মানুষের মুখ-নৌকা নিয়েই সারা বেলা

ঈদের পরে ছুটির রেশটা কাটতে চায় না। আর তাই বড় বড় শহরের মতো ছোট শহরের মানুষেরা ভিড় করে বিনোদনকেন্দ্র আর বেড়ানোর জায়গাগুলোতে। ছোট্ট শহর ময়মনসিংহে দর্শনীয় অনেক জায়গা থাকলেও পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ভিড়টা বোধ হয় একটু বেশি হয়। মোটকথা, ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্র নদের যে সৌন্দর্য তা কেবল এই শহরের মানুষকেই টানে না, বরং বাইরে থেকে বেড়াতে আসা অনেকেই চলে আসে এর পাড়ে।


শুকনো মৌসুমে নদে জল তেমন নেই, তাতে কি? ভরা যৌবনে না দেখতে পেলেও কিছু সময়ের জন্য হলেও মনে হয় এই নদে একটু ঘুরি। নদের ইটের বাঁধানো পাড়েই সারি বেঁধে বাঁধা থাকে অসংখ্য নৌকা। ভ্রমণপিপাসুরা মাঝিদের কাছে যাচ্ছেন, সময়ের হিসাবে দর কষছেন। আমরা কয় বন্ধু মিলে ঠিক করি একটা নৌকা। মাঝির সঙ্গে খুব বেশি সময় ভাড়া নিয়ে বাগড়াতে হলো না।
যখন নৌকায় উঠি, তখনো সূর্যের তেজ কমেনি। বাঁশের বৈঠা দিয়ে নৌকা বাইতে লাগলেন মাঝি। ততক্ষণে তাঁর নাম জানা হয়ে গেছে। তিনি মজিদ মিয়া, থাকেন চর জেলাখানা বিনপাড়ায়। আগে অবশ্য থাকতেন গোপীনপুরে। তখন পেশা ছিল মাছ ধরা। বসতি পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশার হয়েছে পরিবর্তন। নৌকার মালিক হওয়ার পর থেকেই মাঝিগিরি করেন তিনি। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ চারপাশের সব শব্দকে ছাপিয়ে কানে লাগছিল। এক মনেই মজিদ মিয়া বৈঠা চালাচ্ছেন। প্রশ্ন করতেই মজিদ মিয়ার মৌনতা যেন ভাঙল। বাড়িতে কে কে আছে? বৈঠার প্রতিটা টানের দ্রুততার মতোই তাঁর উত্তর দিতে সময় লাগছে না। ‘বাই (ভাই), বাহে (বাবা), পরিবার (স্ত্রী) আর মাইয়া। মাইয়ারে বিয়া দেওনে জামাই অহনে থাহে।’
কত দিন নৌকা চালান?
তা বারো-তেরো বছর হইল। হের আগে তো মন যান (ধরেন যে), এত মানুষ আছিল না। আমরা কয় জন মাঝি আছিলাম।
নৌকা চালানোর বাইরে আর কী করেন?
বাড়িতে গেরস্তের কাম করি। পরিবাররে কামে সাহায্য করি। দশটা-বারোটা (১০-১২) বাজলে এইখানে আসি। তয় বেলা গড়াইলে অনেকেই ঘুরতে আসে। তহন কামাই ভালো হয়। এহন তো ধরেন ঈদ মুবারক, তাই মেলা মানুষ। আবার মেলা মাঝি আইছে। এমনি বেলা খালিই থাহে।
আর সারা দিনের কামাই?
ধরেন, ৫০ টেক্যা আবার ঈদ মুবারক, তাই এহন ৪০০ টেক্যাও হয়। আবার কোনো দিন খাইল্যাও যায়।
খালি গেলে কি মন খারাপ হয়? একটু থামেন এই মাঝি, কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাঝে ঠোঁটে আলতো হাসি। ‘খারাপ তো ধরেন লাগেই। তয় ভাবি, পরের দিন মেলা মানুষের খেপা টানব। সকালে আসি খাইয়া, দুফুরে দোয়ানে (দোকানে) রুডি খাই। লগে ইয়াসিনও খায়। নিজের পোলা নাই তো তাই ইয়াসিনই আমার পোলার মতো।’ নৌকায় পা দিয়েই চোখ পড়েছিল ছোট ইয়াসিনের দিকে। বয়স বড়জোর পাঁচ বছর হবে। নৌকার পানি উঠলেই তা প্লাস্টিকের বাটি দিয়ে ছেচে ফেলার দায়িত্ব তার। মজিদ মিয়া বলেন, ‘মেলা মানুষ নৌকায় ঘুরতে আহে। নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সবাই কথাও কয় না আবার অনেকে কয়। খুব বেশি যখন মন কান্দে, তহন নদীর ওই পাড়ে যে চর আছে যেইয়ানে কাশফুল ফোডে, সেইয়ানে গিয়া বসি। মনডা ভালা হয়। তয় অহন তো কাশফুল সব শ্যাষ। অহন মাঝে-মইদ্যে খালি আকাশের নিচে বইস্যা থাকি। বেশি টাইম বসতে পারি না, খ্যাপ মারতে হয় তাই।’
আবার মজিদ মিয়াকে প্রশ্ন করি, নিজের কি কোনো স্বপ্ন আছে? উত্তরটা দেন আরেক প্রশ্নের মাধ্যমে। ‘স্বপন ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? আমারও আছে, তয় কমু না। কইলে তো আর সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না। খালি চাই তিন বেলা প্যাট ভইরা যেন খাইতে পাই।’
মজিদ মিয়া তাঁর স্বপ্নের কথা আমাদের জানাল না। তবে তাঁর কাঁচাপাকা দাড়ি আর মলিন মুখের মাঝে উজ্জ্বল চোখের গহিনে যেন এক স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। যে স্বপ্ন তিনি বয়ে বেড়াতে চান আজীবন। সূর্য তখন ডুবে গেছে, অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। ফিরে আসি গন্তব্যে। তবে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল মজিদ মিয়ার না-বলা কথাগুলো, যা প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর চোখের ভাসায়।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.