সাকা চৌধুরীর বিচার শুরু

বিএনপির নেতা ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল বুধবার তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগ গঠন করেছেন। ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের উদ্বোধনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।


এই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১-এ দ্বিতীয় মামলার বিচার শুরু হলো। এর আগে গত বছরের ৩ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার শুরু হয়।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না—এ বিষয়ে আদেশের জন্য গতকাল দিন ধার্য থাকায় সকাল ১০টার দিকে তাঁকে কাশিমপুর কারাগার থেকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে হাজতখানা থেকে দোতলায় এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়া হয়।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক এবং এ কে এম জহির আহমেদ। বেলা ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশ দেওয়া শুরু করেন। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আদেশ পড়ে শোনান।
আদেশ: আদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাকা চৌধুরীর বিচার-প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপট ও তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২০১০ সালের ২ নভেম্বর আসামিকে প্রথম ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এরপর থেকে প্রয়োজন অনুসারে তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। অনেক সময় তিনি চিৎকার করে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন। প্রথমদিকে তিনি আইনজীবী নিয়োগ দিলেও পরে আইনজীবীদের ওকালতনামা বাতিল করে নিজেই শুনানি করেন। পরে আবার তিনি ওকালতনামা দাখিলের মাধ্যমে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন। ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করার পর প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে ১৭ নভেম্বর অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হচ্ছে। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, সাক্ষীদের জবানবন্দি, সংশ্লিষ্ট নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল মনে করেন, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ভিত্তি রয়েছে। এরপর ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে পড়ে শোনান।
অভিযোগ পড়া শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীর কাছে জানতে চান, আপনি দোষী না নির্দোষ? কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাকা চৌধুরী পাল্টা প্রশ্ন করেন, কিসের দোষে? ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগের। সাকা চৌধুরী আবার প্রশ্ন করেন, কোন অভিযোগের? ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়েছে। সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি শুনিনি। আমাকে আদেশের অনুলিপি দেবেন, পড়ে বলব।’
ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে আর কোনো প্রশ্ন না করে বলেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে আপনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আদেশের শেষে ট্রাইব্যুনাল ২৯ এপ্রিল এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রারম্ভিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ-প্রক্রিয়া শুরুর দিন ধার্য করেন।
প্রতিক্রিয়া: ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম সাংবাদিকদের বলেন, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত। ট্রাইব্যুনালের নির্ধারিত দিনে প্রারম্ভিক বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে।
তবে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলাম আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ট্রাইব্যুনাল জোর করে অবৈধভাবে অভিযোগ গঠন করেছেন। ২০০৯ সালে সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইন একাত্তরে সংঘটিত অপরাধ বিচারের জন্য কার্যকর হতে পারে না।
এজলাসকক্ষের পরিবেশ: সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হবে কি না—এ বিষয়ে জানতে সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের ভিড় বাড়তে থাকে। কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এজলাসে বসার জায়গা খালি ছিল না। অনেককে দাঁড়িয়েই আদেশ শুনতে হয়েছে। আসামির কাঠগড়ায় বসা সাকা চৌধুরীও বেশির ভাগ সময়ই হাসিখুশি ছিলেন। তবে মাঝে-মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলেছেন ও তর্ক করেছেন। এজলাসে সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগের রাতে সাকা চৌধুরীকে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৩০ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে তাঁকে প্রথম ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ২০১১ সালের ২ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা ১৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ১৭ নভেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর প্রায় চার মাস ধরে অভিযোগের বিষয়ে শুনানির পর গতকাল ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
আইনজীবীর তর্ক, সাকা চৌধুরীর চিৎকার, বিরক্ত ট্রাইব্যুনাল: গতকাল ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলাকালে কয়েক দফায় এজলাসের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাকা চৌধুরীর আইনজীবী কয়েক দফায় ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে বাদানুবাদ, আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাকা চৌধুরীর উচ্চ স্বরের বক্তব্য ও এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির প্রতিবাদ—সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালের পরিবেশ ছিল উত্তেজনাকর।
গতকাল কার্যক্রমের শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ গত সোমবার প্রথম আলো, ইনকিলাব, যুগান্তরসহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের নজরে আনেন। তিনি বলেন, বিএনপির নেতা এম কে আনোয়ার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, এ ট্রাইব্যুনাল জঙ্গলের শাসনের চেয়েও খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ধরনের বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের জন্য অবমাননাকর। এম কে আনোয়ারের মতো মানুষ যদি এ কথা বলেন, এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে? তিনি প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ট্রাইব্যুনালকে পড়ে শোনান।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বিষয় বেলা দুইটার সময় শোনা হবে। এরপর সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলাম বলেন, তাঁর মক্কেলের পক্ষে কয়েকটি আবেদন আছে। এগুলোর শুনানি করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বলেন, কার্যতালিকায় প্রথমে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আদেশের বিষয়টি রয়েছে। এ আদেশ দেওয়ার পর ওইসব আবেদনের শুনানি হবে। ফখরুল ইসলাম বলেন, আগে আবেদন শুনতে হবে। পরে আদেশ দেবেন।
ট্রাইব্যুনাল আইনজীবীকে বসতে বললেও তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আজ আদেশ দেবেন দেশের কোনো মন্ত্রী এই বিচার নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। এ সময় সাকা চৌধুরীও উচ্চ স্বরে কথা বলতে শুরু করেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, কার্যক্রমের সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না। অবমাননাকর কোনো কথা বলতে পারেন না।
সাকা চৌধুরী বলেন, গাড়ি রওনা হওয়ার পর চড়লে তো হবে না। আপনাকে প্রথমে আমার আবেদন শুনতে হবে। এখন যদি কেউ ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে কি দোষ দেওয়া যায়? ট্রাইব্যুনাল আদেশ দেওয়া শুরু করলে এই কথোপকথন বন্ধ হয়।
বেলা দুইটায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আবার শুরু হলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম বলেন, এম কে আনোয়ারের মন্তব্যে মানুষের মনে বিভ্রান্তি হয়েছে ও হচ্ছে। এটি যেকোনো মূল্যে বিচার-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার নামান্তর। ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা রক্ষায় আইনের ১১(৪) ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, যাঁরা বাইরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা আইন পড়ে দেখেননি। আইন সম্পর্কে না জেনে কথা বলা অপ্রত্যাশিত। এম কে আনোয়ার একজন সম্মানীয় ও শিক্ষিত লোক। তিনি একজন সাংসদ, সাবেক মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন। কিন্তু ওনার মাথায় ফৌজদারি কার্যবিধি ঢুকে আছে।
এ সময় কাঠগড়ায় বসা সাকা চৌধুরী তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেন, ‘জাঙ্গল ল, এ ধরনের কথা কেউ বলতে পারে? স্যার, জেলে দিয়ে দেন।’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আইনের সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সাকা চৌধুরী বলেন, আমার সব বন্ধুর একই অভ্যাস। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কী বলেছেন, তা-ও দেখেন।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ ট্রাইব্যুনালে ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য নয়। ট্রাইব্যুনালের প্রত্যাশা, এম কে আনোয়ারের মতো মানুষ ও অন্য সবাই ট্রাইব্যুনালের সুষ্ঠু কার্যক্রমে সহায়তা করবেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন।
পরে ফখরুল ইসলাম সাকা চৌধুরীর পক্ষে করা কয়েকটি আবেদনের ওপর শুনানি শুরু করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন বাদ দেওয়া হয়েছে। এই আইন ছিল ১৯৫ পাকিস্তানি সেনার বিচারের জন্য। ২০০৯ সালে সংশোধিত এই আইনে আরও অনেক কিছু ঢুকে গেছে। এর কিছু ধারা সংবিধানে দেওয়া মৌলিক নাগরিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সুষ্ঠু বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এগুলো পুরোনো বিষয়। এ নিয়ে আগেই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
ফখরুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আপনি কোনো কথাই শুনছেন না। বারবার বলছেন পুরোনো বিষয় বলে লাভ হবে না। তাহলে ওয়াকআউট করি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওয়াকআউট করতে চান? করেন। কিন্তু এমন কিছু করবেন না, যাতে ট্রাইব্যুনালকে অবমাননা করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে ফখরুল বলেন, আপনি সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক। ওয়াকআউট করব বলায়, আপনি হুমকি দিচ্ছেন। এত অধৈর্য হলে চলবে না।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনিও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আপনি কী ভাষায় কথা বলেছেন? পুনর্বিবেচনার আবেদনে সন্তুষ্ট হলে মঞ্জুর করা হবে। কিন্তু জোর করবেন না, স্বাভাবিক পথে এগোন।
এর পরে এই মামলার কার্যক্রম ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.