ফিরে দেখা ২১ আগস্ট : আরেকটি রাষ্ট্রীয় ক্ষত by শহিদুল ইসলাম
এক. ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং সে হত্যাকাণ্ডের বিচার না করার পাকিস্তানি ধারাটি বাংলাদেশে চালু করেন মেজর জিয়াউর রহমান। যিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন; যে ব্যক্তি ক্ষমতার জোরে খুনিদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ মিশনে উচ্চপদে চাকরি দিতে পারেন এবং যিনি সংসদে 'অব্যাহতি আইন' পাস করে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিতে পারেন।
একজন অশিক্ষিত মানুষের মনেও সন্দেহ জাগতেই পারে যে তিনিই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক। আর ডালিমরা নেংটি ইঁদুর। ভাড়াটে খুনি। এত দিন সবার মনের সে সন্দেহটা অনেকটাই দূর করেছিলেন '৭০-এর দশকের খুনোখুনির ঘটনা বিশেষজ্ঞ 'অসমাপ্ত বিপ্লব' বইয়ের লেখক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে দৈনিক ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের সামান্য অংশ প্রকাশিত হয়। সেখানে লিফশুলজ পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পেছনের প্রধান ব্যক্তি জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হবে। এই মুহূর্তে আমি মনে করি, ওই ঘটনায় জিয়াউর রহমান মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। নিজস্ব কারণে জিয়া সামনে আসেননি এটা ঠিক; কিন্তু তাঁর সমর্থন ছাড়া ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারত না। তিনি যদি ওই প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে থাকতেন, তাহলে ওই ঘটনা ঘটতে পারত না। ওই ক্যু বন্ধ করা তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল।' সবশেষে তিনি বলেন, 'জিয়াউর রহমান একজন জটিল (Complicated)) চরিত্রের মানুষ।' তিনি কিভাবে নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন, তা খুঁজে বের করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
দুই. পাঠক বলতে পারেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে লিখতে বসে ১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে লেখার কী দরকার ছিল? ছিল। কারণ, ২১ আগস্টের ঘটনার সময় যে দল বা জোট ক্ষমতায় ছিল, তারা সে হামলার কোনো বিচার করেনি। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন সেই গ্রেনেড হামলায় মারা যান এবং প্রায় ১৫০ জন সে হামলার চিহ্ন নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। সেই ২৪ জনের হত্যার বিচার করেনি তৎকালীন সরকার। তদন্তের ভান করেছিল। ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর চুপচাপ ছিল সেদিনের সরকার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়। প্রায় দু-আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা হামলার তদন্ত প্রায় শেষ করে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেই তদন্তে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আসামিদের মধ্যে তৎকালীন সরকারের শিল্পমন্ত্রী জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম আছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি এখন আদালতের আওতাধীন। বিচার চলছে_কত দিন চলবে তা এখনই বলা যায় না। দেশবাসী অধীর আগ্রহে সে মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন '৭৫-এর মুজিব হত্যার বিচার সম্পন্ন করে, বিচারের রায় কার্যকর করেছে, তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারকাজ শুরু করেছে। এই সরকারের আমলে যদি বিচারকাজ সম্পন্ন ও রায় কার্যকর না হয় তাহলে আগামী নির্বাচনের পর তা ঝুলে যেতে পারে। আবারও ১৯৭৫-এর খুনিদের মতো 'অব্যাহতি' পেয়ে যেতে পারে ২১ আগস্টের খুনিরা। তাই ১৯৭৫-এর ঘটনা টেনে আনা। তা ছাড়া দৈবাৎ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৯৭৫-এর হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কাজেই সেই খুনিদের নেংটি ইঁদুরগুলোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও খুনির ঝাড় রয়েই গেছে। তারা তাদের সে অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাইবে_এটাই স্বাভাবিক। সেই চেষ্টাই করা হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায়। হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। নিজামী ও বাবরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতেই হবে, সেদিনের সরকারই ওই গ্রেনেড হামলার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নেংটি ইঁদুরদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে দুজন বিড়ালকে সামনে রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। বিচারকার্য সম্পন্ন না করে সেদিনের সরকার নিজের সম্পৃক্ততা সম্বন্ধে জনমনে সন্দেহ সুদৃঢ় করেছে।
তিন. ২১ আগস্টের মতো ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে সৈয়দ আকবর নামের এক যুবক। উপস্থিত জনসাধারণ তাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়। সরকার তড়িঘড়ি এক বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে তদন্ত শেষে ১০ মাস পর একটি অগোছালো-অসম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে। বেগম লিয়াকত আলী খান তা পাঠে বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। আসল কালপ্রিটদের ঢাকা দেওয়ার সময় পায় সরকার। নওয়াবজাদা আইতাজুদ্দিন বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে তদন্ত তদারক করছিলেন। রিপোর্টটি প্রকাশের পর পূর্ণ রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে দেখানোর জন্য প্লেনে যাওয়ার সময় তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। রিপোর্টটি ধ্বংস হয়ে যায়। তদন্ত নিয়ে জনমনে প্রবল বিক্ষোভ উপস্থিত হয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুরমানি সমালোচনার সম্মুখীন হন। তখন বিএনপি জোট সরকারের মতো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আসল ঘটনার ওপর কোনো আলো ফেলতে পারেনি ইয়ার্ডের বিশেষজ্ঞরা। মানুষের মনে নানা রকম সন্দেহ বাধে। ১৯৫৮ সালে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন গুরমানি সাংবাদিক জেড এ সুলেরির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মানহানির মামলা করেন। গুরমানি আদালতে রিপোর্টটি দেখতে চান। পুলিশ রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তা সত্য কি না তা জানার জন্য। হাইকোর্ট রিপোর্টটি দাখিল করার নির্দেশ দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল ২৫ ফেব্রুয়ারি তা দাখিল করার কথা বলেন। ২৫ তারিখ যখন রিপোর্টটি হাইকোর্টের সামনে উপস্থিত করতে পারলেন না, কোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেলকে সে সম্পর্কে চিঠি দেন। তিনি উত্তরে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারির হেফাজতে সেটি আছে। মার্চের ১ তারিখে সহকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল কোর্টে হাজির হয়ে জানান, ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এক সপ্তাহের সময় প্রার্থনা করলে কোর্ট তা মঞ্জুর করেন। ৮ মার্চ ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের জনৈক অফিসার হাইকোর্টকে জানান, সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ফাইলটি পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আজও জানেন না কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল। ফাইলটি কি গায়েব করে রাখা হয়েছিল? না সত্যি হারিয়ে গিয়েছিল? মানুষের মনে সে সন্দেহ আজও দূর হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ মনে করেন, তাঁকে শাসকশ্রেণীরই একাংশ হত্যা করেছিল নিজেদের স্বার্থে।
চার. তাই আমাদের বারবার ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হয়। ইতিহাস কথা বলে। কুচক্রীরা মনে করে, দেশের সাধারণ মানুষ কিছু বোঝে না। তা সম্পূর্ণ ভুল। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের নেংটি ইঁদুর ধরা পড়লেও তার পেছনের ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে সন্দেহ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হলে সে সম্পর্কেও মানুষ ক্রমেই অনেক সত্য জানতে পারবে। যারা হত্যাকারী, গ্রেনেড হামলাকারী, তারা তো চাইবেই যেনতেনভাবে বিচারকাজ ঠেকিয়ে রাখতে বা বিচার না করতে। কিন্তু সত্যের খাতিরে নয় শুধু, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে তার জন্যও ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ জেলহত্যা, জিয়া হত্যার বিচার হওয়া দরকার। সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করেন, শেখ মুজিবের বিচার করে জিয়াউর রহমান যদি খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেন তাহলে তাঁকেও একইভাবে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হতো না। একটি সন্ত্রাস যেমন শত শত সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তেমনি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। দেশের জন্য যা অত্যন্ত মারাত্মক। লিয়াকত মৃত্যুর আগে শেষ বাক্যটি বলেছিলেন, 'আল্লাহ পাকিস্তানকে বাঁচাও।' না, পাকিস্তান বাঁচেনি। ষড়যন্ত্র, ক্যু-পাল্টা ক্যুতে দেশটি মাত্র ২৩ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের ষড়যন্ত্র, ক্যু-পাল্টা ক্যু বন্ধ করতে হবে। আসামি যেই হোক না কেন? যত বড় মানুষই হোক, বিচারের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
দুই. পাঠক বলতে পারেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে লিখতে বসে ১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে লেখার কী দরকার ছিল? ছিল। কারণ, ২১ আগস্টের ঘটনার সময় যে দল বা জোট ক্ষমতায় ছিল, তারা সে হামলার কোনো বিচার করেনি। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন সেই গ্রেনেড হামলায় মারা যান এবং প্রায় ১৫০ জন সে হামলার চিহ্ন নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। সেই ২৪ জনের হত্যার বিচার করেনি তৎকালীন সরকার। তদন্তের ভান করেছিল। ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর চুপচাপ ছিল সেদিনের সরকার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়। প্রায় দু-আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা হামলার তদন্ত প্রায় শেষ করে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেই তদন্তে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আসামিদের মধ্যে তৎকালীন সরকারের শিল্পমন্ত্রী জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম আছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি এখন আদালতের আওতাধীন। বিচার চলছে_কত দিন চলবে তা এখনই বলা যায় না। দেশবাসী অধীর আগ্রহে সে মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার যেমন '৭৫-এর মুজিব হত্যার বিচার সম্পন্ন করে, বিচারের রায় কার্যকর করেছে, তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারকাজ শুরু করেছে। এই সরকারের আমলে যদি বিচারকাজ সম্পন্ন ও রায় কার্যকর না হয় তাহলে আগামী নির্বাচনের পর তা ঝুলে যেতে পারে। আবারও ১৯৭৫-এর খুনিদের মতো 'অব্যাহতি' পেয়ে যেতে পারে ২১ আগস্টের খুনিরা। তাই ১৯৭৫-এর ঘটনা টেনে আনা। তা ছাড়া দৈবাৎ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৯৭৫-এর হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। কাজেই সেই খুনিদের নেংটি ইঁদুরগুলোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও খুনির ঝাড় রয়েই গেছে। তারা তাদের সে অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাইবে_এটাই স্বাভাবিক। সেই চেষ্টাই করা হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায়। হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। নিজামী ও বাবরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তা যদি সত্যি হয় তাহলে বলতেই হবে, সেদিনের সরকারই ওই গ্রেনেড হামলার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। নেংটি ইঁদুরদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে দুজন বিড়ালকে সামনে রেখেছিলেন জিয়াউর রহমান। বিচারকার্য সম্পন্ন না করে সেদিনের সরকার নিজের সম্পৃক্ততা সম্বন্ধে জনমনে সন্দেহ সুদৃঢ় করেছে।
তিন. ২১ আগস্টের মতো ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে সৈয়দ আকবর নামের এক যুবক। উপস্থিত জনসাধারণ তাকে হাতেনাতে ধরে ফেললে পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করে তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়। সরকার তড়িঘড়ি এক বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষে সে তদন্ত শেষে ১০ মাস পর একটি অগোছালো-অসম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ করে। বেগম লিয়াকত আলী খান তা পাঠে বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। আসল কালপ্রিটদের ঢাকা দেওয়ার সময় পায় সরকার। নওয়াবজাদা আইতাজুদ্দিন বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে তদন্ত তদারক করছিলেন। রিপোর্টটি প্রকাশের পর পূর্ণ রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে দেখানোর জন্য প্লেনে যাওয়ার সময় তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। রিপোর্টটি ধ্বংস হয়ে যায়। তদন্ত নিয়ে জনমনে প্রবল বিক্ষোভ উপস্থিত হয় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুরমানি সমালোচনার সম্মুখীন হন। তখন বিএনপি জোট সরকারের মতো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আসল ঘটনার ওপর কোনো আলো ফেলতে পারেনি ইয়ার্ডের বিশেষজ্ঞরা। মানুষের মনে নানা রকম সন্দেহ বাধে। ১৯৫৮ সালে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয় যখন গুরমানি সাংবাদিক জেড এ সুলেরির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মানহানির মামলা করেন। গুরমানি আদালতে রিপোর্টটি দেখতে চান। পুলিশ রিপোর্টে তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, তা সত্য কি না তা জানার জন্য। হাইকোর্ট রিপোর্টটি দাখিল করার নির্দেশ দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল ২৫ ফেব্রুয়ারি তা দাখিল করার কথা বলেন। ২৫ তারিখ যখন রিপোর্টটি হাইকোর্টের সামনে উপস্থিত করতে পারলেন না, কোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেলকে সে সম্পর্কে চিঠি দেন। তিনি উত্তরে জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারির হেফাজতে সেটি আছে। মার্চের ১ তারিখে সহকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল কোর্টে হাজির হয়ে জানান, ফাইলটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এক সপ্তাহের সময় প্রার্থনা করলে কোর্ট তা মঞ্জুর করেন। ৮ মার্চ ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের জনৈক অফিসার হাইকোর্টকে জানান, সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ফাইলটি পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আজও জানেন না কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল। ফাইলটি কি গায়েব করে রাখা হয়েছিল? না সত্যি হারিয়ে গিয়েছিল? মানুষের মনে সে সন্দেহ আজও দূর হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ মনে করেন, তাঁকে শাসকশ্রেণীরই একাংশ হত্যা করেছিল নিজেদের স্বার্থে।
চার. তাই আমাদের বারবার ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হয়। ইতিহাস কথা বলে। কুচক্রীরা মনে করে, দেশের সাধারণ মানুষ কিছু বোঝে না। তা সম্পূর্ণ ভুল। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের নেংটি ইঁদুর ধরা পড়লেও তার পেছনের ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে সন্দেহ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হলে সে সম্পর্কেও মানুষ ক্রমেই অনেক সত্য জানতে পারবে। যারা হত্যাকারী, গ্রেনেড হামলাকারী, তারা তো চাইবেই যেনতেনভাবে বিচারকাজ ঠেকিয়ে রাখতে বা বিচার না করতে। কিন্তু সত্যের খাতিরে নয় শুধু, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে তার জন্যও ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ জেলহত্যা, জিয়া হত্যার বিচার হওয়া দরকার। সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করেন, শেখ মুজিবের বিচার করে জিয়াউর রহমান যদি খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেন তাহলে তাঁকেও একইভাবে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হতো না। একটি সন্ত্রাস যেমন শত শত সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তেমনি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। দেশের জন্য যা অত্যন্ত মারাত্মক। লিয়াকত মৃত্যুর আগে শেষ বাক্যটি বলেছিলেন, 'আল্লাহ পাকিস্তানকে বাঁচাও।' না, পাকিস্তান বাঁচেনি। ষড়যন্ত্র, ক্যু-পাল্টা ক্যুতে দেশটি মাত্র ২৩ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের ষড়যন্ত্র, ক্যু-পাল্টা ক্যু বন্ধ করতে হবে। আসামি যেই হোক না কেন? যত বড় মানুষই হোক, বিচারের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments