বদলের ধারায় বাংলা একাডেমী by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
সদ্য বিদায়ী ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ শনিবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলা একাডেমীর ‘দ্বাত্রিংশ বার্ষিক সাধারণ সভা ২০০৯’। এটা কততম বার্ষিক সভা? এক একজন দেখলাম এক এক রকম সংখ্যা বলছেন, যার যার বিবেচনা মতে। এরকম দাঁতভাঙা সংখ্যা নিরূপক ব্যবহারের কারণে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হলেন মনে হয়।
সোজা করে বললেই হতো, এখন কী আর এমন কঠিন শব্দ কেউ ব্যবহার করে! যুগটাই তো সরলীকরণের! ইত্যাদি মন্তব্য শোনা গেল বিভিন্ন জনের ছোট ছোট জটলায়। তরুণ এক কবির ব্যানারে লেখা ‘দ্বাত্রিংশ’ শব্দের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, মনে হয় কবি কালিদাসের যুগে ফেরত চলে গেলাম টাইম মেশিনে চড়ে!
আসলে বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সাধারণ সভায় সদস্যরা গুরু-গম্ভীর আলোচনার পাশাপাশি হাল্কা কথাবার্তাও বলেন। সব সময় কী আর রাম গরুড়ের ছানার মতো গুরু-গম্ভীর থাকা যায়! হোক না প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞান চর্চার চারণ ভূমি!
যারা বয়সে প্রবীণ তারাও বার্ষিক এই মিলন মেলায় এসে গাম্ভীর্যের আলখেল্লাটা ছুড়ে ফেলে হাল্কা চটুল আলাপচারিতায় কী অনায়াসেই না মেতে ওঠেন!
ডিসেম্বর মাসে এতদঞ্চলে এখনও শীত নামক ঋতুর অস্তিত্ব অনুভব করা যায় প্রকৃতির ওপর নির্মম ও নির্বিকার অত্যাচার সত্ত্বেও। জলবায়ুর যে বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান, তার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এর কারণে জলবায়ু দূষণের জন্য বড় অপরাধী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবার যে পরিমাণ বরফ পড়েছে তা নাকি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অনেক বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার যাত্রী বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। একই অবস্থা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। দ্রুতগামী ট্রেন ইউরোস্টারের চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সাময়িকভাবে। যারা তুষারপাতের অভাবে ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’-এর জন্য হা-পিত্যেশ করেন বিধাতা এবার তাদের আশা মিটিয়েছেন। সাদা ক্রিসমাসে তারা উপভোগ করতে অবশ্য পারেননি বরফের তীব্রতা আর তুষার ঝড়ের কারণে। যে দেশে তুষার ঝড় আর বরফপাত নৈমিত্তিক ঘটনা, সেই কানাডায় নাকি এবার ছিল তুষারের আক্রা!
বাংলাদেশের মানুষ আবহাওয়ার পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী অথচ এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য তাদের দায় ন্যূনতম। কোপেনহেগেনে যে বিরাট সম্মেলন হয়ে গেল জলবায়ু নিয়ে তার ফলাফলে খোদ জাতিসংঘের মহাসচিবই হতাশা প্রকাশ করেছেন।
আসলে এসব ফলাফল থেকে খুব বেশি প্রাপ্তি আশাও করা ঠিক নয়। সম্মেলনে যেসব দেশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, সেসব দেশের শক্তি অনেক। শক্তিশালী দুর্বৃত্তকে শায়েস্তা করার জন্য যে শক্তির দরকার, তা আয়ত্ত না করতে পারলে ভুক্তভোগী দেশগুলোর কোনো ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা সুদূর পরাহত। পৃথিবীটা শক্তের ভক্ত—এটা জানা কথা।
বাংলা একাডেমীর খোলা প্রাঙ্গণে শীতের সকালে কাঁচা হলুদ রংয়ের রোদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন নবীন-প্রবীণরা।
অনেক দিন পর তাদের সঙ্গে দেখা। জটলায় বলেছিলাম, আগামী বছর যদি বেঁচেবর্তে থাকি, তাহলে এমনভাবে রোদে দাঁড়ানোর সুযোগ পাব কিনা কে জানে। আবহাওয়া যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে! ডিসেম্বর মাসে গা-সওয়া শীতে রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে কিনা কে বলতে পারে! তিনিও হেসে একই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন।
এবার বাংলা একাডেমী রেকর্ড সংখ্যক ব্যক্তিকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেছে। সম্মানিতদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ-প্রেমিক মার্কিন শিক্ষাবিদ ক্লিনটন বুথ সিলি আর জাপানি মানবতাবাদী কাজুও আজুমা।
মাস কয়েক আগে টোকিও অবস্থানকালীন লেখক-সাংবাদিক প্রবীর বিকাশ সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলাম, প্রবীণ এই জাপানি সজ্জন ব্যক্তিটি বর্তমানে প্রায় শয্যাশায়ী। হাসপাতালে আর বাসায় তার সময় কাটে। প্রবীর ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এ ব্যক্তির অবদান কোনো দিন ভোলা যাবে না। রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে তার অবদানের কথা কোনো দিন ভোলা যাবে না। প্রফেসর আজুমা বর্তমানে চিবা প্রি-ফ্যাকচারের ইচিকাওয়া সিটির কাকেন বিওইনে (হাসপাতালে) শয্যাশায়ী।
অধ্যাপক ক্লিনটন বুথ সিলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ইংরেজি বলিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের সাহিত্যকে পরিচিত করিয়েছেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে।
মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় ঘনিয়ে এলে ধীরে ধীরে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে এসে দেখি এরই মধ্যে প্রায় সব চেয়ার দখল হয়ে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি আসন খালি আছে।
একটি লম্বা টেবিলে দেখলাম ‘সংরক্ষিত’ লেখা সম্বলিত বোর্ড রাখা আছে।
একটু হোঁচট খেতে হলো। বাংলা একাডেমীতে কোনো দিন ‘সংরক্ষিত’ টেবিলের ব্যবস্থা ছিল বলে মনে করতে পারছিলাম না।
এখানে তো আমলাতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যাশিত নয়। সংরক্ষিত টেবিলে বসে যারা আহার গ্রহণ করলেন তাদের কথা নাই বা বললাম। শুধু বলি, তাদের বিলম্বিত আগমনের কারণে খাবার সরবরাহ করা হয় দেরিতে, যার ফলে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হয়েছিল আমন্ত্রিতদের। ভাবছিলাম, শুধু আবহাওয়াই নয়, অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক এবং ফেলো বাংলা একাডেমী
আসলে বাংলা একাডেমীর বার্ষিক সাধারণ সভায় সদস্যরা গুরু-গম্ভীর আলোচনার পাশাপাশি হাল্কা কথাবার্তাও বলেন। সব সময় কী আর রাম গরুড়ের ছানার মতো গুরু-গম্ভীর থাকা যায়! হোক না প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞান চর্চার চারণ ভূমি!
যারা বয়সে প্রবীণ তারাও বার্ষিক এই মিলন মেলায় এসে গাম্ভীর্যের আলখেল্লাটা ছুড়ে ফেলে হাল্কা চটুল আলাপচারিতায় কী অনায়াসেই না মেতে ওঠেন!
ডিসেম্বর মাসে এতদঞ্চলে এখনও শীত নামক ঋতুর অস্তিত্ব অনুভব করা যায় প্রকৃতির ওপর নির্মম ও নির্বিকার অত্যাচার সত্ত্বেও। জলবায়ুর যে বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান, তার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এর কারণে জলবায়ু দূষণের জন্য বড় অপরাধী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবার যে পরিমাণ বরফ পড়েছে তা নাকি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অনেক বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার যাত্রী বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। একই অবস্থা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। দ্রুতগামী ট্রেন ইউরোস্টারের চলাচল বন্ধ হয়ে যায় সাময়িকভাবে। যারা তুষারপাতের অভাবে ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’-এর জন্য হা-পিত্যেশ করেন বিধাতা এবার তাদের আশা মিটিয়েছেন। সাদা ক্রিসমাসে তারা উপভোগ করতে অবশ্য পারেননি বরফের তীব্রতা আর তুষার ঝড়ের কারণে। যে দেশে তুষার ঝড় আর বরফপাত নৈমিত্তিক ঘটনা, সেই কানাডায় নাকি এবার ছিল তুষারের আক্রা!
বাংলাদেশের মানুষ আবহাওয়ার পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী অথচ এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য তাদের দায় ন্যূনতম। কোপেনহেগেনে যে বিরাট সম্মেলন হয়ে গেল জলবায়ু নিয়ে তার ফলাফলে খোদ জাতিসংঘের মহাসচিবই হতাশা প্রকাশ করেছেন।
আসলে এসব ফলাফল থেকে খুব বেশি প্রাপ্তি আশাও করা ঠিক নয়। সম্মেলনে যেসব দেশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, সেসব দেশের শক্তি অনেক। শক্তিশালী দুর্বৃত্তকে শায়েস্তা করার জন্য যে শক্তির দরকার, তা আয়ত্ত না করতে পারলে ভুক্তভোগী দেশগুলোর কোনো ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা সুদূর পরাহত। পৃথিবীটা শক্তের ভক্ত—এটা জানা কথা।
বাংলা একাডেমীর খোলা প্রাঙ্গণে শীতের সকালে কাঁচা হলুদ রংয়ের রোদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন নবীন-প্রবীণরা।
অনেক দিন পর তাদের সঙ্গে দেখা। জটলায় বলেছিলাম, আগামী বছর যদি বেঁচেবর্তে থাকি, তাহলে এমনভাবে রোদে দাঁড়ানোর সুযোগ পাব কিনা কে জানে। আবহাওয়া যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে! ডিসেম্বর মাসে গা-সওয়া শীতে রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকবে কিনা কে বলতে পারে! তিনিও হেসে একই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন।
এবার বাংলা একাডেমী রেকর্ড সংখ্যক ব্যক্তিকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেছে। সম্মানিতদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ-প্রেমিক মার্কিন শিক্ষাবিদ ক্লিনটন বুথ সিলি আর জাপানি মানবতাবাদী কাজুও আজুমা।
মাস কয়েক আগে টোকিও অবস্থানকালীন লেখক-সাংবাদিক প্রবীর বিকাশ সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলাম, প্রবীণ এই জাপানি সজ্জন ব্যক্তিটি বর্তমানে প্রায় শয্যাশায়ী। হাসপাতালে আর বাসায় তার সময় কাটে। প্রবীর ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এ ব্যক্তির অবদান কোনো দিন ভোলা যাবে না। রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে তার অবদানের কথা কোনো দিন ভোলা যাবে না। প্রফেসর আজুমা বর্তমানে চিবা প্রি-ফ্যাকচারের ইচিকাওয়া সিটির কাকেন বিওইনে (হাসপাতালে) শয্যাশায়ী।
অধ্যাপক ক্লিনটন বুথ সিলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ইংরেজি বলিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের সাহিত্যকে পরিচিত করিয়েছেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে।
মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় ঘনিয়ে এলে ধীরে ধীরে প্যান্ডেলের দিকে এগিয়ে এসে দেখি এরই মধ্যে প্রায় সব চেয়ার দখল হয়ে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি আসন খালি আছে।
একটি লম্বা টেবিলে দেখলাম ‘সংরক্ষিত’ লেখা সম্বলিত বোর্ড রাখা আছে।
একটু হোঁচট খেতে হলো। বাংলা একাডেমীতে কোনো দিন ‘সংরক্ষিত’ টেবিলের ব্যবস্থা ছিল বলে মনে করতে পারছিলাম না।
এখানে তো আমলাতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যাশিত নয়। সংরক্ষিত টেবিলে বসে যারা আহার গ্রহণ করলেন তাদের কথা নাই বা বললাম। শুধু বলি, তাদের বিলম্বিত আগমনের কারণে খাবার সরবরাহ করা হয় দেরিতে, যার ফলে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হয়েছিল আমন্ত্রিতদের। ভাবছিলাম, শুধু আবহাওয়াই নয়, অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক এবং ফেলো বাংলা একাডেমী
No comments