চরাচর-ইলিশের জীবন চক্র by আজিজুর রহমান
ইলিশ অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন এনাড্রোমাস (অহধফৎড়সড়ঁং) প্রজাতির যাযাবর বা ভ্রমণশীল (গরমৎধঃড়ৎু) মাছ। বর্ষাকালে উত্তাল সমুদ্র আর প্রতিকূল সামুদ্রিক আবহাওয়া ইলিশদের জীবন ধারণের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে প্রাণ রক্ষার তাগিদে এরা সমুদ্র থেকে নদীর উজানে উঠে আসে।
খাদ্য, আশ্রয় আর প্রজননের উদ্দেশ্যে ইলিশ বঙ্গোপসাগর থেকে যাত্রা করে প্রধানত মেঘনা ও পদ্মা এবং এদের শাখা নদীগুলো দিয়ে চলতে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় ও গতিপথ অতিক্রম করে ইলিশ আবার যায় এদের উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগরে। চলার দীর্ঘ সময়ে স্ত্রী ইলিশের পেটের ডিম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। একসময় পদ্মা ও মেঘনা নদীর স্রোতে এরা ডিম ছেড়ে দেয়। বেশির ভাগ সময় ইলিশ ডিম ছাড়ে আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের ভেতর। প্রকৃতপক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবরের (আশ্বিন মাস) অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সাত দিনই হচ্ছে ডিম ছাড়ার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আর এ সময় ইলিশ সর্বোচ্চ পরিমাণে ডিম ছাড়ে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অর্থাৎ আশ্বিন মাসে যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় তবে ডিম ফোটার হারও বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হলে ডিম ফোটায় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ডিম ফোটানোর জন্য পুরুষ ইলিশকে ডিমের ওপর স্পয়িং (ঝঢ়ধরিহম) করতে হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ইলিশ প্রায় ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। কিন্তু ফোটে এর মাত্র পাঁচ শতাংশ। পুরুষ ইলিশের ঘাটতি ও মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে বাকি ৯৫ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। ইলিশের একমাত্র খাদ্য হচ্ছে এক ধরনের শামুক জাতীয় জলজ প্রাণী, যার নাম মানাস্কা। খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে ইলিশ খুবই রক্ষণশীল। যা তা খাবার এরা কখনোই গ্রহণ করে না। এ জন্যই স্বাদে-বর্ণে-ঘ্রাণে আর আকৃতির সৌন্দর্যে ইলিশ হয়ে উঠেছে মাছের রাজা। প্রাকৃতিক নিয়মে স্ত্রী ইলিশ ডিম ছাড়ে মিঠা পানির নদীর স্রোতে। ইলিশের রেণু জাটকায় পরিণত হতে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় মাস। এ সময় এরা নদীতেই থাকে। জাটকা চার-পাঁচ সেন্টিমিটার আকারের হলে এরা আশ্রয় নেয় সাগরের খাঁড়ি অথবা নদীর অববাহিকায়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত হচ্ছে জাটকা মৌসুম। চার-পাঁচ সেন্টিমিটার থেকে ২৩ সেন্টিমিটারের কম (৯ ইঞ্চির ছোট) দৈর্ঘ্যের শিশু ইলিশকে জাটকা বলা হয়। মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সময়ে জাটকা তরুণ (ঔাঁবহরষব) ইলিশে পরিণত হয়। তখন এদের আকার ২৩ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় হয়। এই তরুণ ইলিশ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয় সামান্য লোনা পানির এলাকা। এরপর এরা ধীরে ধীরে চলে যেতে তাকে সমুদ্রের দিকে। যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে ইলিশরা আবার ফিরে আসে নদীতে। একটি ইলিশের পূর্ণতা পেতে দুই বছর সময় লাগে। ইলিশ যত বেশি সময় মিঠা পানিতে বাস করবে তত বেশি এর স্বাদ বেড়ে যাবে। ইলিশ সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের দিকে সমুদ্র থেকে উঠে আসতে শুরু করে। সমুদ্র থেকে উঠে আসা ইলিশের মাত্র পাঁচ শতাংশ আবার ফিরে পেতে পারে। বাকি ৯৫ শতাংশই মারা পড়ে জেলেদের হাতে। এর পরও নদীতে কিছু ইলিশ থেকে যায়। বিভিন্ন কারণে এরা সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে না। জানুয়ারিতে এসব ইলিশ ডিম ছাড়ে। এ সময় যদি কিছু বৃষ্টিপাত হয় তাহলে এসব ডিম ফোটে। এ জন্য শীতকালেও নদীতে কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। স্বাদে-ঘ্রাণে-বর্ণে পদ্মা নদীর ইলিশের মান ছিল সর্বোচ্চ। পদ্মার ইলিশের গায়ে গোলাপি আভা পরিষ্কারভাবে বিচ্ছুরিত হতো। যা অন্য কোনো নদীর ইলিশে দেখা যেত না। তবে ধলেশ্বরী নদীর ইলিশের গায়ে কিছুটা নীলাভ বর্ণ দেখা যেত।
আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান
No comments