রবার্ট ফিস্ক-খেলা শেষ হতে কত বাকি
আরব বিশ্বের অবশিষ্ট স্বৈরাচারী ক্ষমতাসীনরা আরো একটি বিনিদ্র রাত অতিবাহিত করল। আর কত সময়ের মধ্যে ত্রিপোলি মুক্তকারীরা দামেস্ক, আলেপ্পো বা হোমসের মুক্তকারীতে পরিণত হবে? আম্মান, জেরুজালেম অথবা বাহরাইন কিংবা রিয়াদ? অবশ্যই সব এক রকম নয়। আরব বিশ্বের স্প্রিং, সামার, অটাম শুধু এটাই প্রমাণ করেনি যে সাম্রাজ্যবাদের ভয়ানক পরিণতি হিসেবে উপনিবেশের সীমান্ত অপরিবর্তিত থাকবে;
কিন্তু আমি মনে করি, প্রতিটি আন্দোলনেরই আলাদা নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যদি সব আরব বিদ্রোহই শহীদদের অর্জিত হয়ে থাকে, তাহলেও কিছু বিদ্রোহের ঘটনা অন্য বিদ্রোহের চেয়ে অনেক বেশি হিংসাত্মক। যেমন_সাইফ আল গাদ্দাফি তাঁর নিজের পতনের শুরুতে বলেছিলেন, 'লিবিয়া তিউনিসিয়া বা মিসর নয়। এখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। রাস্তায় রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।' এবং তা-ই হয়েছে।
এখন আমরা ভবিষ্যৎ দেখার ক্রিস্টাল বলটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পারি। ন্যাটোর বোমা হামলার মূল্য হিসেবে আমরা যদি অর্থনৈতিক দখল না করি, তাহলে লিবিয়া হবে মধ্যপ্রাচ্যের সুপার পাওয়ার। গাদ্দাফির মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার প্রতি অন্ধত্ব অদৃশ্য হয়ে অধিক পরিমাণ আরব দেশ হয়ে উঠবে। আলজেরিয়া এবং মরক্কো এর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
কিন্তু স্বৈরাচারী আরব শাসকদের উচ্ছেদে অনির্বাচিত আরব শাসকদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে এক ভয়ানক খেলা শুরু হতে পারে। এখন আর কে সেই ভুলে যাওয়া ১৯৭৭ সালের যুদ্ধের কথা মনে রাখে? মিসরের প্রেসিডেন্টকে ইসরায়েল সতর্ক করে দিল, গাদ্দাফি তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করছে। আনোয়ার সাদাত বোমারু বিমান পাঠালেন গাদ্দাফির বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করতে। কিন্তু গাদ্দাফির একনায়কত্ব আনোয়ার সাদাতের শাসনাবসানের পর আরো ৩০ বছর টিকে রইল। তার পরও অন্য সবার মতো লিবিয়া আরব বিশ্বের ক্যান্সারে ভুগেছে : সে ক্যান্সার হলো অর্থনৈতিক ও নৈতিক দুর্নীতি। লিবিয়ার ভবিষ্যৎ কি অন্য রকম হবে? লিবিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত মরুভূমি পার হওয়াকে সম্মান জানাতে আমরা অনেক সময় ব্যয় করেছি। তাঁদের সঙ্গে লেগে থাকা ট্রানজিশনাল ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতা হিসেবে বিবেচিত মুস্তাফা আবদুল জলিল এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেননি, তাঁর সুহৃদরা গত মাসে তাঁদের নিজেদের সেনাবাহিনীর কমান্ডারকে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র করেছিলেন কী করে? ইতিমধ্যেই পশ্চিমারা নতুন লিবিয়ার অনির্বাচিত নেতাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা দিতে শুরু করেছে। সে শিক্ষা হলো, কিভাবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। এ কাজটি আমরা আট বছর আগে ইরাক 'স্বাধীন' করার সময় করেছিলাম।
জার্মানির অ্যাডোনয়ার থেকে শুরু করে ইরাকের মালিকি সরকার পর্যন্ত অতীতের সব ডার্ক ফিগারের মতো লিবিয়ায়ও গাদ্দাফির উপজাতিকে স্থান দিতে হবে। গত সপ্তাহে যেমন গাদ্দাফির লোকেরা গ্রিন স্কয়ারে উল্লাস করেছে, ঠিক একইভাবে গতকাল সেখানে দুঃখজনক উল্লাস দেখা গেছে। মনে পড়ে তখনকার কথা। ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স মুক্ত হওয়ার পর দ্য গলকে তাঁর সহযোগীরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, জনতা পেতাঁকে কয়েক সপ্তাহ আগে যেভাবে উল্লসিতভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সেখানে তাঁকে জনতা কী রকম অভ্যর্থনা জানিয়েছে? বলা হয়ে থাকে যে দ্য গল উত্তরে বলেছিলেন, একই রকমভাবে।'
কখন বিশ্ব লকারবি বোমা হামলা পরিকল্পনায় অভিযুক্ত মৃত্যুপথযাত্রী আবদুল বাসেত আলমেগ্রাহির দরজায় টোকা দেবে জানার জন্য যে গাদ্দাফির সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে তিনি কিভাবে কাজ করেছেন? কখন ত্রিপোলি মুক্তকারীরা গাদ্দাফির তেল ও বিদেশ মন্ত্রণালয়ের গোপন ফাইলে হাত দেবে ব্লেয়ার-সারকোজি-বারলুসকোনির সঙ্গে গ্রিন বুকের রচয়িতার দহরম-মহরমের গোপন খবর জানতে? ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা কি এ নিয়ে তাদের ধরে বসবে?
আমরা অবশ্যই জানতে চাইব, ইউরোপের জনগণ কখন জানতে চাইবে যে ক্যামেরন এবং তাঁর সহযোগীদের দাবি অনুযায়ী লিবিয়ায় যদি ন্যাটো এত সফল হয়ে থাকে, তাহলে সিরিয়ার বিরুদ্ধে কেন তারা তাদের শক্তি ব্যবহার করতে পারছে না? অথবা আমাদের সতর্কভাবে প্রতিবেশীর দিকে কর্ণপাত করতে হবে; ইসরায়েল এখনো গোপনে আশা করছে যে স্বৈরশাসক বন্ধু হিসেবে টিকে থাকবে এবং গোলানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শান্তি আসবে।
বেন আলী গেছেন, মুবারক গেছেন, সালেহ অনেকটাই গেছেন, গাদ্দাফি উৎখাত হওয়ার পথে, আসাদ বিপদের মধ্যে আছেন, জর্দানের আবদুল্লাহ মারাত্মক বিরোধিতার সম্মুখীন, বাহরাইনের সংখ্যালঘু সুনি্ন শাসক চিরকাল শাসন করার আত্মঘাতী ধারণা করছেন। এসব ঐতিহাসিক ঘটনায় ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া শত্রুতাপূর্ণ ও নিরুৎসাহজনক।
এমন এক সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের কথা ভোলা যায় না। সেই শক্তিশালী সাম্রাজ্যে আপনি মরক্কো থেকে কনস্টান্টিনোপল কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ঘুরে আসতে পারতেন। সিরিয়া এবং জর্দানের স্বাধীনতার পর আমরা আলজিরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারতাম। অটোমান সাম্রাজ্যের পুনর্জন্ম হয়েছে কিন্তু আরবদের ছাড়া। নিশ্চিত থাকুন, তাদের এখনো ভিসার প্রয়োজন হবে।
ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট থেকে সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments