শ্রদ্ধাঞ্জলি-রণদা প্রসাদ স্মরণ
৬ নভেম্বর রোববার ছিল উত্থান একাদশী তিথি, জ্যাঠামণির (রণদা প্রসাদ সাহার) ১১৫তম জন্মজয়ন্তী। এ উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও রণদার পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গ্রামবাসী আয়োজন করেছিল এক অনুষ্ঠানের। রণদার কথা, ভক্তিমূলক গান, বাহারি রঙের বেলুন আর শত মোমের আলোয় আলোকিত ছিল সেদিনের সেই রণদা নাটমন্দির।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নটর ডেম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফাদার জে এস পিশাতো সিএসসি, রণদা প্রসাদ সাহার একমাত্র পৌত্র ও কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা, বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ। আলোচনা সভার পর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
রণদা প্রসাদ সাহাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ছোটবেলা থেকেই ঠাকুরমা-ঠাকুরদা ও পিসি-মাসির কাছে তাঁর কথা অনেক শুনে আসছি। শুনেছি তাঁর কৃতিত্বের কথা; শুনেছি তাঁর মানবসেবা ও মানবপ্রেমের কথা। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম তাঁর কথা বা তাঁর সম্পর্কে কতটুকু জানে?
১৩০২ বঙ্গাব্দের (১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর) উত্থান একাদশী তিথিতে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার, মা কুমুদিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথের সন্তানদের মধ্যে রণদা প্রসাদ ছিলেন দ্বিতীয়।
রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক নিবাস ছিল সাবেক ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের মহকুমা শহরের লাগোয়া মির্জাপুর গ্রামে। তাঁর বাবার স্থায়ী কোনো পেশা ছিল না। কখনো দলিল লেখকের কাজ, আবার কখনো লগ্নির ব্যবসাও করতেন। রণদা প্রসাদ তাঁর মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না-ধরতেই মা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেন। অভারের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন তো দূরে থাক, উপযুক্ত আহারও সময়মতো জোটেনি। তাঁর গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে তিনি একজন চিকিৎসকও পাননি কিংবা অর্থের অভাবেও চিকিৎসক আনতে পারেননি। প্রসবকালে অকালেই মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। প্রসূতি মায়ের মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিলেন সাত বছরের বালক রণদা প্রসাদ। রণদা প্রসাদ তাঁর মায়ের এ মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। দুস্থ মানুষের সেবা প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। স্থানীয় নিম্ন মাধ্যমিক পাঠশালায় মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছেন। কখনো রিকশাচালক বা ফেরি করার কাজ, কখনো বা কুলির কাজ, আবার কখনো কলকাতা রেলস্টেশনে খবরের কাগজ বিক্রি করতেও সংকোচবোধ করেননি। নিজের চেষ্টাতেই তিনি বড় হয়েছেন।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি যুদ্ধে নাম লেখান এবং ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে’ পুরুষ নার্স হিসেবে কাজে যোগ দেন। কাজের প্রতি তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বীয় প্রচেষ্টায় তিনি মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অনেক সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধশেষে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পটন কোর্টে সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাঁকে ‘সোর্ড অব অনার’ পদকে সম্মানিত করেন। পরে দেশে ফেরার পর প্রবীণ যোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রেলের টিকিট কালেক্টরের চাকরি দেওয়া হয়। ১৯৩২ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি-জীবনের অবসানের পর তিনি ছোট একটি কয়লার ব্যবসা শুরু করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ব্যবসা থেকে যে আয় হতো, তা দ্বারা পরিচালিত একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন। এটাই বর্তমানে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত।
রণদা প্রসাদ শৈশবে তাঁর মাকে বিনা চিকিৎসায় ও অর্থাভাবে চলে যেতে দেখেছেন। তাই ১৯৪৪ সালে মা কুমুদিনী দেবীর নামে মির্জাপুরের লৌহজং নদের পাশে স্থাপন করেছিলেন একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল। আর ঠাকুরমার নামে একটি দাতব্য ডিসপেনসারি। বাংলাদেশের পল্লিগ্রামে হাজার হাজার মেয়েকে নিজ ব্যয়ে পাশ্চাত্য ধারায় লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা বিরল। ভারতেশ্বরী হোমস তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৭১ সালের ৭ মে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা জ্যাঠামণি (রণদা প্রসাদ সাহা) ও তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে ভবানী সাহাকে নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো সন্ধান মেলেনি।
রণদা প্রসাদ সাহা একটি বিশ্বাসের নাম, একটি কীর্তির নাম, একটি গৌরবের নাম। আজ তিনি নেই, কিন্তু রয়েছে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। মির্জাপুরের লৌহজং নদের পাড়ে রয়েছে তাঁর তৈরি একটি মন্দির, যার মেঝে শ্বেতপাথরের। প্রতিদিন যাওয়া-আসার পথে মির্জাপুর গ্রামের হিন্দুধর্মাবলম্বী হাজারও মানুষ এ মন্দিরে প্রণাম জানান।
আজ এই শুভলগ্নে জ্যাঠামণির জন্মমাসে তাঁর আত্মার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
শক্তি সাহা
shaktisatu51@gmail.com
রণদা প্রসাদ সাহাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ছোটবেলা থেকেই ঠাকুরমা-ঠাকুরদা ও পিসি-মাসির কাছে তাঁর কথা অনেক শুনে আসছি। শুনেছি তাঁর কৃতিত্বের কথা; শুনেছি তাঁর মানবসেবা ও মানবপ্রেমের কথা। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম তাঁর কথা বা তাঁর সম্পর্কে কতটুকু জানে?
১৩০২ বঙ্গাব্দের (১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর) উত্থান একাদশী তিথিতে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার, মা কুমুদিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথের সন্তানদের মধ্যে রণদা প্রসাদ ছিলেন দ্বিতীয়।
রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক নিবাস ছিল সাবেক ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের মহকুমা শহরের লাগোয়া মির্জাপুর গ্রামে। তাঁর বাবার স্থায়ী কোনো পেশা ছিল না। কখনো দলিল লেখকের কাজ, আবার কখনো লগ্নির ব্যবসাও করতেন। রণদা প্রসাদ তাঁর মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না-ধরতেই মা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেন। অভারের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন তো দূরে থাক, উপযুক্ত আহারও সময়মতো জোটেনি। তাঁর গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে তিনি একজন চিকিৎসকও পাননি কিংবা অর্থের অভাবেও চিকিৎসক আনতে পারেননি। প্রসবকালে অকালেই মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। প্রসূতি মায়ের মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিলেন সাত বছরের বালক রণদা প্রসাদ। রণদা প্রসাদ তাঁর মায়ের এ মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। দুস্থ মানুষের সেবা প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। স্থানীয় নিম্ন মাধ্যমিক পাঠশালায় মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছেন। কখনো রিকশাচালক বা ফেরি করার কাজ, কখনো বা কুলির কাজ, আবার কখনো কলকাতা রেলস্টেশনে খবরের কাগজ বিক্রি করতেও সংকোচবোধ করেননি। নিজের চেষ্টাতেই তিনি বড় হয়েছেন।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি যুদ্ধে নাম লেখান এবং ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে’ পুরুষ নার্স হিসেবে কাজে যোগ দেন। কাজের প্রতি তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বীয় প্রচেষ্টায় তিনি মেসোপটেমিয়ার (ইরাক) যুদ্ধক্ষেত্রে আহত অনেক সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধশেষে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পটন কোর্টে সম্রাট পঞ্চম জর্জ তাঁকে ‘সোর্ড অব অনার’ পদকে সম্মানিত করেন। পরে দেশে ফেরার পর প্রবীণ যোদ্ধা হিসেবে তাঁকে রেলের টিকিট কালেক্টরের চাকরি দেওয়া হয়। ১৯৩২ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি-জীবনের অবসানের পর তিনি ছোট একটি কয়লার ব্যবসা শুরু করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ব্যবসা থেকে যে আয় হতো, তা দ্বারা পরিচালিত একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন। এটাই বর্তমানে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত।
রণদা প্রসাদ শৈশবে তাঁর মাকে বিনা চিকিৎসায় ও অর্থাভাবে চলে যেতে দেখেছেন। তাই ১৯৪৪ সালে মা কুমুদিনী দেবীর নামে মির্জাপুরের লৌহজং নদের পাশে স্থাপন করেছিলেন একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল। আর ঠাকুরমার নামে একটি দাতব্য ডিসপেনসারি। বাংলাদেশের পল্লিগ্রামে হাজার হাজার মেয়েকে নিজ ব্যয়ে পাশ্চাত্য ধারায় লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে যে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা বিরল। ভারতেশ্বরী হোমস তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৭১ সালের ৭ মে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা জ্যাঠামণি (রণদা প্রসাদ সাহা) ও তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে ভবানী সাহাকে নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো সন্ধান মেলেনি।
রণদা প্রসাদ সাহা একটি বিশ্বাসের নাম, একটি কীর্তির নাম, একটি গৌরবের নাম। আজ তিনি নেই, কিন্তু রয়েছে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। মির্জাপুরের লৌহজং নদের পাড়ে রয়েছে তাঁর তৈরি একটি মন্দির, যার মেঝে শ্বেতপাথরের। প্রতিদিন যাওয়া-আসার পথে মির্জাপুর গ্রামের হিন্দুধর্মাবলম্বী হাজারও মানুষ এ মন্দিরে প্রণাম জানান।
আজ এই শুভলগ্নে জ্যাঠামণির জন্মমাসে তাঁর আত্মার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
শক্তি সাহা
shaktisatu51@gmail.com
No comments