কালান্তরের কড়চা-বিএনপি দিয়েছে অপশাসন, আওয়ামী লীগ সুশাসন দিতে পারছে না by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশ থেকে যাঁরাই এখন লন্ডনে আসেন না কেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের পক্ষের লোক হোন, বিপক্ষের লোক হোন কিংবা নিরপেক্ষ হোন, তাঁদের অধিকাংশের মুখে একটাই শঙ্কার কথা শুনি, দেশ ঠিকমতো চলছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে তো আর দুই বছরও নেই। যদি ক্ষমতায় থাকার অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা দেশবাসীর প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে চমকপ্রদ কিছু দেখাতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে কী হবে তা বলা যায় না।
একটু শঙ্কিতভাবেই তাদের জিজ্ঞেস করি, সম্প্রতি পাশের ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে সিপিএমের ভাগ্যে যা ঘটেছে, তা কি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বেলায় ঘটতে পারে? এ ব্যাপারে আবার তাঁরা সহমত পোষণ করেন না। কেউ কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেন, না, পুরোপুরি তা ঘটবে না। কারণ বিএনপির গত সরকার দেশকে শুধু অপশাসন উপহার দিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে অপশাসন উপহার দেয়নি। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং হতাশ দেশবাসী আগামী নির্বাচনে কী করবে এখনো তা স্পষ্ট নয়। চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন বা দেশের পৌরসভাগুলোর নির্বাচনের ফলও তার প্রকৃত দিকনির্দেশনা নয়।
লন্ডনে বসে এসব কথাবার্তা শুনি, আর ঢাকার বন্ধুবান্ধব, যাঁদের সঙ্গে আবার নিত্য যোগাযোগ, তাঁদের কাছে সংশয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি তাঁরা এ সম্পর্কে কী ভাবছেন? আমার এক রাজনীতিক-কাম-কলামিস্ট বন্ধু বলেছেন, 'বিএনপির গায়ে এত কালি যে তারা আগামী নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারবে না। তা জেনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করে তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির দ্বারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে।'
তাদের সহযোগী ও মিত্র যুদ্ধাপরাধীদের দলটি তো নিশ্চিতভাবে জানে, আগামী নির্বাচনে তাদের বিলুপ্তি নিশ্চিত। তারা ১৯৭৫ সালের মতো আরেকটি ঘটনা ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গিদের উসকে দিয়ে তারা যে এই চেষ্টা করতে পারে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার প্রমাণ। এর সঙ্গে বিএনপির হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ তো এখন উঠে আসছে। আমার এই বন্ধুর ভয় আগামী নির্বাচনের ফল নিয়ে নয়; তাঁর ভয় শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে।
অন্যদিকে আমার এক প্রবীণ কলামিস্ট বন্ধু, যিনি এখনো আওয়ামী লীগপন্থী, কিন্তু 'প্রথম আলোর' নিরপেক্ষ কলামিস্ট, তাঁর মতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬০টি আসন পেলেও তিনি বিস্মিত হবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, তাহলে কি আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল জয় (massive victory) নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসবে? তিনি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত।
বন্ধুদের কথা থাক, আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করেন, দেশের আশু ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছি? নির্বাচন তো দ্রুত এগিয়ে আসছে। কী হতে পারে? আমার জবাব, আরো কয়েকটা মাস না গেলে কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানেও যেভাবে দেশ চালাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তার যদি পরিবর্তন না হয় এবং যথাসময়ে নির্বাচন হলে যদি বিএনপি তাতে যোগ দেয়, তাহলে হ্যাং পার্লামেন্ট বা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়ে যেতে পারে। তাতে ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির মতো সুবিধা হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির। এরশাদ তাহলে রাষ্ট্রপতি অথবা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদটি কোয়ালিশন গঠনের শর্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে দল এই শর্তে রাজি হবে, তাদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন।
তবে পরিস্থিতি অন্যদিকেও গড়াতে পারে। বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে, তবে দৃশ্যান্তর ঘটতে পারে অন্যভাবে। সে কথায় পরে আসছি। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের এখনকার বক্তব্য অত্যন্ত পরস্পরবিরোধী। এক মুখে তারা বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন এবং সেই সরকারের তদারকি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে স্বয়ং খালেদা জিয়া দাবি করছেন, এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই। যদি হাসিনা সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়; তাহলে বিএনপি কি এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাবে? এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না এবং তার জবাবও বিএনপি দিচ্ছে না।
আমার ধারণা, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার দাবিতে যতই দরকষাকষি করুক, শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় এসে (সরকারকেও সমঝোতায় আসতে হবে) নির্বাচনে যোগ দিতে হবে। নির্বাচনে জেতা সম্পর্কে তাদের মনে এখন ক্ষীণ হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। ফলে সাংগঠনিকভাবে ভাঙা ঘর জোড়া দিতে পারলে তারা নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগকে সহজ ওয়াকওভার দেবে না।
তারা জানে, এই ওয়াকওভার দেওয়ার অর্থ হবে মুসলিম লীগের মতো বিএনপির অস্তিত্বের বিলুপ্তি। বিএনপি কোনো আদর্শের ঐক্যে বাঁধা দল নয়। ক্ষমতা ও বিভিন্ন স্বার্থ-সুবিধার লোভে বিভিন্ন দলের এবং দলবিহীন সুযোগসন্ধানী নেতা-কর্মীরা এসে বিএনপিতে জুটেছিলেন। এই দলের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে 'আপসহীন নেত্রী'র প্রতি কোনো প্রকার আনুগত্য বা ভালোবাসা থেকে তাঁরা নেত্রীকে বা তাঁর দলকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, তার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে দলের অনেকেরই টনক নড়ে উঠেছে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখলে মওদুদ আহমদ এবং তাঁর মতো আরো অনেকে 'দেশনেত্রী'কে ছেড়ে দিয়ে 'পল্লীবন্ধুর' দলে আবার চলে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাকে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, বিএনপি যদি আগামী সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে অবশিষ্ট যে দু-তিনজন শীর্ষ নেতা এখনো আছেন, তাঁরা জে. এরশাদের জাতীয় পার্টিতে চলে যেতে পারেন। যদি তাঁরা না-ও যান, তাহলেও তাঁদের আনুগত্যের ওপর বেগম জিয়া আর ষোল আনা নির্ভর করতে পারছেন না। বিশেষ করে মওদুদ আহমদের চরিত্র তিনি ভালোভাবে জানেন।
সম্ভবত এসব কারণেই বিএনপি নেত্রী দল থেকে অপসারিত ড. বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, কর্নেল অলি আহমদ (অব.) প্রমুখ পুরনো নেতাদের কাছে আবার ধরনা দিচ্ছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সেই কাদের সিদ্দিকীকেও ডেকে এনে তাঁর দেওয়া গামছা উপহার হিসেবে গ্রহণ করছেন। যদি নির্বাচনের আগে তাঁর দলে ভাঙন দেখা দেয়, তাহলে দলে নেতৃত্বশূন্যতা ঠেকাতেও বিতাড়িতদের আবার সেধে দলে আনা তাঁর প্রয়োজন। তাঁর সুপুত্র তারেক রহমান যতই বিদেশে নাটের গুরু সেজে বসে থাকুন, গুরুতর দুর্নীতি থেকে শুরু করে হত্যা-ষড়যন্ত্রের মামলার আসামি হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসার সাহস দেখিয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াবেন, সে সম্ভাবনা কম।
কিন্তু বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে না যায়, তাহলে বিকল্প থেকে লিবারেল, লিবারেল থেকে ব্রিজ সিদ্দিকীর গামছা পার্টি পর্যন্ত ছোটাছুটি করে লাভ কী? বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাঁরা কী আশায় ওই দলের সঙ্গে জোট বাঁধবেন? ডা. বি. চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, তিনি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। এটা তো তাঁর মুখের কথা। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি না যায় এবং আওয়ামী লীগ থেকে যদি তাঁকে বা তাঁর দলকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়, তাহলে ডা. বি. চৌধুরী কী করবেন, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যত দূর জানি, আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদেরও বিকল্পধারার নেতাদের সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আমার গণনা যদি ভুল না হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছাড়াই সরকারের সঙ্গে কোনো একধরনের সমঝোতা করে বিএনপিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই নির্বাচনে যেতে হবে। সরকারকেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ ধরনের সমঝোতায় যেতে হবে। নইলে নির্বাচন যত অবাধ ও সুষ্ঠু হোক দেশবাসীর কাছে তা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আবার নির্বাচনে না গিয়ে কোনো ধরনের অশুভ শক্তির সহায়তায় বিএনপি দেশে কোনো অঘটন ঘটাতে পারবে বা আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে_সে পরিস্থিতি দেশে নেই এবং সে ক্ষমতাও তাদের কোমরে নেই। মির্জা ফখরুল ইসলামের বাগাড়ম্বর অসারের তর্জন-গর্জন মাত্র।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সুচতুর রাজনীতিক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ সম্ভবত এই আশায় দিন গুনছেন যে বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে, তাহলে আওয়ামী লীগের মহাজোট ত্যাগ করে তিনি তাঁর দল নিয়ে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সংসদের ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন। তাঁর মনে হয়তো ক্ষীণ আশা, দেশের মানুষ বড় দুটি দল সম্পর্কে এতই ক্ষুব্ধ ও হতাশ যে তারা হয়তো আগামী সাধারণ নির্বাচনে সেই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে জাতীয় পার্টির ভোটের বাঙ্ইে বেশি ভোট দিয়ে ফেলতে পারে। যদি দেয়, তাহলে এককভাবে বা দুই দলের কোনোটার সঙ্গে কোয়ালিশন করে তাঁরই আবার সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি। আর তা যদি না হয়, তাহলে নির্বাচনে তিনি পর্যাপ্ত আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল গঠন করতে পারবেন এবং তিনি হবেন বিরোধী দলের নেতা।
এ সবই এখন পর্যন্ত স্বপ্নপূরাণ, কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, বিএনপি আগামী নির্বাচনে না এলে তার অস্তিত্ব যেমন সংকটাপন্ন হবে, তেমনি বিএনপিকে নির্বাচনে না আনতে পারলে সেই নির্বাচন দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অনেক ভালো কাজ করেছে। যেটা পারেনি তা হলো, দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়া। এর বড় কারণই হলো যে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে শেখ হাসিনা এবার সরকার গঠন করেছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযুক্ত, দক্ষ ও যোগ্য মন্ত্রী দ্বারা তিনি সরকার গঠন করতে পারেননি। তার কাফ্ফরা এখন তিনি দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক সরকার দক্ষ ও যোগ্য না হলে যা হয়, আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। বাংলাদেশেও এখন তা-ই হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের আমলাতন্ত্রও আবার ব্রিটিশ আমলের (এমনকি পাকিস্তান আমলের) মতো সুশিক্ষিত ও দক্ষ নয়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মনে যত আন্তরিক ইচ্ছাই থাকুক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য মন্ত্রী এবং অদক্ষ আমলাদের কর্তৃত্বে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে, তা দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারছে না। পদে পদে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এখন বর্তমান সরকারের হাতে সময় খুবই কম। অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী যদি মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটিয়ে দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়ার মতো দক্ষ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার পুনর্গঠন না করেন, তাহলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, সেটা বড় কথা হবে না, আওয়ামী লীগ তার নিজের ভ্রান্তি ও একগুঁয়েমির জন্য এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। তাকে বিপর্যস্ত করার জন্য কোনো বড় শত্রুর দরকার হবে না।
লন্ডন, ২৩ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০১১
লন্ডনে বসে এসব কথাবার্তা শুনি, আর ঢাকার বন্ধুবান্ধব, যাঁদের সঙ্গে আবার নিত্য যোগাযোগ, তাঁদের কাছে সংশয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি তাঁরা এ সম্পর্কে কী ভাবছেন? আমার এক রাজনীতিক-কাম-কলামিস্ট বন্ধু বলেছেন, 'বিএনপির গায়ে এত কালি যে তারা আগামী নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারবে না। তা জেনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করে তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির দ্বারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে।'
তাদের সহযোগী ও মিত্র যুদ্ধাপরাধীদের দলটি তো নিশ্চিতভাবে জানে, আগামী নির্বাচনে তাদের বিলুপ্তি নিশ্চিত। তারা ১৯৭৫ সালের মতো আরেকটি ঘটনা ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জঙ্গিদের উসকে দিয়ে তারা যে এই চেষ্টা করতে পারে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার প্রমাণ। এর সঙ্গে বিএনপির হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ তো এখন উঠে আসছে। আমার এই বন্ধুর ভয় আগামী নির্বাচনের ফল নিয়ে নয়; তাঁর ভয় শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে।
অন্যদিকে আমার এক প্রবীণ কলামিস্ট বন্ধু, যিনি এখনো আওয়ামী লীগপন্থী, কিন্তু 'প্রথম আলোর' নিরপেক্ষ কলামিস্ট, তাঁর মতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৬০টি আসন পেলেও তিনি বিস্মিত হবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি, তাহলে কি আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল জয় (massive victory) নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসবে? তিনি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত।
বন্ধুদের কথা থাক, আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করেন, দেশের আশু ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছি? নির্বাচন তো দ্রুত এগিয়ে আসছে। কী হতে পারে? আমার জবাব, আরো কয়েকটা মাস না গেলে কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানেও যেভাবে দেশ চালাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী যেভাবে কথাবার্তা বলছেন, তার যদি পরিবর্তন না হয় এবং যথাসময়ে নির্বাচন হলে যদি বিএনপি তাতে যোগ দেয়, তাহলে হ্যাং পার্লামেন্ট বা ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়ে যেতে পারে। তাতে ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির মতো সুবিধা হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির। এরশাদ তাহলে রাষ্ট্রপতি অথবা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদটি কোয়ালিশন গঠনের শর্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে দল এই শর্তে রাজি হবে, তাদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন।
তবে পরিস্থিতি অন্যদিকেও গড়াতে পারে। বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে, তবে দৃশ্যান্তর ঘটতে পারে অন্যভাবে। সে কথায় পরে আসছি। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের এখনকার বক্তব্য অত্যন্ত পরস্পরবিরোধী। এক মুখে তারা বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন এবং সেই সরকারের তদারকি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। অন্যদিকে স্বয়ং খালেদা জিয়া দাবি করছেন, এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই। যদি হাসিনা সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে এই মুহূর্তে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়; তাহলে বিএনপি কি এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাবে? এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না এবং তার জবাবও বিএনপি দিচ্ছে না।
আমার ধারণা, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার দাবিতে যতই দরকষাকষি করুক, শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় এসে (সরকারকেও সমঝোতায় আসতে হবে) নির্বাচনে যোগ দিতে হবে। নির্বাচনে জেতা সম্পর্কে তাদের মনে এখন ক্ষীণ হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। ফলে সাংগঠনিকভাবে ভাঙা ঘর জোড়া দিতে পারলে তারা নির্বাচনে আসবে। আওয়ামী লীগকে সহজ ওয়াকওভার দেবে না।
তারা জানে, এই ওয়াকওভার দেওয়ার অর্থ হবে মুসলিম লীগের মতো বিএনপির অস্তিত্বের বিলুপ্তি। বিএনপি কোনো আদর্শের ঐক্যে বাঁধা দল নয়। ক্ষমতা ও বিভিন্ন স্বার্থ-সুবিধার লোভে বিভিন্ন দলের এবং দলবিহীন সুযোগসন্ধানী নেতা-কর্মীরা এসে বিএনপিতে জুটেছিলেন। এই দলের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে 'আপসহীন নেত্রী'র প্রতি কোনো প্রকার আনুগত্য বা ভালোবাসা থেকে তাঁরা নেত্রীকে বা তাঁর দলকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন, তার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে দলের অনেকেরই টনক নড়ে উঠেছে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই দেখলে মওদুদ আহমদ এবং তাঁর মতো আরো অনেকে 'দেশনেত্রী'কে ছেড়ে দিয়ে 'পল্লীবন্ধুর' দলে আবার চলে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাকে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছেন, বিএনপি যদি আগামী সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে অবশিষ্ট যে দু-তিনজন শীর্ষ নেতা এখনো আছেন, তাঁরা জে. এরশাদের জাতীয় পার্টিতে চলে যেতে পারেন। যদি তাঁরা না-ও যান, তাহলেও তাঁদের আনুগত্যের ওপর বেগম জিয়া আর ষোল আনা নির্ভর করতে পারছেন না। বিশেষ করে মওদুদ আহমদের চরিত্র তিনি ভালোভাবে জানেন।
সম্ভবত এসব কারণেই বিএনপি নেত্রী দল থেকে অপসারিত ড. বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী, কর্নেল অলি আহমদ (অব.) প্রমুখ পুরনো নেতাদের কাছে আবার ধরনা দিচ্ছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, সেই কাদের সিদ্দিকীকেও ডেকে এনে তাঁর দেওয়া গামছা উপহার হিসেবে গ্রহণ করছেন। যদি নির্বাচনের আগে তাঁর দলে ভাঙন দেখা দেয়, তাহলে দলে নেতৃত্বশূন্যতা ঠেকাতেও বিতাড়িতদের আবার সেধে দলে আনা তাঁর প্রয়োজন। তাঁর সুপুত্র তারেক রহমান যতই বিদেশে নাটের গুরু সেজে বসে থাকুন, গুরুতর দুর্নীতি থেকে শুরু করে হত্যা-ষড়যন্ত্রের মামলার আসামি হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসার সাহস দেখিয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াবেন, সে সম্ভাবনা কম।
কিন্তু বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্য কোনো অজুহাতে আগামী সাধারণ নির্বাচনে না যায়, তাহলে বিকল্প থেকে লিবারেল, লিবারেল থেকে ব্রিজ সিদ্দিকীর গামছা পার্টি পর্যন্ত ছোটাছুটি করে লাভ কী? বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তাঁরা কী আশায় ওই দলের সঙ্গে জোট বাঁধবেন? ডা. বি. চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, তিনি কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। এটা তো তাঁর মুখের কথা। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি না যায় এবং আওয়ামী লীগ থেকে যদি তাঁকে বা তাঁর দলকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়, তাহলে ডা. বি. চৌধুরী কী করবেন, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যত দূর জানি, আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদেরও বিকল্পধারার নেতাদের সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
আমার গণনা যদি ভুল না হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছাড়াই সরকারের সঙ্গে কোনো একধরনের সমঝোতা করে বিএনপিকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই নির্বাচনে যেতে হবে। সরকারকেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ ধরনের সমঝোতায় যেতে হবে। নইলে নির্বাচন যত অবাধ ও সুষ্ঠু হোক দেশবাসীর কাছে তা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আবার নির্বাচনে না গিয়ে কোনো ধরনের অশুভ শক্তির সহায়তায় বিএনপি দেশে কোনো অঘটন ঘটাতে পারবে বা আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে_সে পরিস্থিতি দেশে নেই এবং সে ক্ষমতাও তাদের কোমরে নেই। মির্জা ফখরুল ইসলামের বাগাড়ম্বর অসারের তর্জন-গর্জন মাত্র।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সুচতুর রাজনীতিক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ সম্ভবত এই আশায় দিন গুনছেন যে বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে, তাহলে আওয়ামী লীগের মহাজোট ত্যাগ করে তিনি তাঁর দল নিয়ে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সংসদের ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবেন। তাঁর মনে হয়তো ক্ষীণ আশা, দেশের মানুষ বড় দুটি দল সম্পর্কে এতই ক্ষুব্ধ ও হতাশ যে তারা হয়তো আগামী সাধারণ নির্বাচনে সেই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে জাতীয় পার্টির ভোটের বাঙ্ইে বেশি ভোট দিয়ে ফেলতে পারে। যদি দেয়, তাহলে এককভাবে বা দুই দলের কোনোটার সঙ্গে কোয়ালিশন করে তাঁরই আবার সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি। আর তা যদি না হয়, তাহলে নির্বাচনে তিনি পর্যাপ্ত আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল গঠন করতে পারবেন এবং তিনি হবেন বিরোধী দলের নেতা।
এ সবই এখন পর্যন্ত স্বপ্নপূরাণ, কী হবে তা এখন বলা মুশকিল। তবে এটা সত্য, বিএনপি আগামী নির্বাচনে না এলে তার অস্তিত্ব যেমন সংকটাপন্ন হবে, তেমনি বিএনপিকে নির্বাচনে না আনতে পারলে সেই নির্বাচন দেশের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অনেক ভালো কাজ করেছে। যেটা পারেনি তা হলো, দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়া। এর বড় কারণই হলো যে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে শেখ হাসিনা এবার সরকার গঠন করেছিলেন, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযুক্ত, দক্ষ ও যোগ্য মন্ত্রী দ্বারা তিনি সরকার গঠন করতে পারেননি। তার কাফ্ফরা এখন তিনি দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক সরকার দক্ষ ও যোগ্য না হলে যা হয়, আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। বাংলাদেশেও এখন তা-ই হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের আমলাতন্ত্রও আবার ব্রিটিশ আমলের (এমনকি পাকিস্তান আমলের) মতো সুশিক্ষিত ও দক্ষ নয়। ফলে প্রধানমন্ত্রীর মনে যত আন্তরিক ইচ্ছাই থাকুক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য মন্ত্রী এবং অদক্ষ আমলাদের কর্তৃত্বে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে, তা দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারছে না। পদে পদে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এখন বর্তমান সরকারের হাতে সময় খুবই কম। অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী যদি মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটিয়ে দেশকে সুশাসন উপহার দেওয়ার মতো দক্ষ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার পুনর্গঠন না করেন, তাহলে বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে কী আসবে না, সেটা বড় কথা হবে না, আওয়ামী লীগ তার নিজের ভ্রান্তি ও একগুঁয়েমির জন্য এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। তাকে বিপর্যস্ত করার জন্য কোনো বড় শত্রুর দরকার হবে না।
লন্ডন, ২৩ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০১১
No comments