পাকিস্তান :ক্ষমতার হাতবদল আসন্ন? by এম আবদুল হাফিজ
পাকিস্তানে নানামুখী পরিস্থিতির জট অনতিক্রম্য। রাষ্ট্রের প্রধান ইনস্টিটিউশনগুলো একে অপরের মুখোমুখি। দেখলে মনে হবে, প্রায় হাতাহাতি লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্ব চলছে। দেশের সরকার, সামরিক বাহিনী, সুপ্রিম কোর্ট, পার্লামেন্ট এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চূড়ান্ত অবস্থান সংহত করছে।
এরই মধ্যে প্রত্যেকে ভালো অবস্থানে থাকতে পুনর্বিন্যাস করছে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান। এ লক্ষ্যেই চলছে শেষ মুহূর্তের নিয়োগ, বদলি, অপসারণ (ঝধপশরহম) এবং চাতুরীর খেল। প্রায় সমাগত এক শোডাউনে প্রধান খেলোয়াড়_ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান প্রকাশ্যেই এবং উগ্র মেজাজে তাদের মতামত ও অবস্থান তুলে ধরছেন।
সম্প্রতি সেনাপ্রধান কায়ানির চীন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী গিলানি এক চীনা সংবাদ সংস্থার কাছে সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই প্রধানের বিরুদ্ধে 'মেমোগেট' মামলায় সুপ্রিম কোর্টে জবানবন্দি দিতে গিয়ে উভয়ই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ আনয়ন করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেনা বা গোয়েন্দা সংস্থাপ্রধানের জবানবন্দির কোনো বৈধতা নেই, কেননা তা পূর্বাহ্নেই যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক (এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) অনুমোদিত হয়নি। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল আবার কোর্টে হাজির হয়ে অন্য রকম যুক্তি দাঁড় করেছেন। যেহেতু জেনারেল কায়ানি এবং আইএসআই প্রধান জেনারেল সুজা পাশাকে মামলায় প্রতিবাদীর ভূমিকায় দেখানো হয়েছে, তাই তাদের প্রদত্ত বক্তব্য গ্রহণযোগ্য। আশ্চর্য নয় যে, আর্মি পরবর্তী সময়ে তাদের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ সংস্থার মাধ্যমে আরও রুঢ় জবাব দিয়েছে এই বলে যে, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য মারাত্মকভাবে শাখা বিস্তার করবে এবং দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। ইত্যবসরে সেনা কমান্ডারদের একটি সভা আহ্বান করা হয় এবং ১১১ ব্রিগেডের কমান্ডার যিনি অতীতে ইসলামাবাদ এলাকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে আবার সরকারও এর প্রত্যুত্তরে প্রতিরক্ষা সচিবকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভাজন একজনকে এ পদে বসিয়েছে। এ মাসের মাঝামাঝি পার্লামেন্টের অধিবেশনও বসেছে। এ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কোনোমতে আস্থা ভোটে টিকেছেন। সুপ্রিম কোর্টও সরকারকে ঘায়েল করতে এনআরও মামলার শুনানি পুনরারম্ভ করেছে। উভয় পক্ষের মধ্যে রণরেখা পরিষ্কারভাবে অঙ্কিত হয়েছে। এসবকিছুই ঘটছে পিপিপি সরকারের ইচ্ছাকৃত অগ্রাহ্যের নীতিসংবলিত একটি প্রেক্ষিতের বিপরীতে। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত অনেক বিলম্বে তার মন্তব্যগুলো পেশ করছেন, যখন ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট মামলা তদন্তের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিলম্বিত বিবৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, সরকারের সর্বশেষ অবস্থান একটি প্রবল হিংস্র প্রতিরোধ, যেখানে আপস-নিষ্পত্তির সুযোগ সামান্যই। পর্যবেক্ষকরা ভাবছেন, উদ্দেশ্যহীন এই মুখোমুখির ফলে আর্মি ও সুপ্রিম কোর্ট সরকার এবং পিপিপির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা, যাতে সরকার এবং দল শহীদের আত্মবলির মর্যাদা পায় এবং তাদের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার হয়। পিপিপি সরকারের এও এক চতুর কৌশল। অন্যথায় গত চার বছরে তাদের যে চবৎভড়ৎসধহপব তাতে তারা জনগণের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। পিপিপির উগ্রবাদীরা এ পর্যন্ত আর্মি ও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পড়হভৎড়হঃধঃরড়হ-এ যাওয়াকে সাফল্যের সঙ্গে অনেক দূর এগিয়ে এনেছে। দলের মধ্যে কোনো সুস্থ চিন্তক নেই বললেই চলে। পিপিপির আত্মঘাতী রাজনীতির বিপরীতে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অনেক প্রশংসিত হয়েছে। তবে আর্মির জন্য একটি নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পর্যায়ে আর্মি ক্ষমতা গ্রহণে অনিচ্ছুক। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে_ হয়তোবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আর্মিকেই রাষ্ট্রের হাল ধরতে হবে। ক্ষমতাসীন দলসহ পাকিস্তানে সব রাজনৈতিক দলেরই নেতিবাচক ভূমিকা ছিল, যখন গত চার বছরে সরকার দেশকে লুটেপুটে খাচ্ছিল। তখন সম্ভবত সব রাজনৈতিক দলেরই দায়িত্ব ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি বিপথগামী সরকারকে তাদের ওপর ন্যস্ত ম্যান্ডেট অনুযায়ী আচরণে বাধ্য করা। তা তারা অজ্ঞাত কারণে না করে এ পরিস্থিতির উদ্ভবে পরোক্ষভাবে সাহায্যই করেছে। তারা যদি এখনও তাদের রাজনৈতিক ভূমিকায় সক্রিয় থাকে, পাকিস্তানে এখনও আর্মি ক্ষমতা গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্বেই থাকবে। তবে পাকিস্তানের এ নাজুক সময়ে যখন দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক ইস্যুতে তাদের পুরনো মৈত্রী বন্ধন নড়বড়ে, পাকিস্তানের শুভানুধ্যায়ীরা চলমান একটি জটিল অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান চাইবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ও এ স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চলে কোনো দেশের সরকার পরিবর্তন কোনো অসাংবি-ধানিক পন্থায় দেখতে চাইবে না।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments