বাংলাদেশের রাজনীতি এবং দ্য আর্ট অব বি্লঙ্কিং-সমকালীন প্রসঙ্গ by ইমতিয়াজ আহমেদ

আর্ট অব বি্লঙ্কিং হচ্ছে এই বিষয়টি জানা যে কখন জ্বলে উঠতে হয়, আর কখন নিভতে হয়। কোনো রাজনৈতিক দল কখন কোন পদ্ধতিতে জ্বলে উঠবে, তার ওপর জয়-পরাজয় নির্ভর করে। নির্ভর করে দেশের স্থিতিশীলতাও। রাজনৈতিক দল যদি সময়মতো নিভে যাওয়া বা পশ্চাদপসরণের কৌশল না জানে,


তাহলে দেখা যাবে 'শান্তি রক্ষা' করতে দাপটের সঙ্গে দৃশ্যপটে ঢুকে পড়েছে তৃতীয় শক্তি মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সেই বিখ্যাত উক্তি আমরা জানি_ আই ফর আই মেকস দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড। চোখের বদলে চোখ নেওয়ার রীতি গোটা দুনিয়ারই আলো নিভিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি গান্ধীজির সেই বাণীই যেন মূর্ত করে তোলে। খুব সম্প্রতি সেটার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল।
বিরোধী দল বিএনপি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে একটি গণমিছিল আহ্বান করেছিল প্রায় ২০ দিন আগে চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউন্ডের এক জনসভা থেকে। কয়েক মাস ধরে দলটি ঢাকা থেকে চারটি মহানগর সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম_ রোডমার্চ সম্পন্ন করেছিল। তাতে জনসমাগমও ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই আমেজ রাজধানীতে প্রদর্শনের জন্যই গণমিছিলের মতো কর্মসূচি। কিন্তু প্রথমে সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা এবং পরে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করলে কর্মসূচিটি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। পরে একই দিনে সমাবেশের ডাক দেয় মহানগর আওয়ামী লীগ। পুলিশ রাজধানী ও চারটি মহানগরে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
বিএনপি নেতৃত্ব তাদের ঢাকা ও চার মহানগরের কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে দেয়। বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়। বিএনপি দাবি করে তারা তাদের কর্মী ও সমর্থক। পরদিন রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক জামায়াত কর্মী প্রাণ হারায়। আওয়ামী লীগও তাদের সমাবেশ পিছিয়ে দেয় বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। নানা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পরদিন ঢাকায় বিরোধী দলের গণমিছিল এবং সরকারি দলের সমাবেশ নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়। দুই পক্ষের পারস্পরিক দোষারোপ অবশ্য এখনও চলছে।
এই পাল্টাপাল্টি আমাদের অন্তত তিনটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথমত, রাজনীতি কেন রাস্তায় নেমে এলো। দ্বিতীয়ত, সরকারের মেয়াদ দুই বছর বাকি থাকতেই কেন ক্ষমতা প্রত্যাশী দুই প্রধান রাজনৈতিক দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল? তৃতীয়ত, চারজন কর্মী-সমর্থক প্রাণ হারানোর পরও ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচি কেন শান্তিপূর্ণ ছিল? এ ধরনের পরিস্থিতিতে তো আমরা জ্বালাও-পোড়াও দেখেই অভ্যস্ত।
তার মানে, ইংরেজিতে বললে, বিএনপি কি বি্লঙ্ক করেছে। বাধা পেয়ে আরও জ্বলে ওঠার বদলে কি কৌশলগত কারণে নিভে গেছে? বাধা ঠেলে অগ্রসর হওয়ার বদলে কি সাময়িক পশ্চাদপসরণ করেছে। অনেকটা লেনিনের ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক। রাজনীতিতে এ ধরনের নজির কম নয়। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশে নানা সময়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সাময়িক পশ্চাদপসরণ দেখা গেছে। আসলে কখনও কখনও বি্লঙ্ক করতে হয়। এক পক্ষকে সাময়িক পিছিয়ে যেতে হয়। কোনো পক্ষই ছাড় না দিলে দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো পক্ষই বি্লঙ্ক না করলে কী দাঁড়ায়, তার প্রমাণ আমরা ওয়ান-ইলেভেনে পেয়েছি। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ঢুকে পড়ে তৃতীয় পক্ষ।
এবার চূড়ান্ত অর্থে কোনো পক্ষ বি্লঙ্ক করবে, না তৃতীয় পক্ষের জন্য পথ খুলে দেবে, সে আলোচনার আগে প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
রাজনীতি রাস্তায় নেমে এসেছে কেন? এর উত্তর সবাই সহজেই দেবে_ সংসদ অকার্যকর। সংসদ কেন অকার্যকর? বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। সংসদে না যাওয়ার পেছনে দলগতভাবে বিএনপির অনেক যুক্তি রয়েছে। যুক্তি রয়েছে সরকারি দলের পক্ষেও। বাস্তবে আমরা দেখছি, জাতীয় সংসদ আসলে দু'জনের হয়ে গেছে। সংসদ সদস্যরা কী অবস্থান নেবেন, সেটা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছানির্ভর হয়ে পড়েছে। এর জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের দোহাই দেওয়া হয়। বলা হয়, ওই অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের হাত-পা বাঁধা। অথচ সেখানে কিন্তু সমালোচনা করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আসল কথা হচ্ছে, দুই দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রের অভাব। যে কারণে সংসদের আলোচনা লাইভলি হয় না। দলের ভেতরে চুপ থাকায় অভ্যস্ত নেতারা সংসদেও কথা বলতে চান না। দুই নেত্রী মিলে কতক্ষণ কথা বলবেন। কতক্ষণ বিতর্ক চালিয়ে যাবেন। ফলে একজন সংসদের বাইরে চলে আসেন। এই সংসদেই প্রথম নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর গত চারটি সংসদেই দেখা গেছে বিরোধী দল সংসদে যোগদান ও কথা বলার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। সরকারি দল যদিও সংসদে থাকে, বস্তুত মুখ রক্ষার জন্য থাকতে হয়; তাদের সংসদ সদস্যরাও কথা বলেন না। ঘুরেফিরে ৮-১০ জন সিনিয়র সংসদ সদস্যই কথা বলেন। অনেক সময় দেখা গেছে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বা বাজেট আলোচনার সময় সবাইকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বা এলাকার সমস্যা তুলে ধরতে গিয়ে সংসদ সদস্য তার বরাদ্দ সময় শেষ করে ফেলেছেন। সংসদে কথা বলার জন্য সংসদ সদস্যরা হোমওয়ার্ক করেন বলেও মনে হয় না। এখন, সংসদ প্রাণবন্ত হয় না বলেই রাজনীতি রাস্তায় চলে আসে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেবল বিরোধী দল নয়, সরকারি দলও এখন সংসদ বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। কেন? সরকার পক্ষের কেউ কেউ মনে করছেন, রাজপথের দখল বিরোধী দল নিলে তাদের অসুবিধা হবে। এতে করে সরকারি দলের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। জনগণও মনে করতে পারে যে সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। ফলে বিরোধী দলকে প্রতিহত করার জন্য সরকারি দল রাজপথে নেমে আসে। বিরোধী দলের মতোই মিছিল-সমাবেশকে শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়।
রাজনীতি রাজপথে চলে আসার আরেকটি কারণ হচ্ছে রাজনীতির নতুন চরিত্র। তা হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র এবং কর্মীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল। এ দেশে রাজনীতি করতে হলে এখন বিশাল কর্মীবাহিনী পুষতে হয়। কিন্তু তাদের সক্রিয় রাখার জন্য গঠনমূলক কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। আবার কর্মীদের তো সংসদে নিয়ে গিয়ে সক্রিয় রাখা যায় না। রাজপথে কর্মসূচি না থাকলে কর্মীরাও মনে করে যে রাজনীতিতে তার আর কিছু করার নেই। ফলে কর্মীদের রাস্তায় নামানোটা রাজনৈতিক দলের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর আগে থেকেই কেন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলে উত্তেজনা দেখা দিল। এর একটি বড় কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। উচ্চ আদালতের রায়ের পর বর্তমান সরকার ওই ব্যবস্থা বাতিল করে। এ বিষয়টিও রাজনৈতিক অনুসন্ধিৎসুদের জন্য মজার। আমাদের মনে আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছিল তৎকালীন বিরোধী দলের; কিন্তু ফর্মুলা ছিল সরকারের। বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে সরকার তা বাস্তবায়ন করে। বিরোধী দল তা মেনে নিয়েছিল।
এখন দেখা যাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার বিধান রাখা হয়েছে, সেখানে ম্যানিপুলেশনের সুযোগ রয়েছে। তার পরিণতি হিসেবে এসেছিল বহুল আলোচিত ওয়ান-ইলেভেন। তার মানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ঠিক থাকলেও ট্যাকটিকের দিক থেকে ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ধারণাগত দিক থেকে সঠিক হলেও পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল। এখন তো বিচার বিভাগেরও কেউ কেউ বলছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে জড়িয়ে দেওয়ায় বিচার বিভাগের রাজনীতিকীকরণে সুযোগ অবারিত হয়েছে। তারা রেহাই চান।
আরও কথা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কি বাতিল হয়েছে, না আগের ফর্ম বাতিল হয়েছে? পূর্ণাঙ্গ রায় এখনও পাওয়া যায়নি; যতদূর জানা যাচ্ছে, আদালত বলেছেন যে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে। সরকারি দল বিরোধী দলকে সংসদে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলছে যে, তারা সংসদে ফিরলে সব বিষয় সেখানে আলোচনা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, আগের ফর্মের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে যে রাজনৈতিক দলকে আবার জেল-জুলুম করবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আমার ধারণা, ক্ষমতাসীন দল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নতুন ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আভাস দিচ্ছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, সেটা আসলে কী?
এবার তৃতীয় প্রশ্ন নিয়ে কথা বলা যাক। চারজন মারা যাওয়ার পরও বিরোধী দলের রাজনীতি কেন ততটা উত্তপ্ত নয়? এটা কি আর্ট অব বি্লঙ্কিং? আমার মনে হয়, বিএনপি এখনই রাজপথের শেষ খেলা খেলতে চায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি তারা টেনে সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যন্ত নিতে চায়। তখন যদি সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালে বাধ্য হয়, তাতে করে নির্বাচনের আগেই তাদের এক দফা জয় হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির জয়-পরাজয় নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের ওপর। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যদি আর্ট অব বি্লঙ্কিং জেনে থাকে, তাহলে উচিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি মেয়াদ শেষের এক বছর আগেই নিষ্পত্তি করে ফেলা। দুই বছরের মাথায় গিয়ে মেনে নিতে হলে তা দৃশ্যত সরকারি দলের রাজনৈতিক পরাজয় হবে। জনগণও তাই মনে করবে।
আর্ট অব বি্লঙ্কিং হচ্ছে এই বিষয়টি জানা যে কখন জ্বলে উঠতে হয়, আর কখন নিভতে হয়। কোনো রাজনৈতিক দল কখন কোন পদ্ধতিতে জ্বলে উঠবে, তার ওপর জয়-পরাজয় নির্ভর করে। নির্ভর করে দেশের স্থিতিশীলতাও। রাজনৈতিক দল যদি সময়মতো নিভে যাওয়া বা পশ্চাদপসরণের কৌশল না জানে, তাহলে দেখা যাবে 'শান্তি রক্ষা' করতে দাপটের সঙ্গে দৃশ্যপটে ঢুকে পড়েছে তৃতীয় শক্তি।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.