একজন ডিসি ও একজন পিয়ন by মাহবুব মোর্শেদ
'ডিসির কাছ থেকে ঘুষ দাবি : পিয়ন গ্রেফতার।' সমকালের শেষ পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে খবরটি। শুক্রবারের সংখ্যায়। শিরোনামই বলে দেয় খবরটি কৌতূহলোদ্দীপক। অবশ্যই ঘুষ দেওয়া-নেওয়া আমাদের সমাজে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার নয়। প্রয়োজনের কাজটি করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়নি বা ঘুষ দিতে বাধ্য হননি বা ঘুষ না দিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।
আর কে না জানে, অধিকাংশ ভোগান্তির ঘটনা ঘটে সরকারি অফিসগুলোতে। কর্মকর্তা-কর্মচারী তো বটেই কোনো কোনো অফিসে পিয়ন পর্যন্ত উৎকোচ ভোগ করতে অভ্যস্ত। ঘুষ ছাড়া ফাইল এগোয় না। কোনো অবস্থায় ঘুষ না হলে ফাইল হারিয়ে যায়। অনুরোধ-উপরোধ, তদবিরে যখন কাজ হয় না তখন লোকে বুঝে যায় কাজ আদায়ের সহজ পদ্ধতি হলো ঘুষ। অবস্থাভেদে অঙ্কটা বাড়ে আবার কমেও। অনেক সময় ছোট কাজে বড় ভোগান্তি আর বড় কাজে ছোট ভোগান্তির অভিজ্ঞতাও হয়। লোকে রসিকতা করে কোনো কোনো অফিস সম্পর্কে বলেন যে, এ অফিসের চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ঘুষ খায়। কোথাও কোথাও নাকি চেয়ার-টেবিল গুণে ঘুষ দিতে হয়। অফিসপাড়ার নিয়মিত যাত্রীদের কাছে তাই ঘুষ অবাক করার ব্যাপার নয়। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব যদি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কাছেই আসে তা নিশ্চয়ই অবাক করার ব্যাপার। আর সে ঘুষ যদি একজন পিয়ন দাবি করেন তবে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। দেশে তবে নিয়মনীতি বলে কিছু থাকল? কার কাছ থেকে কে ঘুষ চাইতে পারেন তেমন কোনো নিয়ম থাকার কথা নয়। তাই বলে যে কেউ যে কারও কাছ থেকে ঘুষ দাবি করবেন? পদোন্নতি প্রার্থী ডেপুটি কমিশনারের কাগজপত্রে কিছু সমস্যা ছিল। আর এ সমস্যা মেটাতে তার কাছ থেকে ঘুষ দাবি করে বসলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক পিয়ন। রীতিনীতি বলে আর কিছু থাকল? কাগজপত্রে সমস্যা থাকতেই পারে, সে সমস্যা মেটানোও যেতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন। ক্ষেত্রবিশেষে ঘুষের কথাও উঠতে পারে। কিন্তু কার কাছে কে ঘুষ চাইবেন? ডিসির কাছে পিয়ন? পিয়নের এমন দৌরাত্ম্য হয় কী করে? নিশ্চিতভাবেই পিয়নের সঙ্গে আরও লোকজন নিশ্চয় আছেন। যদি থেকেই থাকেন তবে একটু ঊর্ধ্বতন কাউকে দায়িত্বটা দেওয়া যেত না? পদের সম্মান আছে, পদের অধিকার আছে। সেটুকু রক্ষা তো করতে হবে। যাই হোক, পিয়ন ঘুষ দাবি করায় বিক্ষুব্ধ ডিসি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এতে টনক নড়েছে। কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পিয়ন ধরা পড়েছে। এই সৎসাহসের জন্য ডিসিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কিন্তু পিয়নের কী হবে? পিয়নের ক্ষমতা যারা জুগিয়েছেন তাদেরই-বা কী হবে? আদৌ কি তাদের নাম জানা যাবে কখনও? নাকি বরাবরের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন তারা? অভিজ্ঞতায় বলে, সরকারি কর্মকর্তাদের ভোগান্তি শুরু হয় অবসর গ্রহণের পর পেনশন ও পাওনা তুলতে গিয়ে। যে অফিসে এতকাল কাজ করেছেন সে অফিসেই হেনস্তা হতে হয়। উৎকোচ গুনতে হয়। ক্ষমতা হারানোর পর ক্ষমতাধরদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এতকাল এসবই গল্প আকারে শুনেছি আমরা। এখন দেখা যাচ্ছে, চাকরিরত অবস্থাতেও ঘুষের টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। রাজধানীর ঊর্ধ্বতন অফিসের পিয়ন পর্যন্ত টাকা চেয়ে হেনস্তা করছেন তাদের। পরিস্থিতিটা দুঃখজনক। কিন্তু পরিস্থিতিটা কি সরকারি কর্মকর্তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট? তারা কি এখন একজোট হয়ে নিজেদের ও অপরের ভোগান্তি দূর করার উদ্যোগ নেবেন? নাকি চলতে থাকবে যেমন চলছে এখন?
No comments