ কূটনীতি শুরুর আগে তাই মাঝেমধ্যে ক্রিকেট কূটনীতির ওপর সওয়ার হতে হয়। ২০০৫ সালে মোশাররফ-মনমোহন ক্রিকেট কূটনীতির আগেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে আরও এক দফা ক্রিকেট কূটনীতি হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। সেই কূটনীতির দুই নেতা ছিলেন জিয়াউল হক ও রাজীব গান্ধী। তখনো সীমান্তে দুই দেশের সেনারা ছিল অনেকটা মুখোমুখি অবস্থায়। ক্রিকেট কূটনীতি তখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছিল।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আবার স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে একমত হয় দেশ দুটি। সেই অনুযায়ী মোহালির এই খেলার আগেই সফলভাবে শেষ হয়েছে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক। বৈঠক শুরুর আগেই সবাই জেনে গিয়েছিল যে ভারতে আসছেন গিলানি। বৈঠকের যা ফলাফল তাতে এটা মানতেই হবে যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আসার সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছিল আলোচনায়। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার ঘটনা তদন্তে পাকিস্তানে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন পাঠানোর যে প্রস্তাব ভারত অনেক দিন ধরেই দিয়ে আসছিল, তাতে রাজি হয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া হামলার সঙ্গে জড়িত পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়া জঙ্গিদের কণ্ঠস্বরের নমুনা ভারতকে দেওয়ার ব্যাপারে আদালতের কাছে যাওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে পাকিস্তান। আলোচনার পর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে জঙ্গি হামলা নিয়ে দ্রুত তথ্যবিনিময় করতে ‘হটলাইন’ চালুর প্রসঙ্গটিও স্থান পেয়েছে। ভারতের জন্য এগুলো পাকিস্তানের কাছ থেকে বড় পাওয়া। বিনিময়ে ভারতও সমঝোতা এক্সপ্রেসে (ভারতে দিল্লি ও পাকিস্তানের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেন) ২০০৭ সালে ঘটা বিস্ফোরণের ব্যাপারে পাকিস্তানকে তথ্য দিতে রাজি হয়েছে। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ভারতের জেলে বন্দী ২৯ পাকিস্তানি নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে গিলানি ভারত পৌঁছানোর আগেই। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকের পর ভারতে কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়েছে, এমন ইতিবাচক আলোচনা ও যৌথ বিবৃতি সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি। সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক আগেই ঠিক করা ছিল, কিন্তু এ ধরনের একটি বৈঠকের পরপরই সরাসরি প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কোনো যোগাযোগের বা দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা এর সপ্তাহখানেক আগেও কেউ ভাবেনি। ক্রিকেট সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির কাছে ক্রিকেট পিচের ২২ গজ তো এখন বিবেচিত ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সেতু’ হিসেবে।
ক্রিকেট কূটনীতি নিয়ে যাঁরা আশাবাদী তাঁরা বলছেন, এটা দীর্ঘমেয়াদি আলোচনার পথ তৈরি করল। এই প্রক্রিয়া অবশ্য আগেই শুরু হয়েছিল। আগের সময়সূচি অনুযায়ী এ মাসেই বাণিজ্যসচিব পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা। এরপর পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে। এসব শেষ হলে পাকিস্তান যাবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মনমোহন-গিলানি আলোচনায় ঠিক হয়েছে আরও কিছু বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল করবে সফরবিনিময়। দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কেও গতি আনতে রাজি হয়েছেন দুজন। মনমোহন ও সোনিয়ার সঙ্গে গিলানির সাক্ষাৎ, নৈশভোজে সোনিয়া ও রাহুলের উপস্থিতি, মনমোহন ও সোনিয়াকে পাকিস্তান সফরে আমন্ত্রণ—এগুলো সামনের ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বাড়তি প্রভাব ফেলবে, এমন আশা করা কি খুব বেশি হবে? তবে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট কূটনীতি আর নতুন কোনো বিষয় নয়, সে অভিজ্ঞতা বলছে, এই কূটনীতির মেয়াদ খুবই কম। ‘ক্রিকেট কূটনীতি মানে এমন নয় যে একসঙ্গে বসে খেলা দেখলেন আর সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। তবে সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করতে পারে।’ ক্রিকেট কূটনীতি নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের বোধোদয় এমনই। কোনো কূটনীতি যদি সমস্যা সমাধানের পথ তৈরি করে দেয় সেটাই বা কম কিসে!
খেলাকে উপলক্ষ মেনে কূটনীতি নতুন কিছু নয়। টেবিল টেনিস খেলার ‘পিং-পং কূটনীতি’ সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। এই কূটনীতি তখন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। তবে ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ এখন একান্তই এই উপমহাদেশের একটি বিষয়। ক্রিকেট বিষয়টিই যেন এখন অনেকটা উপমহাদেশীয় হয়ে উঠেছে। ‘ক্রিকেট একটি ভারতীয় খেলা, যা ঘটনাচক্রে আবিষ্কৃত হয়েছে ইংল্যান্ডে। এটা অনেকটা মরিচের মতো, যা আবিষ্কৃত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়, সেখান থেকে ভারতে এসেছিল মধ্যযুগে। এখন ভারতীয় খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ এই মরিচ। ভারতে ক্রিকেটকে বিদেশি খেলা হিসেবে দেখতে পান শুধু ইতিহাসবিদ আর ভারতবিদ্যার বিশেষজ্ঞরা। অধিকাংশ ভারতীয়র কাছে ক্রিকেট এখন ইংলিশদের চেয়ে বেশি ভারতীয়’ (দ্য তাও অব ক্রিকেট: অন গেমস অব ডেস্টিনি অ্যান্ড দ্য ডেস্টিনি অব গেমস, আশিষ নন্দী)। ভারতের রাজনৈতিক মনোবিশ্লেষক ও সমাজতাত্ত্বিক আশিষ নন্দীর কাছে ক্রিকেট এখন পুরোপুরি ‘ভারতীয়’ খেলা। আমরা আরও একটু উদার হয়ে ক্রিকেটকে ‘উপমহাদেশীয়’ খেলা বলে দাবি করতে পারি। ‘ক্রিকেট কূটনীতি’ এখন শুধু এই উপমহাদেশে কার্যকর থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। রাজীব গান্ধী-জিয়াউল হক, বা মনমোহন- মোশাররফ ক্রিকেট কূটনীতির পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের দশা দেখে যাঁরা এই কূটনীতির ওপর খুব ভরসা রাখতে পারছেন না তাঁদের একটি বিষয় ধরিয়ে দিতে চাই। জিয়াউল হক ও মোশাররফ দুজনই ছিলেন সামরিক শাসক, স্বৈরশাসকও। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। গিলানি ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট কূটনীতিতে জড়ালেন একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এ যাত্রায় কিছু ভিন্ন ফল তো আমরা আশা করতেই পারি।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments