জনদুর্ভোগের অপর নাম সড়ক যোগাযোগ by জে বি বড়ুয়া

বলার অপেক্ষা রাখে না, সুষুম যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য কতখানি জরুরি। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বিপত্তিহীন দ্রুত যাতায়াত আধুনিক জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ। সরকারি টেলিভিশন ও নেতা-নেত্রীদের কথা শুনলে মনে হয়, দেশে কোনো সমস্যা নেই, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে।


এদিকে পত্রপত্রিকার পাতায় দেখি, দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, চলছে জনগণের চরম ভোগান্তি। দেশের সড়ক ব্যবস্থার এ রকম বেহাল অবস্থা আর কোনো সময়ে হয়েছে বলে মনে হয় না। কর্মজীবনে সুদীর্ঘ ৩৩ বছর সড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কাটিয়ে আজ থেকে ১২ বছর আগে সড়ক ও জনপথের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর নিয়েছিলাম। সড়ক ব্যবস্থা সম্পর্কে খারাপ বা নেতিবাচক কিছু শুনলে বা দেখলে আজও মন খারাপ হয়ে যায়। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, দেশের প্রায় সব প্রধান প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, যশোর-খুলনা, খুলনা-সাতক্ষীরা, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী-পাবনা, চট্টগ্রাম-আনোয়ারা-পটিয়া ইত্যাদি সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা। ইতিমধ্যে কয়েকটি সড়কে যানবাহন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। জনগণের দুর্ভোগ চরম সীমায়। ট্রেনের টিকিটের জন্য পড়েছে হাহাকার। সড়কের এ অবস্থা নিশ্চয়ই একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সময়মতো যুথোপযোগী ব্যবস্থা নিলে এই হাল হতো না। পাকিস্তান আমলে যখন সড়ক ও জনপথে যোগ দিই, তখন দেখেছি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সবাই সড়ক উন্নয়নের চেয়ে সড়ক মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের ওপর বেশি নজর দিতেন। তখন সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার বা ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার (তখন এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পদ সৃষ্টি হয়নি) সড়ক পরিদর্শনে গেলে দেখতেন সড়কে কোথাও কোনো 'পট-হোল' আছে কি না। কারণ, সময়মতো মেরামত করা না হলে একটা ছোট পট-হোলই বাড়তে বাড়তে বিরাট আকার ধারণ করে এবং একসময় রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সড়কের ৮-১০ কিলোমিটারের দায়িত্বে থাকত একজন কার্যসহকারী। তার অধীনে থাকত ৮-১০ জন সড়ক শ্রমিক। তারা অধিকাংশই হতো স্থানীয়। সড়ক সেকশনের দায়িত্বে নিয়োজিত উপসহকারী প্রকৌশলী খুব ভোরে উঠে একটা পিক-আপ বা ছোট ট্রাকে করে সড়ক মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল তথা বিটুমিন, পাথর, বালি ও বিটুমিন গরম করার জন্য লাকড়ি বিভিন্ন স্থানে পেঁৗছে দিত। রাস্তার ধারে গর্ত করে চুলা বানিয়ে বিটুমিন-ড্রামে বিটুমিন গরম করা হতো। তারপর কার্যসহকারীর নেতৃত্বে শ্রমিকরা মেরামত কাজে লেগে যেত। বিকালে কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার পিক-আপে করে বেচে যাওয়া মালামাল ও শ্রমিকদের তুলে আনা হতো। পরে বিটুমিন গরম করার জন্য খোলা ড্রামের পরিবর্তে বিটুমিন-হিটার ব্যবহার করার ব্যবস্থা চালু হয়। উপবিভাগীয় প্রকৌশলী প্রায়ই এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মাঝেমধ্যে এ কাজ তদারকি করতেন। সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের এ ব্যবস্থা খুবই কার্যকর ছিল। কিন্তু এখন সে ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উঠে গেছে। অথচ কার্যকর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। সেটি হলো_এখন শতকরা ৯৫ জন কর্মকর্তা পরিবার-পরিজন নিয়ে কর্মস্থলে থাকেন না, সবার ঠিকানা ঢাকা। রবিবার দুপুরে কর্মস্থলে পেঁৗছেন আর বৃহস্পতিবার দুপুরে কর্মস্থল ত্যাগ করেন। যাঁরা একটু উপরের দিকের কর্মকর্তা তাঁরা নানা অজুহাতে সপ্তাহের বেশির ভাগ কর্মদিবসে ঢাকায় অবস্থান করেন। কারো সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হেডকোয়ার্টার ত্যাগের অনুমতি নিতে হয় না। ঢাকার আশপাশে যাদের পোস্টিং, তারা তো ঢাকায় বসে মোবাইল ফোনে কাজ সারেন। তাই এখন রাস্তাঘাটে বের হলে কোথাও সড়ক ও জনপথের নিজস্ব কর্মচারীদের দ্বারা কোনো মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চোখে পড়ে না। সব কাজ এখন ঠিকাদারের মারফত করানো হয়। কারণ সহজেই বোধগম্য। সড়ক যত বেশি খারাপ অবস্থায় যাবে, টেন্ডারের আকার তত বড় হবে। এদিকে যোগাযোগমন্ত্রী মহোদয় পাতাল রেল, আকাশ রেল, মহাসড়ক ও মহাসেতু নিয়ে মহাব্যস্ত। সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কই। সাধারণ লোকের দুর্ভোগ তো সাধারণ ব্যাপার।
কয়েক দিন আগে আমার এক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, যাঁকে সড়ক ও জনপথের সবচেয়ে সুযোগ্য ও সৎ প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গণ্য করা হয়, আমার সঙ্গে ফোনে বলেন, 'একসময় সড়ক ও জনপথের প্রধান প্রকৌশলী ছিলাম, সেটা গৌরবের না হয়ে এখন লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
বর্তমান শাসকদল যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসে, তখনকার কথা একটু না বললে নয়। আমি তখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করে আমাকে প্রকল্প থেকে উইথড্র করে খুলনায় বদলি করা হয়। কারণ জানি না। এই বদলির আদেশ বাতিল করার জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত তৎকালীন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আমার খুব প্রশংসা করে মন্ত্রণালয়ে এক দীর্ঘ চিঠি দেন। যদিও অতখানি প্রশংসার আমি যোগ্য ছিলাম না। মন্ত্রণালয় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের চিঠিরও মর্যাদা দেয়নি। আমিও আমার নীতি অনুযায়ী বদলি বাতিলের জন্য কোনো তদবির করিনি। তথাপি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, 'আমি যেন তদবির না করি, কারণ সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে এটা চাওয়া হয়েছে।' পরে খুলনায় এসে এর মাজেজা শুনলাম, যা অত্যন্ত বিস্ময়কর ও প্রশ্নবোধক।
খুলনায় এসে আরো এক অভিজ্ঞতা হয়। খুলনায় কাজে যোগ দেওয়ার পরে দেখি কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের অপতৎপরতা। একদিন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আমার রেস্ট হাউসে এসে জানিয়ে যায়, অমুক কাজটি তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে পাওয়ার ব্যবস্থা করে না দিলে পরিণাম ভালো হবে না। আমি তাদের বলে দিলাম, 'এ কাজ আমি জীবনে করিনি, জীবনের বিনিময়েও এ কাজ আমার দ্বারা হবে না।' দেখলাম এই রাজনৈতিক পরিবেশে আমার পক্ষে মান-সম্মান নিয়ে আর চাকরি করা সম্ভব নয়। আমার প্রতি সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানাতে এবং কলুষিত রাজনৈতিক পরিবেশে মান-সম্মান বাঁচাতে আরো এক বছর চাকরির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও ৩৩ বছরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সরে পড়ি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, সড়ক ও জনপথ দপ্তর
baruajb@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.