পুলিশ যে ব্যাধিতে আক্রান্ত by এ কে এম শাহনাওয়াজ
ধআমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি কী কী ধরনের ক্ষতির কারণ ঘটাচ্ছে তা নিয়ে ভাবছিলাম। বর্তমান ধারার ক্যাম্পাস ছাত্ররাজনীতিতে দায়িত্বহীন ছাত্রছাত্রীরা যে অসংস্কৃত ভাষা ও শব্দের স্লোগানে জঙ্গি মিছিল করে থাকে, আইন পেশায় যুক্ত দায়িত্ববান আইনজীবীরা যখন ঠিক তেমন শব্দে ও বডিল্যাংগুয়েজে তারই স্থূল প্রকাশ আদালতের পবিত্র অঙ্গনে ঘটান, তখন সচেতন বিবেক আহত না হয়ে পারে না। ভাবছিলাম, এ বিষয়টিকে উপজীব্য করে কালের কণ্ঠের জন্য এবারের লেখাটি তৈরি করব।
কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত এত ঘটন-অঘটনের মঞ্চায়ন হচ্ছে যে একটি বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে না ভাবতেই আরেকটি প্লট ভাবনায় এসে জায়গা করে নিচ্ছে।
শিক্ষক লাউঞ্জে এমনি বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল। আমার এক সহকর্মী দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। উপর্যুপরি পুলিশ-র্যাবের কতগুলো আমানবিক আচরণের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী লক্ষ করেছে। তাঁর মন্তব্য, পুলিশ কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে, নিজেদের অন্যায় ঢাকতে_অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা মিথ্যার গল্প সাজাচ্ছে আর এভাবে নিজেরা আইনের রক্ষক হয়ে প্রতিদিন ভঙ্গ করছে আইন। কেমন যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। বিষয়টা আমাকে নাড়া দিল। সহকর্মীর পর্যবেক্ষণকে একত্রিত করে এ রোগের একটি নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন তৈরি হয়ে গেল। বললাম, পুলিশের এ রোগটি হতে পারে 'হিংস্রলাইড্রম ইনফ্র্যাকশন'। কারণ এ রোগের লক্ষণ হিসেবে হিংস্রতা আছে। নিজের অন্যায় ঢাকতে বা অন্যকে ফাঁসাতে মিথ্যাচার আছে এবং রয়েছে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা। সহকর্মীরা সমর্থন করলেন এবং অনুরোধ করলেন এই রোগ নিয়ে যাতে পরবর্তী লেখাটি লিখি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পুলিশ কখনো এ দেশে সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পারল না। যদিও পুলিশের ভেতর অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন সৎ সদস্য আছেন, কিন্তু নষ্টবৃত্তের ভেতর বন্দিত্ব বরণ করায় তাঁরা অন্ধকারকে তাড়াতে পারছেন না। বেশির ভাগ সময় অন্ধকার গ্রাস করছে তাঁদেরই।
সুলতানি ও মোগল আমলে জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত পুলিশ। থানাদারের উপাধি ছিল কোতোয়াল বা কবির ভাষায় কোটাল। শাসকদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার নীতির সুবাতাস তখন থানাদারদেরও ছুঁয়ে যেত। তার পরও নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে কোটালভীতি ছিল না তা নয়। চৈতন্য চরিত কাব্যে দেখা যায়, শ্রীচৈতন্যের অনুসারী গ্রামের সরল বৈষ্ণবদের শত্রুপক্ষ ব্রাহ্মণরা কোতোয়ালের ভয় দেখাতেন। ইংরেজ শাসনের যুগে হাফপ্যান্ট পরা পুলিশকে ভয়ের চোখেই দেখত সাধারণ মানুষ। বাস্তববোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ সংকলন 'কালান্তরে' বেশ মজা করে বলেছিলেন, 'পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনোকালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।' পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে পুলিশকে সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ করে তোলা হতে থাকে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই পথে নামাত শাসকরা। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অনেক বেশি হিংস্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ধারা অব্যাহত থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে। আমাদের রাজনীতি যত বেশি সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালিপ্সু হচ্ছে, পুলিশ তত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে লাঠিয়াল হিসেবে। এ পথ ধরে দুর্নীতির নানা দরজা খুলে যাচ্ছে পুলিশের সামনে। রাজনৈতিক দল ও অসৎ নেতাদের আশ্রয়ে নানা ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। সৎ পুলিশ এসব দেখে কষ্ট পেলেও প্রতিকার করার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আপন মনে গুমরে মরেন। এসব কারণেই হিংস্রলাইড্রম ইনফ্র্যাকশন নামের প্রতীকী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন এ বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশেরই এলিট ভার্সন র্যাব। অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবতায় আশা জাগানিয়া প্রকল্প থেকে এ ধারার এলিট ফোর্সের সৃষ্টি হয়েছে। শুরুতে সামাজিক অস্থিরতা ও দুর্ভোগ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশ্রয় হিসেবে এলিট ফোর্সকে দেখেছে মানুষ। ফলে এক ধরনের শ্রদ্ধা ও স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছিল র্যাবের প্রতি। সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হতে থাকলে যেকোনো সংগঠন তার দৃঢ়তা হারাতে বাধ্য। আসল বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র্যাবের জড়িয়ে পড়াকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। যেকোনো রাষ্ট্রীয় সংগঠন জনআস্থা থেকে সরে এলে সে সংগঠনের সদস্যরা নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। বর্তমান বাস্তবতায় র্যাব কি তার নৈতিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারবে? টগবগে তরুণ লিমনের প্রতি র্যাবের হিংস্র আচরণকে কিন্তু সাধারণ মানুষ সহজভাবে নিতে পারেনি। র্যাবের বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সাফাই যে বাংলাদেশের কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ গ্রহণ করেছে তা স্বয়ং র্যাব পরিচালকরাও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ বা র্যাবের ভাষায়ই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সাফাই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বৈধতা দেন, তখন বোঝা যায় সরকার আর নিয়মতান্ত্রিক পথে চলার মতো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। এ অবস্থায় সরকারের অস্ত্রধারী আইন প্রয়োগকারী সংগঠন স্বেচ্ছাচারী হবেই। এ জন্যই ইমেজ সংকটে ভোগা পুলিশ নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরের জন্য মাঝেমধ্যেই নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ রোজগারের কথা মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় প্রকাশ পায়। আর ভুক্তভোগীরা তো হাড়ে হাড়ে টেরই পান। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে মানুষের মধ্যে তা প্রামাণ্য উদাহরণে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।
এভাবে বন্ধু হওয়ার বদলে পুলিশ সাধারণ মানুষের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অসুস্থ রাজনীতির এ দেশে পুলিশ যখন সরকারি দলের নেতা-কর্মীর হুকুমবরদার হতে বাধ্য হয়, তখন চাইলেও পুলিশ আইনের রক্ষক হতে পারে না। ফলে অন্যায় সুবিধা গ্রহণের সহজ পথ নাগালে চলে আসায় নিজ প্রয়োজনে পুলিশ হিংস্র ও মিথ্যাচারী হয়ে পড়ে। এ কারণেই পুলিশকে দিয়ে অসংখ্য জজমিয়া নাটক সাজানো সম্ভব হয়। নিজ কৃতিত্ব জাহির করার জন্য নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ধরে এনে ডাকাতি মামলার আসামি বানায়। হিংস্রতা দিয়ে পুলিশ অফিসার চাপাতির কোপ বসায় একজন সুস্থ তরুণের পায়ে। রক্তের হোলি খেলায় আনন্দ পায়। অসহায়ের রক্ষক না হয়ে কোম্পানীগঞ্জে কিশোর তরুণ মিলনকে পুলিশ নিজ হেফাজতে রেখে রক্ষা না করে ডাকাতের তকমা লাগিয়ে বেপরোয়া জনসমাবেশে ছুড়ে ফেলে দেয়। কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ত জনতা একটি কিশোরকে পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে একুশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রকাশ্য দিবালোকে তিলে তিলে খুন করে। এই হরর ছবির পরিচালক হিসেবে পুলিশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কতটা নিপুণভাবে খুন করতে শিখেছে মানুষ। অতঃপর নিজ হাতে খুন না করা 'নিষ্পাপ' পুলিশ নিহত কিশোরের পায়ে রশি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। জাতীয় দৈনিকে সচিত্র বিবরণ পড়ে মানুষ বিপন্ন বোধ করে। সমাজ কতটা অস্থির হলে একটি দেশে মানবতার এত বড় লাঞ্ছনা ঘটে!
পুলিশ একটি অন্যায় করলে শত মিথ্যা দিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করে। এ কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্তের প্রতি মানুষের আর আস্থা নেই। তার পরও মিলন হত্যার পুলিশি তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ইন্ধনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।
সব নৈরাজ্যের পেছনেই কারণ থাকে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ঘটনার সংবাদপত্রের তালিকায়ই এখন মহাভারত হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ছাত্রলীগের উন্মত্ততা, দখলবাণিজ্য আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাস্তানি, অমানবিক আচরণ। ঠিক অমন অবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেরানীগঞ্জে জেলখানা উদ্বোধন করতে গিয়ে যখন স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রীদের মতো বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তখন বিপন্ন মানুষের মাথায় বিস্ময়ের বজ্রাঘাত হয়। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যেমন বলেছিলেন, 'আবলতাবল বলে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবেন না'_মন্ত্রীদের অমন পরিহাসের জবাব আওয়ামী লীগের বিবেকসম্পন্ন নেতারা এভাবে দিলেই বরং জাতি আশ্বস্ত হবে।
তবে ইতিহাসের এ সত্যটি মানতে হবে যে এ দেশের সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তাতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর লক্ষণ কি দেখা যাচ্ছে না? ১৬ আগস্ট প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা গেল, রংপুরে ডাকাতি মামলার বাদী ব্যবসায়ীকে ডেকে এনে পুলিশ হত্যা করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সড়ক অবরোধ করে। এ সময় মামলার তদন্ত অফিসার সেখানে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকেসহ ছয় পুলিশকে পিটিয়ে আহত করেছে। এ অনভিপ্রেত ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আহত পুলিশদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করছি। কিন্তু এ ঘটনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনায় আনতে হবে।
বর্তমান বিশ্বের এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশ একটি অপরিহার্য রাষ্ট্রীয় সংগঠন। একে দুর্বল করা রাষ্ট্রের জন্য শুভ হতে পারে না। তাই পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই হবে। রোগাক্রান্ত পুলিশের অঙ্গচ্ছেদ না করে তাকে পরিশুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। দীর্ঘদিনের জগদ্দল পাথর ঠেলে পুলিশকে হয়তো পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। তবে যতটা সম্ভব এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপ না কমাতে পারলে কোনো প্রতিষেধকেই পুলিশকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, পুলিশ বাহিনীতে এখনো অনেক সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। অন্যায়কারীকে তিরস্কার ও সৎকে পুরস্কৃত না করতে পারলে অবস্থার পরিবর্তন করা সহজ হবে না। এ জন্য শুধু সরকারি সিদ্ধান্ত নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরও প্রয়োজন আছে। আমরা ইতিহাসবিমুখ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। ইতিহাসের শিক্ষা ছাড়া যেমন উদ্দীপ্ত হওয়া যায় না, তেমনি পরিশুদ্ধ হওয়াও কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে যখন একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতের কথা স্মরণে আনি, তখনই অপার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বীর পুলিশ সদস্যদের স্মরণে। বর্বর পাকিস্তানিদের ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের মুখে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশপ্রেমিক বীর পুলিশ সদস্যরা অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিস্ময়কর ইতিহাস গড়েছেন। আমাদের পুলিশ ভাইদের সুপথে চলার জন্য এর চেয়ে আর বড় কী প্রেরণা থাকতে পারে? সুতরাং এমন উজ্জ্বল ঐতিহ্য যে দেশে আছে, সে দেশের পুলিশ বাহিনী নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারবে না কেন? চাই শুধু সুস্থ রাজনীতির ছায়া, শুদ্ধ নীতি প্রণয়ন এবং সৎ-দক্ষ পরিচালকের পরিচালনা।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক লাউঞ্জে এমনি বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল। আমার এক সহকর্মী দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। উপর্যুপরি পুলিশ-র্যাবের কতগুলো আমানবিক আচরণের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী লক্ষ করেছে। তাঁর মন্তব্য, পুলিশ কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছে, নিজেদের অন্যায় ঢাকতে_অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা মিথ্যার গল্প সাজাচ্ছে আর এভাবে নিজেরা আইনের রক্ষক হয়ে প্রতিদিন ভঙ্গ করছে আইন। কেমন যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। বিষয়টা আমাকে নাড়া দিল। সহকর্মীর পর্যবেক্ষণকে একত্রিত করে এ রোগের একটি নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন তৈরি হয়ে গেল। বললাম, পুলিশের এ রোগটি হতে পারে 'হিংস্রলাইড্রম ইনফ্র্যাকশন'। কারণ এ রোগের লক্ষণ হিসেবে হিংস্রতা আছে। নিজের অন্যায় ঢাকতে বা অন্যকে ফাঁসাতে মিথ্যাচার আছে এবং রয়েছে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা। সহকর্মীরা সমর্থন করলেন এবং অনুরোধ করলেন এই রোগ নিয়ে যাতে পরবর্তী লেখাটি লিখি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পুলিশ কখনো এ দেশে সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পারল না। যদিও পুলিশের ভেতর অনেক মানবিক গুণসম্পন্ন সৎ সদস্য আছেন, কিন্তু নষ্টবৃত্তের ভেতর বন্দিত্ব বরণ করায় তাঁরা অন্ধকারকে তাড়াতে পারছেন না। বেশির ভাগ সময় অন্ধকার গ্রাস করছে তাঁদেরই।
সুলতানি ও মোগল আমলে জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত পুলিশ। থানাদারের উপাধি ছিল কোতোয়াল বা কবির ভাষায় কোটাল। শাসকদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার নীতির সুবাতাস তখন থানাদারদেরও ছুঁয়ে যেত। তার পরও নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে কোটালভীতি ছিল না তা নয়। চৈতন্য চরিত কাব্যে দেখা যায়, শ্রীচৈতন্যের অনুসারী গ্রামের সরল বৈষ্ণবদের শত্রুপক্ষ ব্রাহ্মণরা কোতোয়ালের ভয় দেখাতেন। ইংরেজ শাসনের যুগে হাফপ্যান্ট পরা পুলিশকে ভয়ের চোখেই দেখত সাধারণ মানুষ। বাস্তববোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ সংকলন 'কালান্তরে' বেশ মজা করে বলেছিলেন, 'পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনোকালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।' পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে পুলিশকে সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ করে তোলা হতে থাকে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশকে পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই পথে নামাত শাসকরা। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অনেক বেশি হিংস্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ ধারা অব্যাহত থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে। আমাদের রাজনীতি যত বেশি সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালিপ্সু হচ্ছে, পুলিশ তত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে লাঠিয়াল হিসেবে। এ পথ ধরে দুর্নীতির নানা দরজা খুলে যাচ্ছে পুলিশের সামনে। রাজনৈতিক দল ও অসৎ নেতাদের আশ্রয়ে নানা ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। সৎ পুলিশ এসব দেখে কষ্ট পেলেও প্রতিকার করার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আপন মনে গুমরে মরেন। এসব কারণেই হিংস্রলাইড্রম ইনফ্র্যাকশন নামের প্রতীকী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন এ বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশেরই এলিট ভার্সন র্যাব। অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবতায় আশা জাগানিয়া প্রকল্প থেকে এ ধারার এলিট ফোর্সের সৃষ্টি হয়েছে। শুরুতে সামাজিক অস্থিরতা ও দুর্ভোগ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশ্রয় হিসেবে এলিট ফোর্সকে দেখেছে মানুষ। ফলে এক ধরনের শ্রদ্ধা ও স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছিল র্যাবের প্রতি। সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হতে থাকলে যেকোনো সংগঠন তার দৃঢ়তা হারাতে বাধ্য। আসল বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র্যাবের জড়িয়ে পড়াকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। যেকোনো রাষ্ট্রীয় সংগঠন জনআস্থা থেকে সরে এলে সে সংগঠনের সদস্যরা নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। বর্তমান বাস্তবতায় র্যাব কি তার নৈতিক দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারবে? টগবগে তরুণ লিমনের প্রতি র্যাবের হিংস্র আচরণকে কিন্তু সাধারণ মানুষ সহজভাবে নিতে পারেনি। র্যাবের বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সাফাই যে বাংলাদেশের কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষ গ্রহণ করেছে তা স্বয়ং র্যাব পরিচালকরাও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ বা র্যাবের ভাষায়ই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সাফাই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বৈধতা দেন, তখন বোঝা যায় সরকার আর নিয়মতান্ত্রিক পথে চলার মতো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। এ অবস্থায় সরকারের অস্ত্রধারী আইন প্রয়োগকারী সংগঠন স্বেচ্ছাচারী হবেই। এ জন্যই ইমেজ সংকটে ভোগা পুলিশ নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরের জন্য মাঝেমধ্যেই নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ রোজগারের কথা মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় প্রকাশ পায়। আর ভুক্তভোগীরা তো হাড়ে হাড়ে টেরই পান। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে মানুষের মধ্যে তা প্রামাণ্য উদাহরণে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।
এভাবে বন্ধু হওয়ার বদলে পুলিশ সাধারণ মানুষের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অসুস্থ রাজনীতির এ দেশে পুলিশ যখন সরকারি দলের নেতা-কর্মীর হুকুমবরদার হতে বাধ্য হয়, তখন চাইলেও পুলিশ আইনের রক্ষক হতে পারে না। ফলে অন্যায় সুবিধা গ্রহণের সহজ পথ নাগালে চলে আসায় নিজ প্রয়োজনে পুলিশ হিংস্র ও মিথ্যাচারী হয়ে পড়ে। এ কারণেই পুলিশকে দিয়ে অসংখ্য জজমিয়া নাটক সাজানো সম্ভব হয়। নিজ কৃতিত্ব জাহির করার জন্য নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ধরে এনে ডাকাতি মামলার আসামি বানায়। হিংস্রতা দিয়ে পুলিশ অফিসার চাপাতির কোপ বসায় একজন সুস্থ তরুণের পায়ে। রক্তের হোলি খেলায় আনন্দ পায়। অসহায়ের রক্ষক না হয়ে কোম্পানীগঞ্জে কিশোর তরুণ মিলনকে পুলিশ নিজ হেফাজতে রেখে রক্ষা না করে ডাকাতের তকমা লাগিয়ে বেপরোয়া জনসমাবেশে ছুড়ে ফেলে দেয়। কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ত জনতা একটি কিশোরকে পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে একুশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রকাশ্য দিবালোকে তিলে তিলে খুন করে। এই হরর ছবির পরিচালক হিসেবে পুলিশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কতটা নিপুণভাবে খুন করতে শিখেছে মানুষ। অতঃপর নিজ হাতে খুন না করা 'নিষ্পাপ' পুলিশ নিহত কিশোরের পায়ে রশি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে। জাতীয় দৈনিকে সচিত্র বিবরণ পড়ে মানুষ বিপন্ন বোধ করে। সমাজ কতটা অস্থির হলে একটি দেশে মানবতার এত বড় লাঞ্ছনা ঘটে!
পুলিশ একটি অন্যায় করলে শত মিথ্যা দিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করে। এ কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্তের প্রতি মানুষের আর আস্থা নেই। তার পরও মিলন হত্যার পুলিশি তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের ইন্ধনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।
সব নৈরাজ্যের পেছনেই কারণ থাকে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ঘটনার সংবাদপত্রের তালিকায়ই এখন মহাভারত হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ছাত্রলীগের উন্মত্ততা, দখলবাণিজ্য আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাস্তানি, অমানবিক আচরণ। ঠিক অমন অবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেরানীগঞ্জে জেলখানা উদ্বোধন করতে গিয়ে যখন স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রীদের মতো বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তখন বিপন্ন মানুষের মাথায় বিস্ময়ের বজ্রাঘাত হয়। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্বহীন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যেমন বলেছিলেন, 'আবলতাবল বলে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবেন না'_মন্ত্রীদের অমন পরিহাসের জবাব আওয়ামী লীগের বিবেকসম্পন্ন নেতারা এভাবে দিলেই বরং জাতি আশ্বস্ত হবে।
তবে ইতিহাসের এ সত্যটি মানতে হবে যে এ দেশের সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তাতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর লক্ষণ কি দেখা যাচ্ছে না? ১৬ আগস্ট প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা গেল, রংপুরে ডাকাতি মামলার বাদী ব্যবসায়ীকে ডেকে এনে পুলিশ হত্যা করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী সড়ক অবরোধ করে। এ সময় মামলার তদন্ত অফিসার সেখানে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকেসহ ছয় পুলিশকে পিটিয়ে আহত করেছে। এ অনভিপ্রেত ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আহত পুলিশদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করছি। কিন্তু এ ঘটনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনায় আনতে হবে।
বর্তমান বিশ্বের এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশ একটি অপরিহার্য রাষ্ট্রীয় সংগঠন। একে দুর্বল করা রাষ্ট্রের জন্য শুভ হতে পারে না। তাই পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই হবে। রোগাক্রান্ত পুলিশের অঙ্গচ্ছেদ না করে তাকে পরিশুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। দীর্ঘদিনের জগদ্দল পাথর ঠেলে পুলিশকে হয়তো পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। তবে যতটা সম্ভব এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপ না কমাতে পারলে কোনো প্রতিষেধকেই পুলিশকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, পুলিশ বাহিনীতে এখনো অনেক সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। অন্যায়কারীকে তিরস্কার ও সৎকে পুরস্কৃত না করতে পারলে অবস্থার পরিবর্তন করা সহজ হবে না। এ জন্য শুধু সরকারি সিদ্ধান্ত নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরও প্রয়োজন আছে। আমরা ইতিহাসবিমুখ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। ইতিহাসের শিক্ষা ছাড়া যেমন উদ্দীপ্ত হওয়া যায় না, তেমনি পরিশুদ্ধ হওয়াও কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে যখন একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতের কথা স্মরণে আনি, তখনই অপার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বীর পুলিশ সদস্যদের স্মরণে। বর্বর পাকিস্তানিদের ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের মুখে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশপ্রেমিক বীর পুলিশ সদস্যরা অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিস্ময়কর ইতিহাস গড়েছেন। আমাদের পুলিশ ভাইদের সুপথে চলার জন্য এর চেয়ে আর বড় কী প্রেরণা থাকতে পারে? সুতরাং এমন উজ্জ্বল ঐতিহ্য যে দেশে আছে, সে দেশের পুলিশ বাহিনী নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারবে না কেন? চাই শুধু সুস্থ রাজনীতির ছায়া, শুদ্ধ নীতি প্রণয়ন এবং সৎ-দক্ষ পরিচালকের পরিচালনা।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments