নির্বাচন-ভোটের রাজনীতিতে আইভী মডেল by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিশাল বিজয় বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে নেতৃত্ব নির্বাচনে একটা নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব (আংশিক) ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন সত্ত্বেও শামীম ওসমান প্রায় লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হয়েছেন। শামীম ওসমান সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জবাসীর বহু অভিযোগ। বিভিন্ন মিডিয়াও এসব অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছিল।
শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। অপরদিকে, আইভী একজন পরিচ্ছন্ন চরিত্রের মানুষ বলে প্রচারিত। পৌর মেয়র হিসেবে আট বছর তিনি কাজ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বশংবদ কয়েকজন নেতা শামীম ওসমানকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়েছিলেন।
একসময় মনে করা হতো শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার আশীর্বাদ যাদের পেছনে রয়েছে তারা নির্বাচনে জিতবেই। দলনেত্রীর আশীর্বাদ মানে পুরো দলই তার পেছনে কাজ করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক নাসিক নির্বাচন দেখিয়েছে দলনেত্রী বিতর্কিত প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও পুরো দল (স্থানীয় আওয়ামী লীগ) তা মেনে নিতে পারেনি। তারা দলেরই একজন পরিচ্ছন্ন প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই আইভীকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মী। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের জেলা আহ্বায়ক নিজেই আইভীর পক্ষে প্রচারণা করেছেন।
ঢাকায় বসে বা গণভবনে বসে জেলা রাজনীতির কলকাঠি নাড়ার দিন মনে হয় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। কাজটা আগের মতো আর সহজ হবে না ভবিষ্যতে। তবে নারায়ণগঞ্জে এমনটি হয়েছে বলে আগামী সংসদ নির্বাচনেও এমনটি হবে, তা বলা সম্ভব নয়। সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট অনেক বড়। ৩০০ আসনের নির্বাচন। একটি সীমিত এলাকায় ও একটি মাত্র পদের নির্বাচনে এটা প্রয়োগ করা অনেকটা সহজ। তবে ঢাকা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনেও এটা প্রয়োগ করা যায়।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রিমোর্ট কন্ট্রোলে প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। নাসিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দাবি করেছে: স্থানীয় দল, কমিটি বা নেতা-নেত্রীদের পরামর্শ ছাড়া কোনো নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া সুবিবেচনার কাজ নয়। শুধু পরামর্শ নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকার মতো প্রাইমারি নির্বাচন করে প্রার্থী বাছাই করারও দাবি উঠতে পারে। টাকা, আনুগত্য, স্তাবকতা বা অন্য কোনো উপায়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বশ করে মনোনয়ন নিলেও যে শেষ রক্ষা হয় না তা নাসিক নির্বাচন থেকে সবাই বুঝতে পেরেছেন। যদি কোথাও সন্ত্রাসী প্রার্থীর পাশে দলেরই যোগ্য প্রার্থী দাঁড় করানো যায় তাহলে দেশের যেকোনো স্থানে নাসিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি নাসিক অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে আর সরাসরি মনোনয়ন বা সমর্থন না দিয়ে তা স্থানীয় কমিটি বা প্রাইমারির ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে মনোনয়ন প্রদান ইতিমধ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় ব্যবসা হয়ে উঠেছে। এই ব্যবসার অবসান ঘটানোর জন্যও মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি পরিচ্ছন্ন ইমেজের যোগ্য প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও নিছক দলবাজ প্রার্থীকে সমর্থন দেয় তার জন্য এই দুই দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূতির্র নেতা-কর্মীদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী স্বার্থে দুর্নীতি ও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজন মন্ত্রীকে এখনো মন্ত্রিসভায় রেখেছেন তাও চিন্তা করতে হবে। আরও মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক সভা করে নানা দিক বিবেচনা করে শামীম ওসমানকে সমর্থন জানায়নি। কয়েকজন নেতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শামীম ওসমানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। অথচ আজ সেই নির্বাচনে পরাজয়ের জ্বালা ভোগ করতে হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমার ধারণা, নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন যেভাবে দল ও সাধারণ মানুষ কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে, ডিসিসি নির্বাচনে তিনি এই ভুল আর হয়তো করবেন না। ডিসিসি নির্বাচনে তিনি হয়তো ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের ওপরই ছেড়ে দিতে পারেন।
বিএনপির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। ঢাকা মহানগর বিএনপিতে নানা কোন্দল, দলীয় নেতাদের মধ্যে সে রকম কোনো উজ্জ্বল প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না। কাজেই কোন প্রার্থীকে বিএনপি সমর্থন দেবে তা দলের কাছেই এক কঠিন প্রশ্ন। বিএনপিতেও দলপ্রধানের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য একটা বড় বিষয়। এখন শোনা যায়, তারেক রহমানের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটিও এসে পড়েছে। এখন নাকি লন্ডন থেকেও ক্লিয়ারেন্স আনতে হয়। বিএনপিতে এখন আর ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না। ডিসিসি নির্বাচনে মনোনয়ন-প্রক্রিয়া ও দুই বড় দল কাকে সমর্থন দিচ্ছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
রাজধানী ঢাকায় একজন নির্দলীয় ও দক্ষ মেয়র নির্বাচিত হলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু ঢাকায় বিএনপি বা আওয়ামী লীগ এত শক্তিশালী যে তাদের দাপটে নির্দলীয় কোনো ব্যক্তির পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তদুপরি ঢাকা সিটি করপোরেশন দুর্নীতির একটা ভালো উৎস। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই এই জায়গা হাতছাড়া করতে চাইবে না। ডিসিসির টাকা-পয়সা যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে ঢাকায় নগর রাজনীতি করে আর কী লাভ? সবাই তো আর এমপি, মেয়র বা কাউন্সিলর হবেন না। ঠিকাদারি বা ব্যবসা-বাণিজ্য তো পেতে হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (৩০০ সিট) নাসিক মডেল খুব একটা কার্যকর হবে না। এর প্রতিবন্ধকতা অনেক। যেমন: ১. নির্বাচনী প্রতীক। এই যে নৌকা বা ধানের শীষ মার্কাতেই ভোট দানের প্রবণতা, এটা খুব বিপজ্জনক। গ্রামবাংলায় অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ প্রার্থীকে ভালো করে চেনেই না। তারা অনেকেই শিক্ষাবঞ্চিত। তারা চেনে নির্বাচনী মার্কা। আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে যদি দল মনোনয়ন না দেয় তাহলে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম খুবই কম। ২. সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে কেন্দ্রের প্রভাব বা খবরদারি। অনেক ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার লেনদেন হয় বলেও শোনা যায়। যদিও কাগজে-কলমে স্থানীয়ভাবে মনোনয়ন দানের কথা বলা হয়, বেশির ভাগ আসনে তা অনুসরণ করা হয় না। ৩. অত্যধিক টাকা-পয়সা খরচ করার ক্ষমতা যেসব ব্যক্তির থাকে তারা মনোনয়নে অগ্রাধিকার পায়। ৪. বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের নির্বাচনে টাকা-পয়সা এখনো একটা বড় বিষয়। ৫. আত্মীয়তা, পরিবারতন্ত্র, পরলোকগত নেতার স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে এসব পরিচয়ও মনোনয়নে বড় রকম সুবিধা পেয়ে থাকে।
এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে শুধু একটা উপায় আছে। তা হলো যেসব আসনে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি খুবই খারাপ (সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, গডফাদার) প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে সেই সব আসনে নাগরিক কমিটি গঠন করে একজন সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে (স্বতন্ত্র) মনোনয়ন দানের ব্যবস্থা করা। আমাদের বিশ্বাস, এ ধরনের প্রার্থীকে সাধারণ নির্দল মানুষ তো সমর্থন দেবেই, এমনকি বিএনপি ও আওয়ামী লীগেরও অনেকে ভোট দিতে পারেন। কোনো কোনো আসনে নাগরিক কমিটির সমর্থিত প্রার্থী জিতেও যেতে পারেন।
এভাবে আমরা জাতীয় সংসদে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী বা গডফাদার ধরনের সদস্যকে ঠেকাতে পারব। তাও পারব খুব সীমিতভাবে। আমাদের সংসদীয় নির্বাচনী রাজনীতিতে দুটি বড় দল ও তাদের নির্বাচনী প্রতীক একটি বড় শক্তি। এর সঙ্গে সহায়ক হয়েছে গ্রামবাংলার বেশির ভাগ ভোটার রাজনৈতিকভাবে ততটা সচেতন নন। নির্বাচনে তাদের ঠেকানো প্রায় সহজ কাজ, যদি না তাহরির স্কোয়ার বা ওয়াল স্ট্রিট ধরনের বড় গণজাগরণ দেশে না ঘটে। বড় দুটি দলের অপশাসন যেভাবে পালা করে অতিবাহিত হচ্ছে, তাতে অনেকেই আশা করেন দেশের মানুষ আর পালা করে তাদের অপশাসন দেখার জন্য নিয়ম করে ভোট দেবেন না। সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। তারা যেকোনো সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ এ দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলে এবং ভারত-বিরোধিতার স্লোগান তুলে বেশিদিন বশ রাখা সম্ভব হবে না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন থেকে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েও তারা দেখতে চাইবে সুশাসন। তারা দেশের প্রকৃত অগ্রগতি দেখতে চায়। তারা চায় প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা। যোগ্য ও দক্ষ মন্ত্রিসভা। জাতীয় সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান। সন্ত্রাসী ও খুনোখুনির রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনের দৃঢ় ভূমিকা। অর্থনীতির অগ্রগতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ। দেশকে শিল্পায়িত করা ও তরুণ সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক কর্মোদ্যোগ। এ রকম আরও নানা ইতিবাচক পরিবর্তন তরুণ সমাজ দেখতে চায়। শুধু কথার মায়াজাল দিয়ে পাঁচ বছর পর পর ভোট চাইতে আসার এই কৌশল জনগণ বুঝে ফেলেছে। এগুলো কোনো কিছুই দুই বড় দলের শাসনকালে প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যমান নয়।
যেহেতু বড় দুই দলের নেতৃত্ব ছাড়া এই মুহূর্তে কারও পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু বড় দুই দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দানে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। জেলা পর্যায়ে মনোনয়নের দাবি জোরদার করতে হবে। আমেরিকার ‘প্রাইমারির’ মতো মনোনয়ন-প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এভাবেই আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির দলীয় রাজনীতি কখন পরিচ্ছন্ন ও গণতান্ত্রিক হবে, কখন পারিবারিক প্রভাব ও একনায়কত্ব থেকে বেরিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হয়ে উঠবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু আমরা ধারণা করতে পারি, দুই বড় দলে বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমানের পরিবারের কেউ যখন মূল নেতৃত্বে থাকার সুযোগ পাবেন না, তখন দল দুটিতে গুণগত গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তার আগে পর্যন্ত আমাদের এই অপরাজনীতি, অপশাসন, পরিবারতন্ত্র ও দলীয়করণ সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করতে হবে বলেই আশঙ্কা হয়। যদি না তাহরির স্কোয়ার বা ওয়াল স্ট্রিটের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে একটা গণজাগরণ না ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই হতাশাজনক পটভূমিতে নাসিক নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয় একটা ক্ষীণ আশার রেখা। খুবই ক্ষীণ। তবে খুব সম্ভাবনাময়। এখন আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে এই আইভী মডেল প্রয়োগ করে রাজনীতিতে কিছুটা সুস্থতা আনার চেষ্টা করতে হবে। রাজনীতির মূল সমস্যা কিন্তু অনেক ব্যাপক। একসঙ্গে সমগ্র রাজনীতিকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয় বলে যেটুকু পারা যায় সেটুকু নিয়েই এগোতে হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
একসময় মনে করা হতো শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার আশীর্বাদ যাদের পেছনে রয়েছে তারা নির্বাচনে জিতবেই। দলনেত্রীর আশীর্বাদ মানে পুরো দলই তার পেছনে কাজ করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক নাসিক নির্বাচন দেখিয়েছে দলনেত্রী বিতর্কিত প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও পুরো দল (স্থানীয় আওয়ামী লীগ) তা মেনে নিতে পারেনি। তারা দলেরই একজন পরিচ্ছন্ন প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই আইভীকে যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মী। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের জেলা আহ্বায়ক নিজেই আইভীর পক্ষে প্রচারণা করেছেন।
ঢাকায় বসে বা গণভবনে বসে জেলা রাজনীতির কলকাঠি নাড়ার দিন মনে হয় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। কাজটা আগের মতো আর সহজ হবে না ভবিষ্যতে। তবে নারায়ণগঞ্জে এমনটি হয়েছে বলে আগামী সংসদ নির্বাচনেও এমনটি হবে, তা বলা সম্ভব নয়। সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট অনেক বড়। ৩০০ আসনের নির্বাচন। একটি সীমিত এলাকায় ও একটি মাত্র পদের নির্বাচনে এটা প্রয়োগ করা অনেকটা সহজ। তবে ঢাকা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনেও এটা প্রয়োগ করা যায়।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রিমোর্ট কন্ট্রোলে প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। নাসিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দাবি করেছে: স্থানীয় দল, কমিটি বা নেতা-নেত্রীদের পরামর্শ ছাড়া কোনো নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া সুবিবেচনার কাজ নয়। শুধু পরামর্শ নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকার মতো প্রাইমারি নির্বাচন করে প্রার্থী বাছাই করারও দাবি উঠতে পারে। টাকা, আনুগত্য, স্তাবকতা বা অন্য কোনো উপায়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বশ করে মনোনয়ন নিলেও যে শেষ রক্ষা হয় না তা নাসিক নির্বাচন থেকে সবাই বুঝতে পেরেছেন। যদি কোথাও সন্ত্রাসী প্রার্থীর পাশে দলেরই যোগ্য প্রার্থী দাঁড় করানো যায় তাহলে দেশের যেকোনো স্থানে নাসিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি নাসিক অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে আর সরাসরি মনোনয়ন বা সমর্থন না দিয়ে তা স্থানীয় কমিটি বা প্রাইমারির ওপর ছেড়ে দেয়, তাহলে রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে মনোনয়ন প্রদান ইতিমধ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় ব্যবসা হয়ে উঠেছে। এই ব্যবসার অবসান ঘটানোর জন্যও মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি পরিচ্ছন্ন ইমেজের যোগ্য প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও নিছক দলবাজ প্রার্থীকে সমর্থন দেয় তার জন্য এই দুই দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূতির্র নেতা-কর্মীদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী স্বার্থে দুর্নীতি ও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজন মন্ত্রীকে এখনো মন্ত্রিসভায় রেখেছেন তাও চিন্তা করতে হবে। আরও মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক সভা করে নানা দিক বিবেচনা করে শামীম ওসমানকে সমর্থন জানায়নি। কয়েকজন নেতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শামীম ওসমানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। অথচ আজ সেই নির্বাচনে পরাজয়ের জ্বালা ভোগ করতে হচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমার ধারণা, নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন যেভাবে দল ও সাধারণ মানুষ কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে, ডিসিসি নির্বাচনে তিনি এই ভুল আর হয়তো করবেন না। ডিসিসি নির্বাচনে তিনি হয়তো ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের ওপরই ছেড়ে দিতে পারেন।
বিএনপির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। ঢাকা মহানগর বিএনপিতে নানা কোন্দল, দলীয় নেতাদের মধ্যে সে রকম কোনো উজ্জ্বল প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না। কাজেই কোন প্রার্থীকে বিএনপি সমর্থন দেবে তা দলের কাছেই এক কঠিন প্রশ্ন। বিএনপিতেও দলপ্রধানের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য একটা বড় বিষয়। এখন শোনা যায়, তারেক রহমানের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটিও এসে পড়েছে। এখন নাকি লন্ডন থেকেও ক্লিয়ারেন্স আনতে হয়। বিএনপিতে এখন আর ‘ওয়ান স্টপ’ সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না। ডিসিসি নির্বাচনে মনোনয়ন-প্রক্রিয়া ও দুই বড় দল কাকে সমর্থন দিচ্ছে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
রাজধানী ঢাকায় একজন নির্দলীয় ও দক্ষ মেয়র নির্বাচিত হলে সবচেয়ে ভালো হতো। কিন্তু ঢাকায় বিএনপি বা আওয়ামী লীগ এত শক্তিশালী যে তাদের দাপটে নির্দলীয় কোনো ব্যক্তির পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তদুপরি ঢাকা সিটি করপোরেশন দুর্নীতির একটা ভালো উৎস। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলই এই জায়গা হাতছাড়া করতে চাইবে না। ডিসিসির টাকা-পয়সা যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে ঢাকায় নগর রাজনীতি করে আর কী লাভ? সবাই তো আর এমপি, মেয়র বা কাউন্সিলর হবেন না। ঠিকাদারি বা ব্যবসা-বাণিজ্য তো পেতে হবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (৩০০ সিট) নাসিক মডেল খুব একটা কার্যকর হবে না। এর প্রতিবন্ধকতা অনেক। যেমন: ১. নির্বাচনী প্রতীক। এই যে নৌকা বা ধানের শীষ মার্কাতেই ভোট দানের প্রবণতা, এটা খুব বিপজ্জনক। গ্রামবাংলায় অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ প্রার্থীকে ভালো করে চেনেই না। তারা অনেকেই শিক্ষাবঞ্চিত। তারা চেনে নির্বাচনী মার্কা। আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে যদি দল মনোনয়ন না দেয় তাহলে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তির পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। ব্যতিক্রম খুবই কম। ২. সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে কেন্দ্রের প্রভাব বা খবরদারি। অনেক ক্ষেত্রে টাকা-পয়সার লেনদেন হয় বলেও শোনা যায়। যদিও কাগজে-কলমে স্থানীয়ভাবে মনোনয়ন দানের কথা বলা হয়, বেশির ভাগ আসনে তা অনুসরণ করা হয় না। ৩. অত্যধিক টাকা-পয়সা খরচ করার ক্ষমতা যেসব ব্যক্তির থাকে তারা মনোনয়নে অগ্রাধিকার পায়। ৪. বাংলাদেশের প্রায় সব ধরনের নির্বাচনে টাকা-পয়সা এখনো একটা বড় বিষয়। ৫. আত্মীয়তা, পরিবারতন্ত্র, পরলোকগত নেতার স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে এসব পরিচয়ও মনোনয়নে বড় রকম সুবিধা পেয়ে থাকে।
এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে শুধু একটা উপায় আছে। তা হলো যেসব আসনে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি খুবই খারাপ (সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, গডফাদার) প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে সেই সব আসনে নাগরিক কমিটি গঠন করে একজন সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে (স্বতন্ত্র) মনোনয়ন দানের ব্যবস্থা করা। আমাদের বিশ্বাস, এ ধরনের প্রার্থীকে সাধারণ নির্দল মানুষ তো সমর্থন দেবেই, এমনকি বিএনপি ও আওয়ামী লীগেরও অনেকে ভোট দিতে পারেন। কোনো কোনো আসনে নাগরিক কমিটির সমর্থিত প্রার্থী জিতেও যেতে পারেন।
এভাবে আমরা জাতীয় সংসদে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী বা গডফাদার ধরনের সদস্যকে ঠেকাতে পারব। তাও পারব খুব সীমিতভাবে। আমাদের সংসদীয় নির্বাচনী রাজনীতিতে দুটি বড় দল ও তাদের নির্বাচনী প্রতীক একটি বড় শক্তি। এর সঙ্গে সহায়ক হয়েছে গ্রামবাংলার বেশির ভাগ ভোটার রাজনৈতিকভাবে ততটা সচেতন নন। নির্বাচনে তাদের ঠেকানো প্রায় সহজ কাজ, যদি না তাহরির স্কোয়ার বা ওয়াল স্ট্রিট ধরনের বড় গণজাগরণ দেশে না ঘটে। বড় দুটি দলের অপশাসন যেভাবে পালা করে অতিবাহিত হচ্ছে, তাতে অনেকেই আশা করেন দেশের মানুষ আর পালা করে তাদের অপশাসন দেখার জন্য নিয়ম করে ভোট দেবেন না। সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। তারা যেকোনো সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ এ দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলে এবং ভারত-বিরোধিতার স্লোগান তুলে বেশিদিন বশ রাখা সম্ভব হবে না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন থেকে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েও তারা দেখতে চাইবে সুশাসন। তারা দেশের প্রকৃত অগ্রগতি দেখতে চায়। তারা চায় প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা। যোগ্য ও দক্ষ মন্ত্রিসভা। জাতীয় সংসদে গঠনমূলক বিতর্ক। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান। সন্ত্রাসী ও খুনোখুনির রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনের দৃঢ় ভূমিকা। অর্থনীতির অগ্রগতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ। দেশকে শিল্পায়িত করা ও তরুণ সমাজের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক কর্মোদ্যোগ। এ রকম আরও নানা ইতিবাচক পরিবর্তন তরুণ সমাজ দেখতে চায়। শুধু কথার মায়াজাল দিয়ে পাঁচ বছর পর পর ভোট চাইতে আসার এই কৌশল জনগণ বুঝে ফেলেছে। এগুলো কোনো কিছুই দুই বড় দলের শাসনকালে প্রত্যাশা অনুযায়ী দৃশ্যমান নয়।
যেহেতু বড় দুই দলের নেতৃত্ব ছাড়া এই মুহূর্তে কারও পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু বড় দুই দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দানে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। জেলা পর্যায়ে মনোনয়নের দাবি জোরদার করতে হবে। আমেরিকার ‘প্রাইমারির’ মতো মনোনয়ন-প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এভাবেই আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির দলীয় রাজনীতি কখন পরিচ্ছন্ন ও গণতান্ত্রিক হবে, কখন পারিবারিক প্রভাব ও একনায়কত্ব থেকে বেরিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল হয়ে উঠবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু আমরা ধারণা করতে পারি, দুই বড় দলে বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমানের পরিবারের কেউ যখন মূল নেতৃত্বে থাকার সুযোগ পাবেন না, তখন দল দুটিতে গুণগত গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সূচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তার আগে পর্যন্ত আমাদের এই অপরাজনীতি, অপশাসন, পরিবারতন্ত্র ও দলীয়করণ সংস্কৃতির মধ্যেই বসবাস করতে হবে বলেই আশঙ্কা হয়। যদি না তাহরির স্কোয়ার বা ওয়াল স্ট্রিটের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিরুদ্ধে একটা গণজাগরণ না ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই হতাশাজনক পটভূমিতে নাসিক নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয় একটা ক্ষীণ আশার রেখা। খুবই ক্ষীণ। তবে খুব সম্ভাবনাময়। এখন আমাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে এই আইভী মডেল প্রয়োগ করে রাজনীতিতে কিছুটা সুস্থতা আনার চেষ্টা করতে হবে। রাজনীতির মূল সমস্যা কিন্তু অনেক ব্যাপক। একসঙ্গে সমগ্র রাজনীতিকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয় বলে যেটুকু পারা যায় সেটুকু নিয়েই এগোতে হবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
No comments