যুক্তি তর্ক গল্প-ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গভীরতা ও জটিলতা by আবুল মোমেন
বাংলাদেশ ও ভারত ভৌগোলিকভাবে অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাস ও সংস্কৃতির যোগ অনেক সময় কেটে যায়, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানগত বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাকিস্তানও (অর্থা ৎ অতীতের পশ্চিম পাকিস্তান) ভারতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভৌগোলিক সম্পর্কে বাধা থাকলেও দেশটি ভারতবর্ষের পশ্চিমের শেষ সীমান্ত হওয়ায় বাংলাদেশের মতো সে দেশের
ভারতবেষ্টিত অবস্থা নয়। তা ছাড়া সংস্কৃতিগতভাবে পাকিস্তানের পক্ষে সহজেই আরও পশ্চিমের আরব বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন অপেক্ষাকৃত সহজ। তার আরও কারণ, দেশটির জন্মই হয়েছিল ইসলাম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার চেতনাকে ভিত্তি করে।
তাই একই কারণে একত্তর-পূর্ব আমলে পাকিস্তান যখন চূড়ান্ত ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছিল, তখন তার প্রভাব দেশের দুই অংশে দুই রকম বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিল। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান যে চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত, যথা—পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সেগুলোর মধ্যে পাঞ্জাব ব্যতীত আর কোনোটিরই ভারতীয় কোনো রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি চলমান সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল না। বরং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের এবং বেলুচিস্তানের সঙ্গে ইরানের একটি অংশের সাংস্কৃতিক যোগ রয়েছে।
পাঞ্জাবই ভারত ভাগের সময় বাংলার মতো ভাগ হয়েছিল—বাংলার ঠিক বিপরীতভাবে পূর্বাংশ ভারতে ও পশ্চিমাংশ যায় পাকিস্তানে। কিন্তু পাঞ্জাবি ভাষায় বাংলার মতো উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তা ছাড়া বাংলা ভাষা ১৮৪৪ সাল থেকে যুক্ত বাংলায় গণশিক্ষার বাহন হিসেবে স্বীকৃত হয়। একই সময় থেকে বাংলা ভাষায় গণমাধ্যমেরও বিকাশ ঘটে। ফলে দ্রুত বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটে, যা শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা সৃষ্টি করে। পাঞ্জাবের মুসলমান উর্দু ভাষা গ্রহণ করেছে আর হিন্দু সম্প্রদায় হিন্দি ভাষার চর্চা করেছে। সেখানকার অন্য বড় ও শক্তিশালী সম্প্রদায় শিখরা তাদের মাতৃভাষা গুরুমুখীর চর্চা বজায় রাখলেও তা সাহিত্য, গণশিক্ষা ও গণমাধ্যমের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়নি। ফলে পাঞ্জাব ভাগ হলেও তাদের কোনো পক্ষের দিক থেকেই সাংস্কৃতিক যৌথ উত্তরাধিকার বহন ও ঐক্য রক্ষার তাগিদ ছিল না। আর বেলুচ, সিন্ধি ও পশতুনদের সাহিত্য বাংলা বা উর্দুর মতো অত সমৃদ্ধ ও ব্যাপক নয়। তদুপরি তাদের ভাষা বাংলার মতো গণশিক্ষা ও শক্তিশালী গণমাধ্যমের বাহনও হয়নি। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একধরনের দায়মুক্ত ছিল ভারতসংশ্লিষ্টতা থেকে। এ ধরনের নিঃশর্ত অবস্থায় পাকিস্তানের দিক থেকে ভারতবিরোধিতার রাজনীতি অবাধে বেগবান হয়েছে। প্রায়ই ভারতের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। এই বিরোধ ও সংঘাত থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ও জাতিগতভাবে আত্মবিকাশের পুঁজি সংগ্রহ করতে চেয়েছে। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত দেখা যায়, দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে পারস্পরিক বর্জনের দিকটাই জোরদার হয়েছে, গ্রহণের দিক নয়। পাকিস্তানের প্রসঙ্গটা আজ জরুরি নয়, আজকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনাই জরুরি।
মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর প্রত্যাশিত ফল না দেওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই রাজনীতিবিদ, সরকার, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও জনগণের মধ্যে সংগতভাবেই হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশার কথা, কোনো পক্ষই এ নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। এ থেকে আমরা যদি বলি, এবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটা পরিণত পর্বের সূচনা হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাহলে হয়তো সিদ্ধান্তটা একটু সরল বলে মনে হবে। কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় যে তা একেবারে ভুল হবে না। এর কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের দায় বা গরজ উভয় পক্ষের উপলব্ধিতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ অনেক দিন পরে যেন পুরোনো পাকিস্তানি ধারার অন্ধ ভারতবিরোধিতার ভাবাবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এটা বোঝা যাচ্ছে, মনমোহনের সফর ঘিরে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন জেগেছিল, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুঁয়েমিতে ভেঙে পড়লেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ভাঙাকে গড়ার পক্ষে নেওয়ার অভিপ্রায়ই তুলে ধরেছে। দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও একই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে।
অনেককাল ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের বিষয়টি গভীরভাবে নেয়নি। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে—প্রথমত, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে সব বাঙালির প্রতি যে আবাহন আছে, সে বিষয়ে তাদের মনে সংশয়-সন্দেহ কাজ করে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের সরকারি অবস্থান ছিল পাকিস্তানি ধারায়, যা সরাসরি ভারতীয় স্বার্থকে বিঘ্নিত করে। প্রথম কারণটির মতোই একটা ভীতি বরাবর কাজ করেছে পাকিস্তান সরকারের মধ্যে এবং এ দেশের পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে। তারা ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পার্থক্যটা যাতে প্রখর থাকে এবং তা বরাবর দেশবাসীর চর্চার মধ্যে থাকে, সে জন্য রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ব ও ভারতবিরোধী মনোভাব তুলে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু একদিকে দীর্ঘ সময়—প্রায় চার দশক অতিবাহিত হওয়ার পর এখন আর দেশ ভারতের করদ রাজ্য হয়ে পড়ার ভয় সাধারণ মানুষের মন থেকে কেটে গেছে। আর অন্যদিকে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে যাতায়াত, যোগাযোগ, নানামাত্রিক সম্পর্ক এতই বাড়ছে যে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার বোধগুলো কার্যকর হতে শুরু করেছে। তারা অন্য দেশ, অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলামেশায় আর ভয় পায় না, অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আমাদের উদ্যোগী কর্মী মানুষেরা বরং যেন ব্যবসায় ও কর্মদক্ষতায় ভারতসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
বহুকাল নেপথ্যে ও বঞ্চিত থেকে এবং অনুন্নয়নের জাঁতাকলে পড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোও এখন আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। উন্নয়ন তাদেরও চায়, তারাও বাইরের জগতের সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পর্কে জড়াতে ও ছড়াতে চায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনগুলো দমন করে এখন এসব রাজ্যের ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষার পথের বাধা দূর করার দায়বদ্ধতায় রয়েছে। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে পাকিস্তান বরাবর প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। সেই ধারা ধরে রেখেছিল বিএনপি, জাপা। ফলে দীর্ঘকাল ভারতের কাছে বাংলাদেশ ছিল আরেকটি পাকিস্তান। এখন সে যুগ আর নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে বিচ্ছিন্নতা ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সদিচ্ছা ভালোভাবে প্রমাণিত। এখন ভারতকেই বাংলাদেশের বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে হবে। পাশাপাশি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এখন অতীতের উপেক্ষা ও সন্দেহের জায়গা থেকে সদিচ্ছা ও সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে হবে। সেটার ওপর দুই দেশের সম্পর্ক ফলপ্রসূ হওয়া এবং বিশেষভাবে এবারের হোঁচট থেকে বেরিয়ে আসা নির্ভর করবে। তবে বুঝতে অসুবিধা নেই, ভারতকে গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ চাপও সামলাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বাণিজ্য-ঘাটতি মেটানোর ও শুল্কমুক্ত পণ্যসুবিধার যে চাপ আছে, তার পাল্টা চাপ রয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দিক থেকে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট করার অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখলেও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যু ৎ ক্রয়ের চুক্তির ব্যাপারে পুরোনো অনুদারতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিচয় দিয়েছে।
ফলে অপ্রত্যাশিত আঘাত কেবল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আসেনি, কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকেও এল। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় পশ্চিমবঙ্গের ত ৎ কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সহযোগিতার মনোভাব কেন্দ্রকে স্বস্তিতে রেখেছিল। মমতা কিন্তু মনমোহন বা জ্যোতি বসুর মতো অভিজাত ঘরানার রাজনীতিক নন, মাঠ থেকে উঠে আসা আন্দোলনকারী প্রতিবাদী নেত্রী। এ ধরনের রাজনীতিবিদেরা প্রতিবাদে অভ্যস্ত, সেটাই তাঁদের মজ্জাগত সংস্কৃতি। এটা মনমোহন সিং বা তাঁর উপদেষ্টারা যেমন বুঝতে পারেননি, তেমনি বাংলাদেশ পক্ষের ধারণার মধ্যেও ছিল না। মমতা নিজে যেমন মেজাজি নেত্রী, তেমনি আবার জনগণের মেজাজ বুঝে চাল দিতেও সক্ষম। এবারের এই চালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরও শক্ত করে নিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি পুরোনো ধারার উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরই একটি ধরন। এ থেকে বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। মমতার কারণে ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও পুরোনো চক্রে ফিরে গেলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং তা মমতার রাজনৈতিক জীবনের এই সন্ধিক্ষণে ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ফল দেবে না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটটা এবং বাংলাদেশের জন্য তাদের করণীয় ও দায়বদ্ধতা বুঝতে হবে।
বলা যায়, আপাতত বেশ কিছু আরব্ধ কাজের দায় চাপল সবার ওপর। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই বেশি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন যুগ সৃষ্টির যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তাকে নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যথাসময়ে ট্রানজিট চুক্তি থেকে সরে এসে প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা আশা করতে পারি, যে সময় পাওয়া গেল তাকে উভয় পক্ষই এবারের ভুলগুলো বুঝে নেওয়া ও শুধরে নেওয়ার কাজেই ব্যবহার করবে। তাহলেই সাময়িক বাধার বেশি না হয়ে এবারের দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক একটি ইতিবাচক পরিণতির পথে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
তাই একই কারণে একত্তর-পূর্ব আমলে পাকিস্তান যখন চূড়ান্ত ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছিল, তখন তার প্রভাব দেশের দুই অংশে দুই রকম বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিল। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান যে চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত, যথা—পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সেগুলোর মধ্যে পাঞ্জাব ব্যতীত আর কোনোটিরই ভারতীয় কোনো রাজ্যের সঙ্গে সরাসরি চলমান সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ছিল না। বরং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের এবং বেলুচিস্তানের সঙ্গে ইরানের একটি অংশের সাংস্কৃতিক যোগ রয়েছে।
পাঞ্জাবই ভারত ভাগের সময় বাংলার মতো ভাগ হয়েছিল—বাংলার ঠিক বিপরীতভাবে পূর্বাংশ ভারতে ও পশ্চিমাংশ যায় পাকিস্তানে। কিন্তু পাঞ্জাবি ভাষায় বাংলার মতো উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। তা ছাড়া বাংলা ভাষা ১৮৪৪ সাল থেকে যুক্ত বাংলায় গণশিক্ষার বাহন হিসেবে স্বীকৃত হয়। একই সময় থেকে বাংলা ভাষায় গণমাধ্যমেরও বিকাশ ঘটে। ফলে দ্রুত বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটে, যা শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা সৃষ্টি করে। পাঞ্জাবের মুসলমান উর্দু ভাষা গ্রহণ করেছে আর হিন্দু সম্প্রদায় হিন্দি ভাষার চর্চা করেছে। সেখানকার অন্য বড় ও শক্তিশালী সম্প্রদায় শিখরা তাদের মাতৃভাষা গুরুমুখীর চর্চা বজায় রাখলেও তা সাহিত্য, গণশিক্ষা ও গণমাধ্যমের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়নি। ফলে পাঞ্জাব ভাগ হলেও তাদের কোনো পক্ষের দিক থেকেই সাংস্কৃতিক যৌথ উত্তরাধিকার বহন ও ঐক্য রক্ষার তাগিদ ছিল না। আর বেলুচ, সিন্ধি ও পশতুনদের সাহিত্য বাংলা বা উর্দুর মতো অত সমৃদ্ধ ও ব্যাপক নয়। তদুপরি তাদের ভাষা বাংলার মতো গণশিক্ষা ও শক্তিশালী গণমাধ্যমের বাহনও হয়নি। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তান ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একধরনের দায়মুক্ত ছিল ভারতসংশ্লিষ্টতা থেকে। এ ধরনের নিঃশর্ত অবস্থায় পাকিস্তানের দিক থেকে ভারতবিরোধিতার রাজনীতি অবাধে বেগবান হয়েছে। প্রায়ই ভারতের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। এই বিরোধ ও সংঘাত থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ও জাতিগতভাবে আত্মবিকাশের পুঁজি সংগ্রহ করতে চেয়েছে। ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত দেখা যায়, দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে পারস্পরিক বর্জনের দিকটাই জোরদার হয়েছে, গ্রহণের দিক নয়। পাকিস্তানের প্রসঙ্গটা আজ জরুরি নয়, আজকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনাই জরুরি।
মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর প্রত্যাশিত ফল না দেওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই রাজনীতিবিদ, সরকার, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও জনগণের মধ্যে সংগতভাবেই হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশার কথা, কোনো পক্ষই এ নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করেনি। এ থেকে আমরা যদি বলি, এবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটা পরিণত পর্বের সূচনা হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাহলে হয়তো সিদ্ধান্তটা একটু সরল বলে মনে হবে। কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় যে তা একেবারে ভুল হবে না। এর কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের দায় বা গরজ উভয় পক্ষের উপলব্ধিতে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ অনেক দিন পরে যেন পুরোনো পাকিস্তানি ধারার অন্ধ ভারতবিরোধিতার ভাবাবেগ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এটা বোঝা যাচ্ছে, মনমোহনের সফর ঘিরে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন জেগেছিল, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুঁয়েমিতে ভেঙে পড়লেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ভাঙাকে গড়ার পক্ষে নেওয়ার অভিপ্রায়ই তুলে ধরেছে। দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেও একই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে।
অনেককাল ধরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের বিষয়টি গভীরভাবে নেয়নি। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে—প্রথমত, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে সব বাঙালির প্রতি যে আবাহন আছে, সে বিষয়ে তাদের মনে সংশয়-সন্দেহ কাজ করে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের সরকারি অবস্থান ছিল পাকিস্তানি ধারায়, যা সরাসরি ভারতীয় স্বার্থকে বিঘ্নিত করে। প্রথম কারণটির মতোই একটা ভীতি বরাবর কাজ করেছে পাকিস্তান সরকারের মধ্যে এবং এ দেশের পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে। তারা ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পার্থক্যটা যাতে প্রখর থাকে এবং তা বরাবর দেশবাসীর চর্চার মধ্যে থাকে, সে জন্য রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ব ও ভারতবিরোধী মনোভাব তুলে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু একদিকে দীর্ঘ সময়—প্রায় চার দশক অতিবাহিত হওয়ার পর এখন আর দেশ ভারতের করদ রাজ্য হয়ে পড়ার ভয় সাধারণ মানুষের মন থেকে কেটে গেছে। আর অন্যদিকে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে যাতায়াত, যোগাযোগ, নানামাত্রিক সম্পর্ক এতই বাড়ছে যে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আন্তর্জাতিকতার বোধগুলো কার্যকর হতে শুরু করেছে। তারা অন্য দেশ, অন্য ধর্ম, অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলামেশায় আর ভয় পায় না, অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আমাদের উদ্যোগী কর্মী মানুষেরা বরং যেন ব্যবসায় ও কর্মদক্ষতায় ভারতসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত।
বহুকাল নেপথ্যে ও বঞ্চিত থেকে এবং অনুন্নয়নের জাঁতাকলে পড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোও এখন আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। উন্নয়ন তাদেরও চায়, তারাও বাইরের জগতের সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পর্কে জড়াতে ও ছড়াতে চায়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনগুলো দমন করে এখন এসব রাজ্যের ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষার পথের বাধা দূর করার দায়বদ্ধতায় রয়েছে। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে পাকিস্তান বরাবর প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। সেই ধারা ধরে রেখেছিল বিএনপি, জাপা। ফলে দীর্ঘকাল ভারতের কাছে বাংলাদেশ ছিল আরেকটি পাকিস্তান। এখন সে যুগ আর নেই, বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে বিচ্ছিন্নতা ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের সদিচ্ছা ভালোভাবে প্রমাণিত। এখন ভারতকেই বাংলাদেশের বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে হবে। পাশাপাশি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এখন অতীতের উপেক্ষা ও সন্দেহের জায়গা থেকে সদিচ্ছা ও সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে হবে। সেটার ওপর দুই দেশের সম্পর্ক ফলপ্রসূ হওয়া এবং বিশেষভাবে এবারের হোঁচট থেকে বেরিয়ে আসা নির্ভর করবে। তবে বুঝতে অসুবিধা নেই, ভারতকে গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ চাপও সামলাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের দিক থেকে বাণিজ্য-ঘাটতি মেটানোর ও শুল্কমুক্ত পণ্যসুবিধার যে চাপ আছে, তার পাল্টা চাপ রয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দিক থেকে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট করার অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখলেও ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যু ৎ ক্রয়ের চুক্তির ব্যাপারে পুরোনো অনুদারতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার পরিচয় দিয়েছে।
ফলে অপ্রত্যাশিত আঘাত কেবল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে আসেনি, কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকেও এল। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় পশ্চিমবঙ্গের ত ৎ কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সহযোগিতার মনোভাব কেন্দ্রকে স্বস্তিতে রেখেছিল। মমতা কিন্তু মনমোহন বা জ্যোতি বসুর মতো অভিজাত ঘরানার রাজনীতিক নন, মাঠ থেকে উঠে আসা আন্দোলনকারী প্রতিবাদী নেত্রী। এ ধরনের রাজনীতিবিদেরা প্রতিবাদে অভ্যস্ত, সেটাই তাঁদের মজ্জাগত সংস্কৃতি। এটা মনমোহন সিং বা তাঁর উপদেষ্টারা যেমন বুঝতে পারেননি, তেমনি বাংলাদেশ পক্ষের ধারণার মধ্যেও ছিল না। মমতা নিজে যেমন মেজাজি নেত্রী, তেমনি আবার জনগণের মেজাজ বুঝে চাল দিতেও সক্ষম। এবারের এই চালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরও শক্ত করে নিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটি পুরোনো ধারার উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরই একটি ধরন। এ থেকে বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। মমতার কারণে ভারত-বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও পুরোনো চক্রে ফিরে গেলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং তা মমতার রাজনৈতিক জীবনের এই সন্ধিক্ষণে ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ফল দেবে না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারতীয় আমলাতন্ত্রকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটটা এবং বাংলাদেশের জন্য তাদের করণীয় ও দায়বদ্ধতা বুঝতে হবে।
বলা যায়, আপাতত বেশ কিছু আরব্ধ কাজের দায় চাপল সবার ওপর। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই বেশি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন যুগ সৃষ্টির যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তাকে নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যথাসময়ে ট্রানজিট চুক্তি থেকে সরে এসে প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা আশা করতে পারি, যে সময় পাওয়া গেল তাকে উভয় পক্ষই এবারের ভুলগুলো বুঝে নেওয়া ও শুধরে নেওয়ার কাজেই ব্যবহার করবে। তাহলেই সাময়িক বাধার বেশি না হয়ে এবারের দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক একটি ইতিবাচক পরিণতির পথে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments