এই মৃত্যু কি আমাদের কিছু শেখায় by তারেক শামসুর রেহমান

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যু কি আমাদের কিছু শেখায়? গত ১৩ আগস্টের ওই দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর যখন এই নিবন্ধটি লিখছি, তখন এ প্রশ্নটাই আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে_ওই মৃত্যু আমাদের কিছু শিখিয়েছে কি না? না, কিছুই শেখায়নি। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর দুজনই ভিআইপি,


সমাজে তাঁদের একটা অবস্থান ছিল। যে কারণে ওই দুর্ঘটনার খবর পরদিন সব পত্রিকায় শুধু প্রধান সংবাদ শিরোনামই হয়নি, বরং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী_সবাই শোক প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ভিআইপি বলেই আলোচিত হয়েছে বেশি করে। সাধারণ একজন মানুষ যদি এভাবে দুর্ঘটনায় মারা যেত, তাকে নিয়ে আদৌ কোনো দিন আলোচনা হতো না। এভাবে তো কত দুর্ঘটনাই ঘটে। তার কয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হয়? কয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা আলোচনা করেন? সংবাদপত্রগুলো আমাদের পরিসংখ্যান দিচ্ছে কোন বছর কত লোক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। টিভি টকশোতে বিজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনা করছেন। নিবন্ধ লিখছেন কেউ কেউ। তারপর? নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীকে হারিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুব কি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি? মনে হয় না তিনি পেরেছেন। আসলে যে কাজটি করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা সেই কাজটি করছেন না। গত ১৭ আগস্ট মানিকগঞ্জের ওই সড়ক দুর্ঘটনার ঠিক চার দিন পর আমি যখন আরিচা সড়ক ধরে নিত্যদিনের মতো আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগরে যাচ্ছি, দেখলাম ঠিক একই চিত্র। চালকরা ওভারটেক করছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। অবলীলায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে রং সাইডে, যে পথে যাওয়ার তার আদৌ কথা নয়। হেমায়েতপুর, সাভার বাজার, সেই একই চিত্র। ট্রাফিক পুলিশের কাজটি হচ্ছে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা। তারা তা করছেন না। হেমায়েতপুর বাজারে দেখলাম দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন (তিনি কি ঈদ বখশিশ আদায় করছিলেন!)। সাভার বাজারে সেই পুরনো দৃশ্য_রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছে, আর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ নির্বিকার। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন না। একটু সামনে গেলেই একটা পাক। দেখলাম সেখানে সেই প্রতিযোগিতা_কে কার আগে যাবে! কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ দৃশ্য আমাকে সপ্তাহে একাধিক দিন দেখতে হয়। কেননা এ রুট ধরেই আমি আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করি। উপযাচক হয়ে অতীতে একাধিক দিন সাভার এলাকায় দায়িত্ব পালনরত সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। না, কিছুই হয়নি। কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমনটা ছিল দুদিন আগেও, তেমনটিই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই ওভারটেকিং, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন না করা, ভুল পথে চালকদের গাড়ি চালানো_সব কিছুই আগের মতো। গত ১৭ আগস্ট ঢাকা-আরিচা রোডের এই ছিল দৃশ্য। এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, যেখানে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো, সেখানে এতটুকুও সচেতন হলেন না যাঁদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তাঁরা। ওই মৃত্যু তাঁদের এতটুকুও স্পর্শ করেনি। আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি? আর কত নিবন্ধ লিখলে আমরা সচেতন হব? মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডির ঘাতক বাসচালক জামির হোসেন যখন ডিবি অফিসে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান তিনি নির্দোষ, তখন সত্যি সত্যিই আমার ভাবতে কষ্ট লাগে, আমরা এ কোন দেশে বসবাস করছি! ঘাতক চালক জামির হোসেনের কথার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী তো 'আবিষ্কার' করেছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকও দায়ী! কী অদ্ভুত এক দেশ! যে ঘাতক পাঁচজনকে হত্যা করল, হত্যা সংঘটিত করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ না করে পালিয়ে গেল, সে কি না বলছে আমি নির্দোষ! আর বলছে কোথায়? ডিবি অফিসে, পুলিশের সম্মুখে। কী জানি, পুলিশ কি এ কথা বলতে তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল! না হলে জামির এত সাহস পেল কোথায়? আমি জানি না, পুলিশ কোন ধারায় মামলা করবে? কিংবা তদন্ত রিপোর্টে কী দেবে? তবে আমি বুঝি এটা একটা হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হওয়া উচিত। না হলে ঘাতক বাসচালকরা এতটুকু সচেতন হবে না। ১৭ আগস্টও যখন আমি আরিচা রোডে বাসচালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে দেখি, তখন আমার কাছে এ প্রশ্নটাই মুখ্য। হত্যাকাণ্ডের আইনেই এর বিচার হতে হবে। আমাদের 'বিবেক' আইনজীবীরা দয়া করে জামির হোসেনের পাশে দাঁড়াবেন না। আপনারা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, যাতে আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখতে পারি।
আর সাংবাদিক মুন্নী সাহা, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার আমন্ত্রণে আপনার টকশোতে আমি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। কালের কণ্ঠে লিবিয়ার ওপর আমার লেখা পড়ে আপনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিশুক মুনীরের সঙ্গে। আমরা চা পান করতে করতে সেদিন অনেক আলাপ করেছিলাম। পররাষ্ট্রসচিবও ছিলেন আমাদের আলোচনায়। মিশুক মুনীর আমাকে আবারও এটিএনে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার আর মিশুকের সঙ্গে আমার চা পান করা হয়নি। মুন্নী, আমাকে ক্ষমা করবেন_আমরা যারা ছাত্র পড়াই, রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কোনো ভূমিকা নেই, ঘাতক জামিরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। টিভি পর্দায় আপনার সহকর্মীসহ মুন্নী আপনার কান্নার দৃশ্যও আমি দেখেছি, আমি নিজেও আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমি শুধু ভেবেছি মিশুক, আপনার জীবনটা এত ছোট কেন হলো? আপনার বাবাও ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তার বিচার হয়নি। আপনিও প্রাণ হারালেন এক ঘাতকের হাতে। হয়তো এই ঘাতকেরও বিচার হবে না! যে ঘাতক অনেকটা হাসিমুখে ডিবি অফিসে 'ফটোসেশন' করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে_এটা আশা করতে পারি না। আমাকে ক্ষমা করবেন মুন্নী। মুন্নী, আপনি অনুসন্ধান করে দেখুন, অর্থমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ড্রাইভারদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করে একটি আইন হচ্ছে। এটা ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। আমি তখন একট নিবন্ধও লিখেছিলাম (হাইওয়ে : জীবনের নিরাপত্তা যেখানে অনুপস্থিত, যায়যায়দিন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।
তারপর ১৮ মাস পার হয়েছে। ওই আইনটি হয়নি। কেন হয়নি, মুন্নী সাহা, আপনি অনুসন্ধান করুন। আজ মিশুক মুনীরের স্ত্রী যখন রাজনীতিবিদদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন যেন তিনি আমাদের সবার কথাই বলেন। আজ যখন সংবাদপত্রে ছাপা হয় মন্ত্রীর নির্দেশে কয়েক হাজার অদক্ষ চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তখন আমাকে এক বড় ধরনের হতাশার মাঝে ফেলে দেয়। আমি আর কারো ওপর আস্থা রাখতে পারি না।
হাইওয়েগুলো একেকটি মৃত্যুকূপ। এই হাইওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন থাই কূটনীতিক পানি্ন লিবানাজুলসহ বাংলাদেশ সরকারের দুজন সচিব। আহত হয়েছিলেন সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানসহ হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু ঘাতকদের কারোরই সুষুম বিচার হয়নি। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে ঘাতক পানি্ন লিবানাজুল কিংবা দুজন সাবেক সচিবকে যারা হত্যা করেছিল, তারা এখনো হাইওয়েতে গাড়ি চালায়। হত্যাকাণ্ডের বিচার মাত্র তিন বছরের জেল! এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তারেক ও মিশুকের মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠিয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আমরা আদৌ সচেতন হইনি। আর যাঁদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তাঁরা গা-ছাড়াভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের কিছুই শেখায় না। আমরা কিছুই শিখি না।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.