দ্বিধা ও পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক ভাবনা by কামাল লোহানী
প্রধানমন্ত্রী ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, 'সংবিধান সংশোধনের পরও বিএনপির ন্যায্য প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে।' সংসদনেত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীকে কোনো কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহবান জানিয়েছেন। একই দিন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছিল একটি মীমাংসিত বিষয়। এ ইস্যু নিয়ে সংবিধান সংশোধনে ৫১ দফা সংশোধনী এনে সরকার দেশকে অশান্তি ও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।'
খালেদা জিয়া এও বলেছেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না জেনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়।'
অন্যদিকে ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক ফর্মুলা বের করেছে আওয়ামী লীগ। এ ফর্মুলা হলো, যারা ক্ষমতাসীন থাকবে, তারাই ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালের সরকার হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবে। কিন্তু বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপিরই কয়েকজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার যদি বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর তো জনগণের বিশ্বাস নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের তো নয়ই।' বিএনপির এক দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তবে এ নির্বাচন কমিশনের ওপরও তাদের, অর্থাৎ বিএনপির ভরসা নেই। নির্বাচন কমিশনারকেও তারা পাল্টাতে বলছে। আবার বিএনপি নির্বাচন পরিচালনায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করতেও আপত্তি জানিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সরকার যা করবে, তাতেই বোধ হয় তারা আপত্তি জানাবে। তাহলে তারা কী চাইছে?
বিএনপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপত্তি জানাচ্ছে। তারা কেবল নিজেদের সুবিধামতোই নির্বাচন করতে চাইছে। কিন্তু ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানের যে দুরবস্থা আমরা লক্ষ করেছি, তাতে কি জনগণ আদৌ আস্থা রাখতে পারবে এমন ধরনের নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধানকারীদের ওপর? বিএনপির যদি গণতন্ত্র বিষয়ে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থেকে থাকে, তাহলে পূর্বে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা মেনে নিতে হবে। আওয়ামী নেতারা তাঁদের বক্তৃতা ও মন্তব্যে বিএনপির দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং নানা ভাষায় বিরোধীদলীয় আচরণের সমালোচনা করেই চলেছেন। আলোচনায় বসার প্রস্তাবও দিয়েছেন এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই। কিন্তু বিএনপি নেতারা আলোচনার কোনো সুযোগ নেই বলে ওই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, পরিবেশ তৈরি করতে মহাজোট সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তারা আবার হরতাল দিল, কিন্তু মানুষের তেমন সমর্থন পেল না; দেখা গেল সন্ত্রাস-সহিংসতা। মানুষ ভয়ভীতিতে ঘরে সেঁধিয়ে রইল।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র তার কাছের এবং দূরের, প্রিয় এবং অপ্রিয়, পক্ষের কিংবা বিপক্ষের কাউকে জীবন নিশ্চিত-নির্ভয়ে কাটাতে দেয় না। বিন লাদেন হত্যার বিষয়টি নিয়েও কথা আছে।। যাকে ওরাই সৃষ্টি করেছিল এবং যখন দেখল, সে 'গুরু মারা বিদ্যা' শিখে ফেলেছে, তখনই তাকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে অবশেষে বহু চেষ্টার পর হত্যা করে ফেলে দিল। আল-কায়েদার যে নতুন নেতা নির্বাচিত হলো, তাকেও হত্যা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটাই হলো ওদের রাজনীতি। এদের লোক পাল্টায়, নীতি একই থাকে। যতই দল বদলাক না কেন লক্ষ্য সবারই এক। পাকিস্তান আমলে '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যখন আওয়ামী লীগ এবং তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসতে পারলেন না, তখন কিন্তু পাকিস্তানকে ক্ষমতা না দেওয়ার গোঁয়ার্তুমি ছাড়তে মার্কিনিরা কোনো প্রভাব খাটায়নি। বরং অবহেলিত-নির্যাতিত বাংলার মানুষ যখন একাট্টা হলো পাকিস্তানিদের কায়েমী স্বার্থবাদী নীতির বিরুদ্ধে এবং চূড়ান্ত যুদ্ধের ডাক এল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেই সাপোর্ট দিয়েছিল। চীনকেও মার্কিনিরা সহযোগী পেয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, যা আজও পীড়া দেয় আমাদের। সেই আমেরিকা তো মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিরুদ্ধে যাবেই। কিন্তু অন্যান্য দেশের মুক্তিসংগ্রামকে জব্দ করার জন্য মার্কিনিরা এভাবেই কুশলী হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ভড়ং ধরেছে, মুক্তিকামী মানুষকেই তারা সহায়তা করতে চায়। আর সেই সুবাদে ওই দেশের অঞ্চলসীমায় কৌশলে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাই তো আমরা দেখছি।
সুতরাং আমেরিকার মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলার কোনো তুলনা হয় না। যুদ্ধ না থাকলে আবার তাদের উৎপাদিত যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি হয় না, অর্থনীতিতে টান পড়ে। কারণ যুদ্ধাস্ত্র কারখানার মালিক হলেন মার্কিন রাজনীতিবিদরা। তাঁদের খুশি রাখতেই হবে। না হলে দেশ চলবে না। তাই যত প্রেসিডেন্টই আসুন না কেন, তাঁকে এ যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী পুঁজিপতির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। এ কারণেই মার্কিন প্রশাসকদের পবিত্র সমরবাজিও হয়। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে ডিক চেনি-র্যামসফিল্ডদের ভূত এদের ঘাড়ে চেপেই থাকে। তাই যাঁরা একবার মার্কিন শিবির ছেড়ে অন্যত্র যান, তাঁরা যতই ফিরে আসুন না কেন পূর্ব শিবিরে, তাঁকে তারা আর বিশ্বাস করতে চায় না। তাই অবিশ্বাসের জটাজাল ভাঙতে তাদের দৃষ্টিতে যদি কেউ 'দলছুট' হয় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে তাকে বাঁচিয়ে না রাখাটাই সমীচীন মনে করে শিবিরকর্তারা। তাকে মেরে ফেলে। সেই দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই এক নৃশংস-নির্মম ইতিহাস হয়ে আছে। তা হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরলেন। প্রথমেই তিনি লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে গেলেন ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগানে মুক্তিযুদ্ধ হওয়া এবং নতুন রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু তিনি জাতিকে যে সংবিধান দিয়েছিলেন, তাতে মূলনীতির অন্যতম স্তম্ভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু ইসলামী সম্মেলনে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন ক্যাম্প ত্যাগকে জায়েজ করতে পারেননি। সোভিয়েত বন্ধুতা এবং '৭১-এ মদদ দেওয়ায় যুদ্ধজয়ের যে সুবিধা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও যে ত্বরিত সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সহজ হয়েছিল। পূর্ববাংলায় গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগি্নসংযোগ করে যারা ক্ষয়ক্ষতি করেছিল, তাদের কোনো বিচার না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচারও হয়নি। বিলম্বে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে বর্তমান মহাজোট সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত দূর যে আমরা এগোতে পারব, তাও তো সরকার স্পষ্ট করে বলছে না। আমরা চাই, স্বচ্ছ বিচার ও অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি।
বিএনপি ঘোষণাই করে দিয়েছে, আর মধ্যবর্তী নির্বাচন নয়, এবার সরকার পতনের আন্দোলন। অর্থাৎ এক দফা_সরকার পতন। কী প্রচণ্ড 'আত্মবিশ্বাস'? এই দম্ভোক্তি কিসের জোরে করছেন বিএনপি নেতারা? কোনো আশ্বাস কেউ দিয়েছেন কি? না হলে এত তড়পাচ্ছেন কেন? নাকি পতন আন্দোলনের মুলা ঝুলিয়ে 'মধ্যবর্তী নির্বাচন'-এর দাবি থেকে সরে গেলেন? আর এ অবস্থান থেকে সরতে হলে জোরদার কিছু জনগণের সামনে বলা দরকার, তাই সরকার পতনের দাবিই তাঁরা তুলে ধরেছেন। আর দুই-আড়াই বছর আছে মহাজোট সরকারের। সংগঠনে যে ভাঙচুর, মতদ্বৈধতা, পারস্পরিক বিরোধ, এসবে জর্জরিত বিএনপি জামায়াতকে কাছে পেয়ে একটু তেজি মনে করছে নিজেদের। তাদের সঙ্গে করেই আন্দোলনের নামে হরতাল-বিক্ষোভ-সহিংসতা করে দেশে আবারও ১/১১-এর মতো কিছু একটা তারা কি ঘটাতে চায়? বিএনপি তো সংসদে বিরোধী দল। তাদের সংসদ সদস্যরা বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা রীতিমতো নিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রমণে যে কনসেশন পাচ্ছেন, তাও ছাড়ছেন না। সব কিছুই ভোগ করছেন। তাঁরা যে কারণে নির্বাচিত হয়েছেন, সংসদে গিয়ে জনগণের সুখ-দুঃখের কথা বলতে, কেবল সেটাই করছেন না। অর্থাৎ যাদের ভোটে তাঁরা নির্বাচিত, তাদের অপমান করছেন। সংসদকে অবমাননা করেই চলেছেন। তাঁরা সরকারের ভালো-মন্দ সব বিষয়েই কেবল 'না' বলে চলেছেন। বিএনপি ইতিপূর্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিল, তারাই আবার কিসের স্বাদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্য হন্যে হয়ে গেল? কারণ তারা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে যে মজা পেয়েছিল, তা ভোগ করতে পারেনি। তাই গণতান্ত্রিক পথ ধরে নির্বাচন হতে তারা দেবে না। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাবেন না, এটা রাজনৈতিক দুর্নীতি। সুযোগ-সুবিধা সবই নিচ্ছেন, সেটা হলো অর্থনৈতিক দুর্নীতি।
এমনটি তো কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো চিত্র নয়। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, আর মনে মনে গণতন্ত্র বধের ভাবনা ভাববেন_এ তো হতে পারে না। সংবিধান সংশোধন হয়েছে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এ দেশে এযাবৎ যতবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে তা কতটা জনস্বার্থে কিংবা জনকল্যাণের কথা ভেবে, এ প্রশ্নের জবাব কী? অবৈধ শাসকরা নিজেদের স্বার্থে সংবিধানের গায়ে ছুরি চালিয়েছেন। এবারকার সংশোধনীর পরও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাহাত্তরে প্রণীত সংবিধান আমরা পাইনি। বর্তমান শাসকরা কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে অঙ্গীকার করেছিলেন বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনবেন। কেন তাঁরা তা পারলেন না? এখানেও ক্ষমতার রাজনীতিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এ দেশের জন্ম-ইতিহাস তাঁদের জানা। তাঁরাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। গৌরবের ইতিহাসের অংশীদার। যারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অতীতে ক্ষমতা থাকতে চেয়েছে এবং এর জন্য নানা রকম ঘৃণ্য কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না? এ সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনাধারী সরকার। এ সরকারের মধ্যে আমরা এসব বিষয়ে দোদুল্যমানতা লক্ষ করব কেন? কেন এ সরকারও সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না? প্রাক-নির্বাচন তারা যেসব অঙ্গীকার করেছিল এর ফলেই তো তারা বিপুল জনরায় নিয়ে ক্ষমতা আসতে পেরেছে। পরিবর্তনকামী মানুষ তো তাদের সঙ্গেই আছেন।
তবে কেন দ্বিধা? নিশ্চয়ই আমরা এ জন্য আহত।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
অন্যদিকে ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক ফর্মুলা বের করেছে আওয়ামী লীগ। এ ফর্মুলা হলো, যারা ক্ষমতাসীন থাকবে, তারাই ৯০ দিনের অন্তর্বর্তীকালের সরকার হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবে। কিন্তু বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপিরই কয়েকজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার যদি বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওপর তো জনগণের বিশ্বাস নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের তো নয়ই।' বিএনপির এক দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তবে এ নির্বাচন কমিশনের ওপরও তাদের, অর্থাৎ বিএনপির ভরসা নেই। নির্বাচন কমিশনারকেও তারা পাল্টাতে বলছে। আবার বিএনপি নির্বাচন পরিচালনায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করতেও আপত্তি জানিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান সরকার যা করবে, তাতেই বোধ হয় তারা আপত্তি জানাবে। তাহলে তারা কী চাইছে?
বিএনপি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আপত্তি জানাচ্ছে। তারা কেবল নিজেদের সুবিধামতোই নির্বাচন করতে চাইছে। কিন্তু ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তত্ত্বাবধানের যে দুরবস্থা আমরা লক্ষ করেছি, তাতে কি জনগণ আদৌ আস্থা রাখতে পারবে এমন ধরনের নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধানকারীদের ওপর? বিএনপির যদি গণতন্ত্র বিষয়ে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থেকে থাকে, তাহলে পূর্বে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা মেনে নিতে হবে। আওয়ামী নেতারা তাঁদের বক্তৃতা ও মন্তব্যে বিএনপির দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং নানা ভাষায় বিরোধীদলীয় আচরণের সমালোচনা করেই চলেছেন। আলোচনায় বসার প্রস্তাবও দিয়েছেন এই তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই। কিন্তু বিএনপি নেতারা আলোচনার কোনো সুযোগ নেই বলে ওই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, পরিবেশ তৈরি করতে মহাজোট সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তারা আবার হরতাল দিল, কিন্তু মানুষের তেমন সমর্থন পেল না; দেখা গেল সন্ত্রাস-সহিংসতা। মানুষ ভয়ভীতিতে ঘরে সেঁধিয়ে রইল।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র তার কাছের এবং দূরের, প্রিয় এবং অপ্রিয়, পক্ষের কিংবা বিপক্ষের কাউকে জীবন নিশ্চিত-নির্ভয়ে কাটাতে দেয় না। বিন লাদেন হত্যার বিষয়টি নিয়েও কথা আছে।। যাকে ওরাই সৃষ্টি করেছিল এবং যখন দেখল, সে 'গুরু মারা বিদ্যা' শিখে ফেলেছে, তখনই তাকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে অবশেষে বহু চেষ্টার পর হত্যা করে ফেলে দিল। আল-কায়েদার যে নতুন নেতা নির্বাচিত হলো, তাকেও হত্যা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটাই হলো ওদের রাজনীতি। এদের লোক পাল্টায়, নীতি একই থাকে। যতই দল বদলাক না কেন লক্ষ্য সবারই এক। পাকিস্তান আমলে '৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যখন আওয়ামী লীগ এবং তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ক্ষমতায় বসতে পারলেন না, তখন কিন্তু পাকিস্তানকে ক্ষমতা না দেওয়ার গোঁয়ার্তুমি ছাড়তে মার্কিনিরা কোনো প্রভাব খাটায়নি। বরং অবহেলিত-নির্যাতিত বাংলার মানুষ যখন একাট্টা হলো পাকিস্তানিদের কায়েমী স্বার্থবাদী নীতির বিরুদ্ধে এবং চূড়ান্ত যুদ্ধের ডাক এল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেই সাপোর্ট দিয়েছিল। চীনকেও মার্কিনিরা সহযোগী পেয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, যা আজও পীড়া দেয় আমাদের। সেই আমেরিকা তো মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিরুদ্ধে যাবেই। কিন্তু অন্যান্য দেশের মুক্তিসংগ্রামকে জব্দ করার জন্য মার্কিনিরা এভাবেই কুশলী হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ভড়ং ধরেছে, মুক্তিকামী মানুষকেই তারা সহায়তা করতে চায়। আর সেই সুবাদে ওই দেশের অঞ্চলসীমায় কৌশলে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাই তো আমরা দেখছি।
সুতরাং আমেরিকার মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলার কোনো তুলনা হয় না। যুদ্ধ না থাকলে আবার তাদের উৎপাদিত যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি হয় না, অর্থনীতিতে টান পড়ে। কারণ যুদ্ধাস্ত্র কারখানার মালিক হলেন মার্কিন রাজনীতিবিদরা। তাঁদের খুশি রাখতেই হবে। না হলে দেশ চলবে না। তাই যত প্রেসিডেন্টই আসুন না কেন, তাঁকে এ যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী পুঁজিপতির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। এ কারণেই মার্কিন প্রশাসকদের পবিত্র সমরবাজিও হয়। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষে ডিক চেনি-র্যামসফিল্ডদের ভূত এদের ঘাড়ে চেপেই থাকে। তাই যাঁরা একবার মার্কিন শিবির ছেড়ে অন্যত্র যান, তাঁরা যতই ফিরে আসুন না কেন পূর্ব শিবিরে, তাঁকে তারা আর বিশ্বাস করতে চায় না। তাই অবিশ্বাসের জটাজাল ভাঙতে তাদের দৃষ্টিতে যদি কেউ 'দলছুট' হয় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে তাকে বাঁচিয়ে না রাখাটাই সমীচীন মনে করে শিবিরকর্তারা। তাকে মেরে ফেলে। সেই দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই এক নৃশংস-নির্মম ইতিহাস হয়ে আছে। তা হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরলেন। প্রথমেই তিনি লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে গেলেন ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগানে মুক্তিযুদ্ধ হওয়া এবং নতুন রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু তিনি জাতিকে যে সংবিধান দিয়েছিলেন, তাতে মূলনীতির অন্যতম স্তম্ভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু ইসলামী সম্মেলনে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন ক্যাম্প ত্যাগকে জায়েজ করতে পারেননি। সোভিয়েত বন্ধুতা এবং '৭১-এ মদদ দেওয়ায় যুদ্ধজয়ের যে সুবিধা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রেও যে ত্বরিত সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সহজ হয়েছিল। পূর্ববাংলায় গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগি্নসংযোগ করে যারা ক্ষয়ক্ষতি করেছিল, তাদের কোনো বিচার না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাদের বিচারও হয়নি। বিলম্বে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে বর্তমান মহাজোট সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত দূর যে আমরা এগোতে পারব, তাও তো সরকার স্পষ্ট করে বলছে না। আমরা চাই, স্বচ্ছ বিচার ও অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি।
বিএনপি ঘোষণাই করে দিয়েছে, আর মধ্যবর্তী নির্বাচন নয়, এবার সরকার পতনের আন্দোলন। অর্থাৎ এক দফা_সরকার পতন। কী প্রচণ্ড 'আত্মবিশ্বাস'? এই দম্ভোক্তি কিসের জোরে করছেন বিএনপি নেতারা? কোনো আশ্বাস কেউ দিয়েছেন কি? না হলে এত তড়পাচ্ছেন কেন? নাকি পতন আন্দোলনের মুলা ঝুলিয়ে 'মধ্যবর্তী নির্বাচন'-এর দাবি থেকে সরে গেলেন? আর এ অবস্থান থেকে সরতে হলে জোরদার কিছু জনগণের সামনে বলা দরকার, তাই সরকার পতনের দাবিই তাঁরা তুলে ধরেছেন। আর দুই-আড়াই বছর আছে মহাজোট সরকারের। সংগঠনে যে ভাঙচুর, মতদ্বৈধতা, পারস্পরিক বিরোধ, এসবে জর্জরিত বিএনপি জামায়াতকে কাছে পেয়ে একটু তেজি মনে করছে নিজেদের। তাদের সঙ্গে করেই আন্দোলনের নামে হরতাল-বিক্ষোভ-সহিংসতা করে দেশে আবারও ১/১১-এর মতো কিছু একটা তারা কি ঘটাতে চায়? বিএনপি তো সংসদে বিরোধী দল। তাদের সংসদ সদস্যরা বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা রীতিমতো নিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রমণে যে কনসেশন পাচ্ছেন, তাও ছাড়ছেন না। সব কিছুই ভোগ করছেন। তাঁরা যে কারণে নির্বাচিত হয়েছেন, সংসদে গিয়ে জনগণের সুখ-দুঃখের কথা বলতে, কেবল সেটাই করছেন না। অর্থাৎ যাদের ভোটে তাঁরা নির্বাচিত, তাদের অপমান করছেন। সংসদকে অবমাননা করেই চলেছেন। তাঁরা সরকারের ভালো-মন্দ সব বিষয়েই কেবল 'না' বলে চলেছেন। বিএনপি ইতিপূর্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিল, তারাই আবার কিসের স্বাদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্য হন্যে হয়ে গেল? কারণ তারা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে যে মজা পেয়েছিল, তা ভোগ করতে পারেনি। তাই গণতান্ত্রিক পথ ধরে নির্বাচন হতে তারা দেবে না। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।
নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাবেন না, এটা রাজনৈতিক দুর্নীতি। সুযোগ-সুবিধা সবই নিচ্ছেন, সেটা হলো অর্থনৈতিক দুর্নীতি।
এমনটি তো কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো চিত্র নয়। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলবেন, আর মনে মনে গণতন্ত্র বধের ভাবনা ভাববেন_এ তো হতে পারে না। সংবিধান সংশোধন হয়েছে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এ দেশে এযাবৎ যতবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে তা কতটা জনস্বার্থে কিংবা জনকল্যাণের কথা ভেবে, এ প্রশ্নের জবাব কী? অবৈধ শাসকরা নিজেদের স্বার্থে সংবিধানের গায়ে ছুরি চালিয়েছেন। এবারকার সংশোধনীর পরও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাহাত্তরে প্রণীত সংবিধান আমরা পাইনি। বর্তমান শাসকরা কিন্তু ক্ষমতায় আসার আগে অঙ্গীকার করেছিলেন বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনবেন। কেন তাঁরা তা পারলেন না? এখানেও ক্ষমতার রাজনীতিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এ দেশের জন্ম-ইতিহাস তাঁদের জানা। তাঁরাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। গৌরবের ইতিহাসের অংশীদার। যারা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অতীতে ক্ষমতা থাকতে চেয়েছে এবং এর জন্য নানা রকম ঘৃণ্য কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না? এ সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনাধারী সরকার। এ সরকারের মধ্যে আমরা এসব বিষয়ে দোদুল্যমানতা লক্ষ করব কেন? কেন এ সরকারও সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না? প্রাক-নির্বাচন তারা যেসব অঙ্গীকার করেছিল এর ফলেই তো তারা বিপুল জনরায় নিয়ে ক্ষমতা আসতে পেরেছে। পরিবর্তনকামী মানুষ তো তাদের সঙ্গেই আছেন।
তবে কেন দ্বিধা? নিশ্চয়ই আমরা এ জন্য আহত।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments