গাজীপুরে এক মাসে ১৮ লাশ by মাসুদ রানা

গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর উপজেলা থেকে জানুয়ারি মাসে ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১০ জনের পরিচয় বের করতে পারেনি পুলিশ। শুধু কালিয়াকৈরেই পাওয়া গেছে ১০টি লাশ। দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


ওই তিন উপজেলায় গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২২ জনের লাশ উদ্ধার হয়। আর বিভিন্ন থানায় ৪২টি অপহরণ ও নিখোঁজ মামলা হয়।
এক মাসে ১৮ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে প্রায়ই লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মহাসড়ক ও শাখা সড়কগুলোতে পুলিশ যদি ভালো করে নজরদারি রাখে, তবে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব।
তবে এ ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হিসেবে দেখছেন না পুলিশ সুপার আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, এত লাশ গাজীপুরে উদ্ধার হয়নি।’
কালিয়াকৈরে ১০ লাশ: কালিয়াকৈর থানার পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১ জানুয়ারি উপজেলার সাহাবাজপুরে রাস্তার পাশের জঙ্গলে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর (২৫) লাশ পাওয়া যায়। তরুণীর গলায় ওড়না পেঁচানো ছিল। ৪ জানুয়ারি কালিয়াকৈরের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায় তিনজনের লাশ। এর মধ্যে হাত-পা বাঁধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় এক যুবকের (৩০) লাশ পাওয়া যায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে হাইটেক পার্কের সামনে। কালিয়াকৈর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল হালিম বলেন, পরিবারের লোকজন লাশটি সাদ্দাম হোসেনের বলে শনাক্ত করেন। সাদ্দাম ট্রাক চালাতেন। তাঁকে হত্যার পর সহযোগীসহ অন্যরা ট্রাকটি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ ট্রাকটি কুমিল্লা থেকে উদ্ধার করে।
একই দিন খাড়াজোড়া এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় এক বৃদ্ধ (৬০) ও গলাচিপা এলাকার গজারি বন থেকে গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় প্রদীপ (২৫) নামের এক তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়। প্রদীপের মোটরসাইকেলের লোভে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে তাঁরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়।
১৩ জানুয়ারি চন্দ্রার গজারি বন থেকে গলায় ওড়না পেঁচানো তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ জানুয়ারি ফুলবাড়িয়া দক্ষিণপাড়ার সড়কের পাশের বনে পাওয়া যায় এক বৃদ্ধের লাশ। পরদিন পূর্ব চান্দরা এলাকার রেললাইনের পাশে এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিনে রতনপুর রেলস্টেশন এলাকায় পাওয়া যায় এক কিশোরের লাশ।
রেলওয়ে পুলিশের ভাষ্যমতে, ওই দুজনের মৃতদেহ ট্রেনে কাটা ছিল না। সম্ভবত তাদের শ্বাসরোধে হত্যার পর রেললাইনের পাশে ফেলে রেখে যায়।
১৮ জানুয়ারি উত্তর হিজলতলী গ্রামের পরিমন নেছার গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। জমি নিয়ে বিরোধে ওই বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা।
২৫ জানুয়ারি আনসার একাডেমির পশ্চিম পাশের গজারি বন থেকে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় পোশাকশ্রমিক রোজিনা খাতুনের লাশ উদ্ধার হয়।
কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক লাশ উদ্ধার করা হলেও সবগুলোর ঘটনা কালিয়াকৈরে ঘটেনি। দুর্বৃত্তরা অন্যত্র হত্যা করে লাশ কালিয়াকৈরের সীমানায় ফেলে গেছে।
সদর উপজেলায় সাত লাশ: টঙ্গী থানার পুলিশ সূত্র জানায়, ১ জানুয়ারি ভোরে সদর উপজেলার টঙ্গীর মধুমিতা রেলগেট এলাকায় কয়েকজন ছিনতাইকারী ব্র্যাক কর্মকর্তা আবু জাহিদ সরকারকে (৫৫) ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। কুমিল্লার দাউদকান্দি যাওয়ার উদ্দেশে তিনি হেঁটে টঙ্গী রেলস্টেশনের দিকে যাচ্ছিলেন।
১২ জানুয়ারি উপজেলার ধীরাশ্রম রেল ক্রসিংয়ের পাশে একটি পরিত্যক্ত কক্ষে রডের সঙ্গে ঝুলানো অবস্থায় এক তরুণের লাশ পাওয়া যায়। ১৪ জানুয়ারি টঙ্গীর আমতলী কেরানিরটেক রেললাইনের পাশে একটি ডোবা থেকে এক নারীর দুই টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ জানুয়ারি সদরের হায়দরাবাদ এলাকায় প্রকাশ্যে মো. সুজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সুজনের বাড়ি সদরের সাহাপাড়ায়। ২১ জানুয়ারি ভবানীপুর এলাকার একটি কালভার্টের পাশে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় পাওয়া যায় এক তরুণীর লাশ।
হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সৈয়দ আজহারুল ইসলাম বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধারের পর নিহত ব্যক্তির ছবি তুলে আশপাশের জেলার থানায় পাঠানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অপরাধীরাও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
২৮ জানুয়ারি টঙ্গীর আউচপাড়ার একটি ভাড়া বাসা থেকে পোশাকশ্রমিক আবদুল হান্নানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যার অভিযোগে পুলিশ তাঁর স্ত্রী সাজেদাকে গ্রেপ্তার করে।
একই দিন কুমারখাদা এলাকার গজারি বনে এক তরুণীকে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এ ছাড়া ২০ জানুয়ারি শ্রীপুরের মাধখলা গ্রামের গজারি বন থেকে খোকা নামের এক ব্যক্তির গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, দুর্বৃত্তরা যাতে গাজীপুরে লাশ ফেলে পালাতে না পারে, এ জন্য সড়কগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।
অপহরণ ও নিখোঁজ মামলা: জয়দেবপুর, টঙ্গী, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর থানায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ৪২টি অপহরণ ও নিখোঁজ মামলা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গাজীপুরে জমিজমার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জমি নিয়ে বিরোধ হচ্ছে বেশি। অপহরণ ও নিখোঁজ মামলাগুলো তদন্ত করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অপহরণ মামলা করা হয়। পরে আবার নিজ থেকেই অপহূত ব্যক্তি উদ্ধার হচ্ছেন। এ ছাড়া প্রেমঘটিত ব্যাপারও আছে।

No comments

Powered by Blogger.