সংবাদপত্রের সঙ্গে লাগবেন না by আতাউস সামাদ
বিশ্বজুড়েই মানুষের জীবনে আশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ফাঁক থাকে। এটাই যেন ভাগ্যের লিখন। তবে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গুটিকয়েক দেশ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কপাল বিশ্বের আর সবার চেয়ে খারাপ। দুঃখের সঙ্গেই এ কথাটা বলতে হলো, কারণ ২০০৯ পেরিয়ে এসে ওই বছরের দিকে তাকিয়ে আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি দেখতে পেলাম।
আর অদূর ভবিষ্যতে বর্তমানের ধারা যে পাল্টে যাবে, এমন মনে করার কোনো কারণ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। সেই পাকিস্তান আমল থেকে কোনো না কোনো অপশক্তি আমাদের রাজনৈতিক ভাগ্যে থাবা বসিয়েছে। অনেক যুদ্ধ এবং অনেক কষ্ট করে আমরা বারবার এসব অপশক্তিকে পরাভূত করেছি। আর প্রতিবারই বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি যে, এবার হয়তো দিনগুলো ভালো চলবে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই দেখেছি যে, নতুন অপশক্তি হুঙ্কার দিয়ে তার থাবা বিস্তার করে লাফিয়ে পড়েছে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর এবং আবারও হতাশায় ডুবে গেছি।
১/১১-খ্যাত সেনা আরোপিত জরুরি আইনের অসাংবিধানিক তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিমুক্ত এবং খাঁটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দুঃশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের মাধ্যমে দুই বছর ধরে দেশে দম বন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে অন্ধকূপে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু দেশের জনমতের সমর্থন না পেয়ে তারা জাতীয় সংসদের নির্বাচন দিয়ে সরে পড়তে বাধ্য হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে যে যতই সমালোচনা করুন না কেন, একথা সত্যি যে, তাঁর অনড় দাবির ফলে ওই নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ঘৃণিত জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য হয় তত্কালীন শাসকরা।
জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ায় এবং সারা দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর হাওয়া বইতে থাকায় দেশবাসী মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পায়। আর সবাই মিলে আশা করতে থাকি যে, ওই দুই বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আমরা নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করব। অর্থাত্ আমরা যে কেবল আমাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করব তাই নয়, একই সঙ্গে আমাদের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে, আইনের শাসন থাকবে এবং তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। সবার বাকস্বাধীনতা থাকবে। তথ্য ও মত প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে। পরমত সহিষ্ণুতা চর্চা করা হবে। সরকারের কাজে এবং দেশের অর্থনীতিতে দুর্নীতি থাকবে না, দেশের সব সমস্যা ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলো জাতীয় সংসদে খোলামেলাভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সংসদ, সরকার ও রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে। আর এসবের সম্মিলিত ফলে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
২০০৯ সালের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের এসব আশা পূর্ণ হয়নি। বরঞ্চ আমরা মন্ত্রীদের মুখে অনবরত শুনেছি অমুক আর তমুককে দেখে নেয়ার হুমকি ও ধমক। কথায় কথায় ভিন্নমতাবলম্বীদের দেশপ্রেমের ওপর কটাক্ষ, সরকার ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নির্লজ্জ দলীয়করণ এবং চাঁদা আদায় ও টেন্ডারবাজিতে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্টদের নগ্ন সহিংসতা। দেশবাসী দেখছে, ছাত্রাবাসগুলো থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের উত্খাত করার পর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও বাকি রাখেনি। কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ সক্রিয়তাবাদীদের সংঘর্ষ ঘটেছে।
বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের এখন নতুন করে দেশের ক্ষমতা বিন্যাসের বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। অবাক করার মতো না হলেও মজার ব্যাপার হলো যে, ১/১১ ব্র্যান্ডের শাসকরা যাদের গায়ে দুর্নীতির তকমা এঁটে হয় জেলে ভরেছিল অথবা দেশছাড়া করেছিল, তারা এখন রাজহাঁসের মতোই পালকের এক ঝাড়ায় শরীরের সব কাদা ফেলে দিয়েছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সগৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে বা তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা এখন আর কেউ বলে না। বরঞ্চ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথাই বলা হচ্ছে। আসলেও তারা যদি অন্যায় না করে থাকেন, তাহলে তাদের স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়া তো ঠিকই। তবে সবারই ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে যায় যদি দেখা যায় যে, কাউকে অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে।
২. বিগত বছরটিতে বাংলাদেশে যে শ্রেণীটি বিশেষ করে সৌভাগ্যবঞ্চিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে সাংবাদিককুল। এখানে উল্লেখ করে রাখি যে, তার আগে ১/১১-র জরুরি অবস্থার সময় গণমাধ্যম তাদের স্বাধীনতা অনেকখানি হারিয়েছিল। সামরিক ও বেসামরিক দুই রকমের কর্তাদের কাছ থেকেই অলিখিত নির্দেশ আসত কোন খবর প্রাধান্য পাবে, আর কোনটার কথা ভুলে যেতে হবে সে ব্যাপারে। টেলিভিশনের বিষয়ে ছিল বেশি স্পর্শকাতরতা। আবার তাদের তৈরি বানোয়াট খবর ছাপানোর জন্য ছিল চাপাচাপি। নিপীড়নের আতঙ্কও ছিল। তবু ওই গুমোট পরিবেশের মধ্যেও কিছু একগুঁয়ে সাংবাদিক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রধান দুই দলের দুই কারারুদ্ধ নেত্রীকে মুক্তি দেয়ার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং এটা তারা করেছেন এমন একটা সময় যখন রাজনীতিবিদরা কথা বলতে পারছিলেন না। সেদিক থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তারা সঙ্গতভাবেই স্বাভাবিক ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ আশা করেছিলেন। অন্তত তাদের পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে। কিন্তু তা হয়নি।
সদ্যনির্বাচিত এমপি ও উপজেলা প্রতিনিধিদের অনেকে নিজেদের এলাকায় তারা সার্বভৌম, এমন একটা মেজাজ নিয়ে অতীতের সুবেদারদের মতো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। নগদ নারায়ণ কামাবার মতলবে চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। রাজা-বাদশাহর মতো শান-শওকত করে চলাফেরা করা তাদের জন্মগত অধিকার এমন ভাব দেখিয়েছেন। আর সে জন্য তাদের অনুগতরা অন্যের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেছে। সাংবাদিকরা যখন এসব বেআইনি কাজ সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন করেছেন তখনই তাদের ওপর নগ্ন হামলা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন তার মাত্র একটি দিক।
সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ বিদেশি তেল কোম্পানি শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার একটি কাজ অপ্রয়োজনেও দিয়ে দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ও এক আপনজনকে উেকাচ দানের অভিযোগ-সম্বলিত একটি চিঠি সরকারের তদন্তাধীন আছে, এ খবর প্রকাশ করার অপরাধে পত্রিকাটির ওপর হামলে পড়েছে এ গণতন্ত্রবিরোধী চক্রটি। প্রথমে দুই মন্ত্রী ও এক সরকারদলীয় নেতা আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলাফেরা করতে দেয়া হবে না মর্মে হুমকি দেন। তারপর অজ্ঞাত মোটরসাইকেল আরোহীরা ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক এম আবদুল্লাহর গাড়ি ধাওয়া করে ইট নিক্ষেপ করে তাকে আহত করে ও তার গাড়ির চালককে বেধড়ক পিটুনি দেয়। তারপর গায়ে-গতরে আক্রমণ বন্ধ হলেও এক অভূতপূর্ব মামলা অভিযান শুরু হয়েছে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের ওপর। এ পর্যন্ত দেশের ২৩টি জায়গায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ও সরকারি আইনজীবীরা তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা করে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। একটি মামলাতেই দাবি করা হয়েছে দশ হাজার মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ। এসব মামলায় আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য সমন এবং ওয়ারেন্টও জারি হয়েছে। মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন যে তিনজন তাঁরা আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। ছুটির বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের কোনো হয়রানি না করার নির্দেশ দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ নির্দেশের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং পরে আপিল আদালতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করার আবেদন করেছিলেন। তবে ছুটির বেঞ্চে আদেশ বলবত্ থাকে। অতঃপর গতকাল (৩ জানুয়ারি) হাইকোর্ট তাদের ৩ জনকে ৩ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেছেন।
৩. আমার দেশ পত্রিকার এ রিপোর্ট সংক্রান্ত ঘটনাবলীর মধ্যে চারটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. বিনা টেন্ডারে শেভরনকে যে এ কাজটি দেয়া হয়েছে, সরকার এ কথা স্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য হলো যে, এর আগে টেন্ডার আহ্বান করে সন্তোষজনক সাড়া পাওয়া যায়নি। দুই. শেভরনকে যেখানে একটি কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ দেয়া হয়েছে, সেখানে বর্তমানে ওরকম যন্ত্র বসানোর কোনো প্রয়োজন নেই, এ সম্পর্কে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ অভিমত রয়েছে। এমনকি ওই জায়গায় গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করে যে মাত্রায় আনার কথা বলা হচ্ছে এখন সেখানে ওই মাত্রায় চাপ বিদ্যমান, একথা পেট্রোবাংলার কাছে শেভরনও বলেছে বলে প্রকাশ। তিন. বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়া ও উেকাচ দানের অভিযোগ তুলে এক ব্যক্তি সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন এবং সরকার ও পেট্রোবাংলা ওই চিঠির বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করেছে। আমার দেশ এই চিঠি নিয়ে সরকারি পদক্ষেপ ও চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ করেছে এবং তারা নিজেরা কোনো অভিযোগ তোলা বা মন্তব্য করা থেকে সজ্ঞানে বিরত থেকেছে।
অর্থাত্ তারা শুধু একটি খবর পরিবেশন করেছে। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়ে সরকারের দেয়া প্রতিবাদলিপি প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। চার. যারা আমার দেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তারা কেউই ওই সংবাদে বর্ণিত ব্যক্তি নন। তারা কেবল সরকারি দলের সদস্য বা অনুগত ভক্ত।
বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ ও মিছিল করেছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও কিছু পেশাজীবী সংগঠন তাদের সমর্থন জানিয়েছে। দেশের প্রায় সবক’টি টেলিভিশন চ্যানেল এই প্রতিবাদ সমাবেশের সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করেছে। কিন্তু জাতীয় পত্রিকা পরিচয়ের দাবিদার বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা এই প্রতিবাদ ও সমাবেশের খবর ব্ল্যাক আউট করেছে। যদিও ওই সমাবেশে আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক এম আবদুল্লাহসহ সাম্প্রতিককালে সাংবাদিক নির্যাতনের সব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবাদপত্র কতখানি স্বাধীন, তারা কতটুকু স্বাধীন থাকতে চায় এবং সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব আইনের আওতার ভেতরে থেকেওবা কতটুকু পালন করতে পারবেন তার একটা পরীক্ষা চলছে দেশজুড়ে। তার কারণ হলো, শারীরিক হামলা, হুমকি ও লাগাতার মামলা। শোনা যাচ্ছে, গণমাধ্যম যাতে শৃঙ্খলা পালনের নামে স্বেচ্ছায় শৃঙ্খল পরিধান করে সে চেষ্টাও চলছে। অথচ প্রেস কাউন্সিলে একটি আবেদন বা মানহানির মাত্র একটি মামলা ও তার সুষ্ঠু শুনানির মধ্য দিয়ে অনেক বিতর্কিত বিষয় বা আলোচ্য প্রশ্নের সুরাহা হয়ে যেতে পারত।
৪. অস্বস্তিকর হলেও সবার মঙ্গল প্রত্যাশা করে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করছি এখানে। আজকাল আমাদের দেশে একটা কথা চালু হয়ে গেছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, মন্তব্যটা আমাদের দেশের জন্য সঠিক। তবে অবশ্যই এই বদভ্যাস পরিত্যাগ করা উচিত। কেন উচিত সেটা বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেই ইতিহাস বলে, আমাদের উপমহাদেশে যে শাসক সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের গায়ে নিপীড়নমূলক অথবা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে অথবা অযৌক্তিকভাবে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের গায়ে হাত দিয়েছেন, তারই পতন হয়েছে। দৃষ্টান্তগুলো দেখা যাক। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেই মুসলিম লীগ সরকার ঢাকার পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমানে বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক জনাব আবদুস সালামকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তার কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৫৪ সালে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সেই মুসলিম লীগ এমনভাবেই উত্খাত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) তারা আর মাথা তুলতে পারেনি। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক বলদর্পী জেনারেল আইউব খান যে দশ বছর বন্দুকের নল, পেশিশক্তি এবং দুর্নীতি-বাণিজ্যের মাধ্যমে সিংহাসনে বসেছিলেন, সে সময় তিনি বারবার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছেন কালাকানুন ও সরাসরি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে। তিনিও সম্পাদকদের জেলে ঢুকিয়েছেন। তার ক্ষমতার আসন টলমলে হয়ে যায় তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ফলে। তখন তারই সেনাপতি ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে। আইউব খান চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। ইয়াহিয়া খান ও তার হানাদার বাহিনী ’৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বন্দুক, কামান, ট্যাংক নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যা করা শুরু করে। সেই রাতে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়, তিনটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে আগুন দেয় এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের ওপর কামান দাগে। ওই আগুনে কবি সাংবাদিক শহীদ সাবের নিহত হন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই হানাদাররা কঠিন সেন্সরশিপ চালিয়ে যায় এবং ডিসেম্বর মাসে সাংবাদিক হত্যা শুরু করে। কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এই পরাজয় পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে তাদের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা। ওদিকে ইয়াহিয়া খানের দোসররাই তাকে গদিচ্যুত করে গৃহবন্দি করে রাখে। সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ ভুট্টো তার বিরুদ্ধাচরণকারী সংবাদপত্রগুলোতে গুণ্ডা বা পুলিশ দিয়ে হামলা করাতেন এবং বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেন। এই ব্যক্তিও তার সেনাপতির দ্বারা ফাঁসিকাষ্ঠে প্রেরিত হন এবং ফাঁসির দড়িতে তার মৃত্যু হয়। ভারতের সফল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনে ভীত হয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং খুবই কঠিন সেন্সরশিপ আরোপ করেন। বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিককে তার সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং বহু বিদেশি সাংবাদিক ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, অতঃপর জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সবশেষে দেশের ওপর একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিয়ে অন্যান্য অগণতান্ত্রিক আচরণের সঙ্গে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেন এবং সর্বশেষে চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আর সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। অনেকেই ১৯৭৫’র আগস্ট মাসে তার মর্মান্তিক পতন ও জীবননাশের জন্য সংবাদপত্র দমনকে অন্যতম কারণ বলে অভিহিত করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বেশ কিছুটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত ধীরগতিতে। জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট প্রয়োগ করে বারবার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৮৭’র নভেম্বরে গণআন্দোলনের সময় বিবিসিতে রিপোর্টিংয়ের কারণে এই লেখককে কারারুদ্ধ করেন। পরে প্রবীণ সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদকেও গ্রেফতার করেন। সেবারের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও ১৯৯০-তে জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবে হামলা চালায়। তার সরকার এই কলঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬-তে ক্ষমতায় আসার পর দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা লোকসানের নামে বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া তাঁর অনুগত কিছু লোক সাংবাদিকদের যে ধরনের দৈহিক নির্যাতন করেছিল তা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। ২০০১’র নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল হেরে যায়। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে পরোক্ষভাবে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন বণ্টনে পক্ষপাতিত্ব ছিল প্রকট। তার আমলে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও লেখক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং সাংবাদিক সেলিম স?
১/১১-খ্যাত সেনা আরোপিত জরুরি আইনের অসাংবিধানিক তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিমুক্ত এবং খাঁটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দুঃশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের মাধ্যমে দুই বছর ধরে দেশে দম বন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে অন্ধকূপে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু দেশের জনমতের সমর্থন না পেয়ে তারা জাতীয় সংসদের নির্বাচন দিয়ে সরে পড়তে বাধ্য হয়। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে যে যতই সমালোচনা করুন না কেন, একথা সত্যি যে, তাঁর অনড় দাবির ফলে ওই নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ঘৃণিত জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য হয় তত্কালীন শাসকরা।
জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ায় এবং সারা দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জোর হাওয়া বইতে থাকায় দেশবাসী মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পায়। আর সবাই মিলে আশা করতে থাকি যে, ওই দুই বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আমরা নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করব। অর্থাত্ আমরা যে কেবল আমাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করব তাই নয়, একই সঙ্গে আমাদের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে, আইনের শাসন থাকবে এবং তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। সবার বাকস্বাধীনতা থাকবে। তথ্য ও মত প্রকাশের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে। পরমত সহিষ্ণুতা চর্চা করা হবে। সরকারের কাজে এবং দেশের অর্থনীতিতে দুর্নীতি থাকবে না, দেশের সব সমস্যা ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলো জাতীয় সংসদে খোলামেলাভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সংসদ, সরকার ও রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আসবে। আর এসবের সম্মিলিত ফলে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
২০০৯ সালের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের এসব আশা পূর্ণ হয়নি। বরঞ্চ আমরা মন্ত্রীদের মুখে অনবরত শুনেছি অমুক আর তমুককে দেখে নেয়ার হুমকি ও ধমক। কথায় কথায় ভিন্নমতাবলম্বীদের দেশপ্রেমের ওপর কটাক্ষ, সরকার ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে নির্লজ্জ দলীয়করণ এবং চাঁদা আদায় ও টেন্ডারবাজিতে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্টদের নগ্ন সহিংসতা। দেশবাসী দেখছে, ছাত্রাবাসগুলো থেকে ভিন্ন মতাবলম্বীদের উত্খাত করার পর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও বাকি রাখেনি। কোনো কোনো জায়গায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ সক্রিয়তাবাদীদের সংঘর্ষ ঘটেছে।
বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের এখন নতুন করে দেশের ক্ষমতা বিন্যাসের বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। অবাক করার মতো না হলেও মজার ব্যাপার হলো যে, ১/১১ ব্র্যান্ডের শাসকরা যাদের গায়ে দুর্নীতির তকমা এঁটে হয় জেলে ভরেছিল অথবা দেশছাড়া করেছিল, তারা এখন রাজহাঁসের মতোই পালকের এক ঝাড়ায় শরীরের সব কাদা ফেলে দিয়েছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সগৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে বা তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা এখন আর কেউ বলে না। বরঞ্চ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথাই বলা হচ্ছে। আসলেও তারা যদি অন্যায় না করে থাকেন, তাহলে তাদের স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়া তো ঠিকই। তবে সবারই ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে যায় যদি দেখা যায় যে, কাউকে অতিরিক্ত সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে।
২. বিগত বছরটিতে বাংলাদেশে যে শ্রেণীটি বিশেষ করে সৌভাগ্যবঞ্চিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে সাংবাদিককুল। এখানে উল্লেখ করে রাখি যে, তার আগে ১/১১-র জরুরি অবস্থার সময় গণমাধ্যম তাদের স্বাধীনতা অনেকখানি হারিয়েছিল। সামরিক ও বেসামরিক দুই রকমের কর্তাদের কাছ থেকেই অলিখিত নির্দেশ আসত কোন খবর প্রাধান্য পাবে, আর কোনটার কথা ভুলে যেতে হবে সে ব্যাপারে। টেলিভিশনের বিষয়ে ছিল বেশি স্পর্শকাতরতা। আবার তাদের তৈরি বানোয়াট খবর ছাপানোর জন্য ছিল চাপাচাপি। নিপীড়নের আতঙ্কও ছিল। তবু ওই গুমোট পরিবেশের মধ্যেও কিছু একগুঁয়ে সাংবাদিক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রধান দুই দলের দুই কারারুদ্ধ নেত্রীকে মুক্তি দেয়ার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং এটা তারা করেছেন এমন একটা সময় যখন রাজনীতিবিদরা কথা বলতে পারছিলেন না। সেদিক থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তারা সঙ্গতভাবেই স্বাভাবিক ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ আশা করেছিলেন। অন্তত তাদের পেশাগত কাজের ক্ষেত্রে। কিন্তু তা হয়নি।
সদ্যনির্বাচিত এমপি ও উপজেলা প্রতিনিধিদের অনেকে নিজেদের এলাকায় তারা সার্বভৌম, এমন একটা মেজাজ নিয়ে অতীতের সুবেদারদের মতো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। নগদ নারায়ণ কামাবার মতলবে চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। রাজা-বাদশাহর মতো শান-শওকত করে চলাফেরা করা তাদের জন্মগত অধিকার এমন ভাব দেখিয়েছেন। আর সে জন্য তাদের অনুগতরা অন্যের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেছে। সাংবাদিকরা যখন এসব বেআইনি কাজ সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশন করেছেন তখনই তাদের ওপর নগ্ন হামলা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন তার মাত্র একটি দিক।
সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশ বিদেশি তেল কোম্পানি শেভরনকে ৩৭০ কোটি টাকার একটি কাজ অপ্রয়োজনেও দিয়ে দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ও এক আপনজনকে উেকাচ দানের অভিযোগ-সম্বলিত একটি চিঠি সরকারের তদন্তাধীন আছে, এ খবর প্রকাশ করার অপরাধে পত্রিকাটির ওপর হামলে পড়েছে এ গণতন্ত্রবিরোধী চক্রটি। প্রথমে দুই মন্ত্রী ও এক সরকারদলীয় নেতা আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলাফেরা করতে দেয়া হবে না মর্মে হুমকি দেন। তারপর অজ্ঞাত মোটরসাইকেল আরোহীরা ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক এম আবদুল্লাহর গাড়ি ধাওয়া করে ইট নিক্ষেপ করে তাকে আহত করে ও তার গাড়ির চালককে বেধড়ক পিটুনি দেয়। তারপর গায়ে-গতরে আক্রমণ বন্ধ হলেও এক অভূতপূর্ব মামলা অভিযান শুরু হয়েছে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের ওপর। এ পর্যন্ত দেশের ২৩টি জায়গায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ও সরকারি আইনজীবীরা তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা করে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। একটি মামলাতেই দাবি করা হয়েছে দশ হাজার মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ। এসব মামলায় আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য সমন এবং ওয়ারেন্টও জারি হয়েছে। মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন যে তিনজন তাঁরা আগাম জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। ছুটির বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতি ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের কোনো হয়রানি না করার নির্দেশ দেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ নির্দেশের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং পরে আপিল আদালতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করার আবেদন করেছিলেন। তবে ছুটির বেঞ্চে আদেশ বলবত্ থাকে। অতঃপর গতকাল (৩ জানুয়ারি) হাইকোর্ট তাদের ৩ জনকে ৩ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেছেন।
৩. আমার দেশ পত্রিকার এ রিপোর্ট সংক্রান্ত ঘটনাবলীর মধ্যে চারটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. বিনা টেন্ডারে শেভরনকে যে এ কাজটি দেয়া হয়েছে, সরকার এ কথা স্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য হলো যে, এর আগে টেন্ডার আহ্বান করে সন্তোষজনক সাড়া পাওয়া যায়নি। দুই. শেভরনকে যেখানে একটি কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ দেয়া হয়েছে, সেখানে বর্তমানে ওরকম যন্ত্র বসানোর কোনো প্রয়োজন নেই, এ সম্পর্কে যথেষ্ট বিশেষজ্ঞ অভিমত রয়েছে। এমনকি ওই জায়গায় গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করে যে মাত্রায় আনার কথা বলা হচ্ছে এখন সেখানে ওই মাত্রায় চাপ বিদ্যমান, একথা পেট্রোবাংলার কাছে শেভরনও বলেছে বলে প্রকাশ। তিন. বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়া ও উেকাচ দানের অভিযোগ তুলে এক ব্যক্তি সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন এবং সরকার ও পেট্রোবাংলা ওই চিঠির বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত করেছে। আমার দেশ এই চিঠি নিয়ে সরকারি পদক্ষেপ ও চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে তথ্যভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ করেছে এবং তারা নিজেরা কোনো অভিযোগ তোলা বা মন্তব্য করা থেকে সজ্ঞানে বিরত থেকেছে।
অর্থাত্ তারা শুধু একটি খবর পরিবেশন করেছে। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়ে সরকারের দেয়া প্রতিবাদলিপি প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। চার. যারা আমার দেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তারা কেউই ওই সংবাদে বর্ণিত ব্যক্তি নন। তারা কেবল সরকারি দলের সদস্য বা অনুগত ভক্ত।
বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সাংবাদিক এম আবদুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ ও মিছিল করেছে। বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও কিছু পেশাজীবী সংগঠন তাদের সমর্থন জানিয়েছে। দেশের প্রায় সবক’টি টেলিভিশন চ্যানেল এই প্রতিবাদ সমাবেশের সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করেছে। কিন্তু জাতীয় পত্রিকা পরিচয়ের দাবিদার বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা এই প্রতিবাদ ও সমাবেশের খবর ব্ল্যাক আউট করেছে। যদিও ওই সমাবেশে আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক এম আবদুল্লাহসহ সাম্প্রতিককালে সাংবাদিক নির্যাতনের সব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবাদপত্র কতখানি স্বাধীন, তারা কতটুকু স্বাধীন থাকতে চায় এবং সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব আইনের আওতার ভেতরে থেকেওবা কতটুকু পালন করতে পারবেন তার একটা পরীক্ষা চলছে দেশজুড়ে। তার কারণ হলো, শারীরিক হামলা, হুমকি ও লাগাতার মামলা। শোনা যাচ্ছে, গণমাধ্যম যাতে শৃঙ্খলা পালনের নামে স্বেচ্ছায় শৃঙ্খল পরিধান করে সে চেষ্টাও চলছে। অথচ প্রেস কাউন্সিলে একটি আবেদন বা মানহানির মাত্র একটি মামলা ও তার সুষ্ঠু শুনানির মধ্য দিয়ে অনেক বিতর্কিত বিষয় বা আলোচ্য প্রশ্নের সুরাহা হয়ে যেতে পারত।
৪. অস্বস্তিকর হলেও সবার মঙ্গল প্রত্যাশা করে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করছি এখানে। আজকাল আমাদের দেশে একটা কথা চালু হয়ে গেছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, মন্তব্যটা আমাদের দেশের জন্য সঠিক। তবে অবশ্যই এই বদভ্যাস পরিত্যাগ করা উচিত। কেন উচিত সেটা বোঝার জন্য ইতিহাসের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেই ইতিহাস বলে, আমাদের উপমহাদেশে যে শাসক সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের গায়ে নিপীড়নমূলক অথবা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে অথবা অযৌক্তিকভাবে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের গায়ে হাত দিয়েছেন, তারই পতন হয়েছে। দৃষ্টান্তগুলো দেখা যাক। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেই মুসলিম লীগ সরকার ঢাকার পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমানে বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় এবং সম্পাদক জনাব আবদুস সালামকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তার কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৫৪ সালে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সেই মুসলিম লীগ এমনভাবেই উত্খাত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) তারা আর মাথা তুলতে পারেনি। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক বলদর্পী জেনারেল আইউব খান যে দশ বছর বন্দুকের নল, পেশিশক্তি এবং দুর্নীতি-বাণিজ্যের মাধ্যমে সিংহাসনে বসেছিলেন, সে সময় তিনি বারবার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছেন কালাকানুন ও সরাসরি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে। তিনিও সম্পাদকদের জেলে ঢুকিয়েছেন। তার ক্ষমতার আসন টলমলে হয়ে যায় তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের ফলে। তখন তারই সেনাপতি ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে। আইউব খান চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। ইয়াহিয়া খান ও তার হানাদার বাহিনী ’৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বন্দুক, কামান, ট্যাংক নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যা করা শুরু করে। সেই রাতে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়, তিনটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে আগুন দেয় এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের ওপর কামান দাগে। ওই আগুনে কবি সাংবাদিক শহীদ সাবের নিহত হন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই হানাদাররা কঠিন সেন্সরশিপ চালিয়ে যায় এবং ডিসেম্বর মাসে সাংবাদিক হত্যা শুরু করে। কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এই পরাজয় পাকিস্তানের সামরিক ইতিহাসে তাদের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা। ওদিকে ইয়াহিয়া খানের দোসররাই তাকে গদিচ্যুত করে গৃহবন্দি করে রাখে। সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ ভুট্টো তার বিরুদ্ধাচরণকারী সংবাদপত্রগুলোতে গুণ্ডা বা পুলিশ দিয়ে হামলা করাতেন এবং বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেন। এই ব্যক্তিও তার সেনাপতির দ্বারা ফাঁসিকাষ্ঠে প্রেরিত হন এবং ফাঁসির দড়িতে তার মৃত্যু হয়। ভারতের সফল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনে ভীত হয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং খুবই কঠিন সেন্সরশিপ আরোপ করেন। বেশ কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিককে তার সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং বহু বিদেশি সাংবাদিক ভারত থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, অতঃপর জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সবশেষে দেশের ওপর একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিয়ে অন্যান্য অগণতান্ত্রিক আচরণের সঙ্গে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেন এবং সর্বশেষে চারটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া আর সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। অনেকেই ১৯৭৫’র আগস্ট মাসে তার মর্মান্তিক পতন ও জীবননাশের জন্য সংবাদপত্র দমনকে অন্যতম কারণ বলে অভিহিত করেছেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বেশ কিছুটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত ধীরগতিতে। জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট প্রয়োগ করে বারবার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৮৭’র নভেম্বরে গণআন্দোলনের সময় বিবিসিতে রিপোর্টিংয়ের কারণে এই লেখককে কারারুদ্ধ করেন। পরে প্রবীণ সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদকেও গ্রেফতার করেন। সেবারের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও ১৯৯০-তে জনগণ তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবে হামলা চালায়। তার সরকার এই কলঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬-তে ক্ষমতায় আসার পর দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা লোকসানের নামে বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া তাঁর অনুগত কিছু লোক সাংবাদিকদের যে ধরনের দৈহিক নির্যাতন করেছিল তা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। ২০০১’র নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল হেরে যায়। বেগম জিয়ার দ্বিতীয় শাসনামলে পরোক্ষভাবে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন বণ্টনে পক্ষপাতিত্ব ছিল প্রকট। তার আমলে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও লেখক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং সাংবাদিক সেলিম স?
No comments