নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস-কাটে না আঁধার by বনরূপা
নারী ও নির্যাতন_শব্দ দুটি বিশ্ব প্রেক্ষাপট তো বটেই, বাংলাদেশেও ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রায় নিত্য এই নির্যাতনের ফল হিসেবে একটি মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত আমাদের অহরহ প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বসাম্প্রতিক হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে দুজন মায়ের সন্তানসহ আত্মহত্যার ঘটনাটি এরই সাক্ষ্য বহন করছে। এ সবই খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্ত টানা যাবে অনেক।
প্রায় প্রতিদিন রিকশাচালক মিলন তার কিশোরী স্ত্রীকে পেটায়। সূর্যোদয়ের মতো এটা যেন তার কাছে একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। বর্ষার আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেমন দু-তিন দিন সূর্যকে ঢেকে রাখে, তেমনি মিলনও মাঝেমধ্যে তার বউকে পেটানো মুলতবি রাখে। হয়তো প্রতিদিন বউকে পেটানো একঘেয়েমি লাগে কিংবা পেটাতে পেটাতে নিজেই একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর সে কারণে কোনো কোনো সময় রেহাই পায় জরিনা। অমানুষিক নারী নির্যাতনের প্রচলিত বাস্তব ঘটনা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের অনেকের অভিজ্ঞতায়ই আছে। পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিতে না পারায় এই নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে জরিনাকে। মহল্লার ধনীর দুলালের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে জরিনাকে আরেক দোজখে পাঠিয়েছে তার পরিবার। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই তাকে বিয়ে দিতে হয়েছিল নিরাপত্তার অভাবে। নারী নির্যাতন শুধু আজ যৌতুক, ইভ টিজিং আর বাল্যবিবাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নানাভাবেই পরিবারের গণ্ডিতেও নারী সহিংসতার শিকার। এমনকি পুত্রসন্তান জন্ম দিতে না পারায়ও পরিবারে নারীর ওপর নির্যাতন হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা। আমাদের দেশে নিত্য নির্যাতনের শিকার নারী। ঘরে কিংবা কর্মস্থলে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। নিশ্চিন্তে কাজ করার সুযোগ কোথাও পাচ্ছে না। পারিবারিক নির্যাতনটা হয় খুব সূক্ষ্মভাবে, যার বেশির ভাগই প্রকাশ পায় না লোকলজ্জার ভয়ে। একই সঙ্গে বেশির ভাগ নারীই মনে করে, নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ পেলে বা কেউ জানতে পারলে পারিবারিক অশান্তি আরো বেশি হয়। ফলে প্রতিকার বা প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে আশানুরূপ নয়। এক সমীক্ষায় প্রকাশ, ৯০ শতাংশ নারী পরিবারে যথাযথ সম্মান পায় না। এমনকি সন্তানধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নারী অবহেলিত। জাতিসংঘের জেন্ডারবিষয়ক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৪১ শতাংশ নারীর মৃত্যুর কারণ পারিবারিক নির্যাতন। নির্যাতন নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গত ছয় মাসে দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৩১টি। এর মধ্যে পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছে ২৩৭ জন নারী। নারীর ওপর সহিংসতা নির্মূল বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণায় বলা আছে, গৃহস্বামী কিংবা পরিবারে অন্য সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত শোষণ বা বৈষম্যমূলক আচরণ, শারীরিক নির্যাতন, মেয়েশিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ, স্ত্রীর অঙ্গচ্ছেদসহ নারীর জন্য ক্ষতিকর সব কর্মকাণ্ড পারিবারিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। এ ঘোষণার ২(এ) ধারায় বলা হয়েছে, পরিবারে নারীর শারীরিক, যৌন ও মনস্তাত্তি্বক নির্যাতনমুক্ত হয়ে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। কিন্তু আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে বিবর্ণ চিত্র। বিষয়টি যেন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, 'কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।' কোনো সভ্য কিংবা আধুনিক, মানবিক সমাজে নারী নির্যাতনের বিবর্ণ চিত্র কোনোভাবেই জিইয়ে থাকতে পারে না। এ দেশে আইনি সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমেও নারী নির্যাতনের বীভৎস ঘটনা ঘটছে। ইয়াসমিনরা তো এরই দুঃসহ স্মারক।
-বনরূপা
No comments