সিলেটে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সম্ভাবনাময় দিক by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

সিলেটে আর্থিক বিনিয়োগের প্রকৃতি একটু ভিন্ন ধরনের। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে অর্থের অভাবে বিনিয়োগের পরিস্থিতি ভালো নয়, কিন্তু সে অনুপাতে সিলেটে অর্থের প্রবাহ বেশি হওয়া সত্ত্বেও সঠিক বিনিয়োগের অভাবে প্রথমত, এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না; দ্বিতীয়ত, সরকারের আয়ের খাতে কিছুই যোগ হচ্ছে না। বিশাল এক গোষ্ঠী যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করায় জাতীয় আয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।


কিন্তু সদ্ব্যবহারের অভাবে কখনো কখনো অর্থ ব্যাংকে অলস পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ সঠিক ও উপযুক্ত জায়গায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সিলেটসহ বাংলাদেশের বেকারত্ব লাঘবে এ অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সিলেটের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখানে প্রচুর অর্থ অলস পড়ে আছে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে পরিমাণে আসে, তার চেয়ে বেশি আসে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া কষ্টকর। তাদের পাঠানো অর্থ দুটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়। একটি হাউজিং, অন্যটি মার্কেট নির্মাণ। সিলেটে হাউজিং ব্যবসা খুবই জমজমাট। আমার ধারণা, ঢাকার পরই হাউজিং ব্যবসা সিলেট দখল করে আছে। শুধু প্রবাসীদের পাঠানো টাকাই নয়, দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও এ ব্যবসা অনেকে চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশে একটি ফ্ল্যাট থাকা দরকার_প্রবাসীদের এ ধরনের মানসিকতায় প্রতিনিয়ত বহুতল ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। ফ্ল্যাটের দামও ঢাকার তুলনায় কম নয়। অপরিকল্পিত এ ধরনের অবকাঠামো তৈরিতে শহরের সৌন্দর্যহানি হচ্ছে। মার্কেট তৈরি করা এ অঞ্চলের মানুষের এক ধরনের নেশা। গ্রামগঞ্জে তারা সুন্দর সুন্দর মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার এবং নিজেদের বসবাসের জন্য অত্যাধুনিক ডিজাইনের বাড়ি তৈরি করেছে। কখনো কখনো বাড়ি তৈরিতে তারা একজনের সঙ্গে অন্যজন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। অথচ মার্কেট, বাড়ি কিংবা কমিউনিটি সেন্টার থেকে তারা তেমন লাভবান হচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে তারা ঝুঁকিহীন মনে করছে। এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। যেমন_প্রবাসে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। সাদামাটা বিষয় হলো, ব্যবসার জন্য সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান দরকার; কিন্তু তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই বলেও তাদের দাবি। কখনো কখনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেও দায়ী করা হয়। সার্বিক বিচারে সিলেটে অলস টাকা পড়ে থাকা এবং অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ লক্ষ করা যায়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ছোটখাটো শিল্পপ্রতিষ্ঠান আমরা হয়তো লক্ষ করি, কিন্তু তা অঞ্চলভিত্তিক সীমাবদ্ধ। যেমন_মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জকে কেন্দ্র করে মণিপুরিদের হস্তশিল্প এবং জাফলংয়ের পাথরকে কেন্দ্র করে পাথর শিল্পের বিকাশ। কিন্তু এ উদ্যোগগুলো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। যোগাযোগব্যবস্থাসহ অন্য সব দিকের বিচারে সিলেট অঞ্চল হতে পারে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের সবচেয়ে বড় একটি কেন্দ্র। এখানে রয়েছে পর্যাপ্ত অব্যবহৃত জমি, যেখানে বছরের কোনো সময়ই ধানের চাষ হয় না। ঢাকা-সিলেটের যোগাযোগব্যবস্থা খুব ভালো, সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় আসা বা যাওয়া যায়। শিল্পের জন্য কাঁচামাল আনা-নেওয়া এখন আর সমস্যাই নয়। অথচ এতসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সিলেটে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। গার্মেন্ট সেক্টর আমাদের দেশে রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে আর্থিক দিকের বিচারে সিলেট হতে পারে একটি বৃহৎ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা। আমরা যদি ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সিলেট এ ক্ষেত্রে এগিয়ে। আমরা চাইব, সিলেটে কর্মসংস্থানমুখী বিভিন্ন উন্নয়ন, যেখানে আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোক এসে কাজ করবে, নিজেদের ও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে। এ লক্ষ্যে কতকগুলো পদক্ষেপ জরুরি বলে আমরা মনে করি। প্রথমত, প্রবাসীদের মনেপ্রাণে নিজ দেশে বিনিয়োগের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্রবাসীদের সেই মানসিকতা রয়েছে। তাদের সেই মানসিকতাকে পরিপূর্ণ রূপদান করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের মানসিকতাকে যথাযথভাবে সম্মান দেখাতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে প্রবাসীরা বিনিয়োগের জন্য সাহস পায়, স্বাছন্দ্য বোধ করে। তৃতীয়ত, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রথমে সরকারি পর্যায়ে সিলেটে একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা তৈরিতে কাজ করতে হবে। বৈচিত্র্যে ভরপুর সিলেট অঞ্চল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সিলেটে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ ও শিক্ষাবিদ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও উন্নয়নে সিলেটের অবস্থান অনেক নিচে। খোদ কুমিল্লায় যেখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা রয়েছে, সেখানে একটি বিভাগীয় শহর হওয়া সত্ত্বেও সিলেটে নেই কোনো রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.