আশা হারাইনি এখনো কাজ বাকি by আইনুন নিশাত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বহুল আলোচিত ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে সেই চুক্তি সই হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
আজ প্রকাশ করা হলো ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের বিশ্লেষণ
মনমোহন সিংয়ের সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় প্রথমত আমি নিরাশ হয়েছি। তার মানে এই নয়, আমি আশা হারিয়ে ফেলেছি। একটি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে দুটি দিক কাজ করে—একটি কারিগরি, অন্যটি রাজনৈতিক। বাংলাদেশ তিস্তার অর্ধেক পানি পাবে বলে আলোচনার টেবিলে এই চুক্তির দলিল উঠেছিল, সেটাও একটা অগ্রগতি। বরং সরকারের উপদেষ্টারা হচ্ছে-হবে বলে বেশি উচ্চাশা তৈরি করেছিলেন। এটা ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে সঠিক ধারণা দেওয়া উচিত ছিল। সামনের দিনে একে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।
১৯৫২ সাল থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছিল। ১৯৮২ সাল থেকে আমি যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবারই শুনতাম, কিন্তু কোন দেশ কত শতাংশ পানি পাবে, সে ব্যাপারে একমত হওয়া যাচ্ছিল না। এবার অন্তত দুই দেশ পানির ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে একমত হয়েছে। অর্থাৎ, কোন দেশ কতটুকু পানি পাবে, নদীর জন্য কতটুকু পানি রাখা হবে, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। এটা একটা অগ্রগতি।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনোভাবের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতপার্থক্য দূর করার দায়িত্ব ভারত সরকারের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, খুব শিগগির তিস্তা চুক্তি হবে। এটা বরং ভালো হলো, কেননা বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য কিছুটা সময় পেল।
বাংলাদেশকে তিস্তার পানির অর্ধেক ভাগ দিয়ে যদি চুক্তি হয়, তাহলে তা তিন মাস পর বা এক বছর পর হলেও বড় কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের বক্তব্য অনুযায়ী পানির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করে যাওয়া। তবে মূল চুক্তি সম্পাদনের আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে, পানিপ্রবাহ কোথা থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়ানো জরুরি। গত শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ তিস্তা থেকে খুব কম পানি পেয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পানি বাড়লেও তাতে বাংলাদেশের খুব একটা লাভ হয়নি। চুক্তি হলে বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে পানি পাবে। তবে পানি চুক্তির বিষয়টি অবশ্যই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখলে হবে না। এটার সঙ্গে অবশ্যই নদী বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে রাখতে হবে।
মনমোহনের সাম্প্রতিক সফরের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় প্রমাণিত হলো, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক না হলে আমলারা নড়েচড়ে বসেন না। আমার মনে হয়, শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হওয়া উচিত। ইউরোপের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি নিয়মিতভাবে অভিন্ন সমস্যাগুলো নিয়ে বৈঠক করেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তিন-চার মাস পর পর নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। এতে দেশগুলোর মধ্যকার অনেক খুঁটিনাটি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথচ ১৯ মাস পর বৈঠক করলেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের দুই পরাক্রমশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা যদি নিয়মিত বৈঠক করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা কেন আলোচনায় বসতে পারবেন না।
হাসিনা-মনমোহনের মধ্যে সীমানা নির্ধারণে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মুহুরী নদী নিয়ে লেগে থাকা দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এই নদীর উৎসস্থল ভারতে হলেও পানির বেশির ভাগ অংশ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। র্যাডক্লিফ ভারতবর্ষের যে সীমানা নির্ধারণ করেছেন, তাতে মুহুরী নদীর মাঝবরাবর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণ হওয়ার কথা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই আমলে এই নদীর সীমানা নিয়ে অনেক বিরোধ ও রক্তক্ষয় হয়েছে।
গত ৫০ বছরে মুুহুরীর ভারতীয় অংশের পুরোটাতেই চর পড়ে গেছে। নতুন সীমানা নির্ধারণের ফলে চরের অংশটা ভারতীয় অংশে পড়েছে, আর পানিপ্রবাহের অংশটি বাংলাদেশে পড়েছে। ভারত তার নিজের অংশে শ্মশানঘাটসহ অনেক কিছু নির্মাণ করেছে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, সীমানা সব সময় স্থির থাকলেও নদীর গতিপথ পাল্টাতে পারে।
মনমোহন সিং তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, নদীর পানি হতে পারে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার অস্ত্র। তিনি ১৯৭২ সালের যৌথ নদী কমিশনের সভার ভূমিকায় এ কথা বলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তিতেও (ট্রিটি) সমতার ভিত্তিতে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। মনমোহন সিংয়ের বক্তৃতার সারবস্তু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, তিনি তিস্তার ক্ষেত্রে এই আদর্শ সামনে রেখে এগোতে চান। এটা খুবই ভালো লক্ষণ।
তবে সমতার ভিত্তিতে পানি বণ্টনের বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে দাঁড়ায়, ভারত অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার কথা বলছে, যা ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশও বলে আসছিল। কিন্তু অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা তখন সম্ভব, যখন কোনো একটি নদীর ওপর কোনো ধরনের স্থাপনা বা অমীমাংসিত সমস্যা থাকবে না।
আমরা গোমতী নদীর কথা ধরি। এই নদীর ভারতীয় অংশে একটি জলাধার ও মহারানী নামক স্থানে একটি ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে একটি সেচ প্রকল্প ও উঁচু বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। তিস্তা নদীর ওপরও ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশ ব্যারাজ তৈরি করেছে। এই স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে দুই দেশ আলোচনা করে মীমাংসা করার পর তবেই অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব, তার আগে নয়।
গঙ্গা, তিস্তা, মুহুরী ও ফেনী নদী ছাড়াও ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আরও প্রায় ৫০টি নদী আছে। এই নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার মধ্যে অন্য নদীগুলোকে একটি গুচ্ছে (ক্লাস্টার) ফেলে সমঝোতা হতে পারে। সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য এটা বড় কাজ।
মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনার আশাবাদ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি। এ জন্য যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, তা এখনো দেখা যাচ্ছে না। অনেকে মনে করে, যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে দর-কষাকষি করে নদীর পানি বণ্টন সম্ভব। কিন্তু এটা সঠিক চিন্তা নয়, যৌথ নদী কমিশন কারিগরি দিকগুলো দেখবে। দর-কষাকষি করবেন রাজনৈতিক নেতারা। বড় নদীগুলো নিয়ে ভারত, নেপাল, চীন ও ভুটানকে একত্র করতে হবে, নয়তো অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হবে না। সার্ককে এ ক্ষেত্রে সক্রিয় করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা নিয়মিতভাবে হতে হবে।
গত বুধবার এবিসি রেডিওর মিঠা-কড়া অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।
আইনুন নিশাত: পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
মনমোহন সিংয়ের সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় প্রথমত আমি নিরাশ হয়েছি। তার মানে এই নয়, আমি আশা হারিয়ে ফেলেছি। একটি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে দুটি দিক কাজ করে—একটি কারিগরি, অন্যটি রাজনৈতিক। বাংলাদেশ তিস্তার অর্ধেক পানি পাবে বলে আলোচনার টেবিলে এই চুক্তির দলিল উঠেছিল, সেটাও একটা অগ্রগতি। বরং সরকারের উপদেষ্টারা হচ্ছে-হবে বলে বেশি উচ্চাশা তৈরি করেছিলেন। এটা ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে সঠিক ধারণা দেওয়া উচিত ছিল। সামনের দিনে একে সফলতার দিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।
১৯৫২ সাল থেকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছিল। ১৯৮২ সাল থেকে আমি যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবারই শুনতাম, কিন্তু কোন দেশ কত শতাংশ পানি পাবে, সে ব্যাপারে একমত হওয়া যাচ্ছিল না। এবার অন্তত দুই দেশ পানির ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে একমত হয়েছে। অর্থাৎ, কোন দেশ কতটুকু পানি পাবে, নদীর জন্য কতটুকু পানি রাখা হবে, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে। এটা একটা অগ্রগতি।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনোভাবের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতপার্থক্য দূর করার দায়িত্ব ভারত সরকারের। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, খুব শিগগির তিস্তা চুক্তি হবে। এটা বরং ভালো হলো, কেননা বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য কিছুটা সময় পেল।
বাংলাদেশকে তিস্তার পানির অর্ধেক ভাগ দিয়ে যদি চুক্তি হয়, তাহলে তা তিন মাস পর বা এক বছর পর হলেও বড় কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের বক্তব্য অনুযায়ী পানির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করে যাওয়া। তবে মূল চুক্তি সম্পাদনের আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে, পানিপ্রবাহ কোথা থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়ানো জরুরি। গত শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ তিস্তা থেকে খুব কম পানি পেয়েছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পানি বাড়লেও তাতে বাংলাদেশের খুব একটা লাভ হয়নি। চুক্তি হলে বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে পানি পাবে। তবে পানি চুক্তির বিষয়টি অবশ্যই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখলে হবে না। এটার সঙ্গে অবশ্যই নদী বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে রাখতে হবে।
মনমোহনের সাম্প্রতিক সফরের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় প্রমাণিত হলো, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক না হলে আমলারা নড়েচড়ে বসেন না। আমার মনে হয়, শেখ হাসিনা ও মনমোহন সিংয়ের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হওয়া উচিত। ইউরোপের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি নিয়মিতভাবে অভিন্ন সমস্যাগুলো নিয়ে বৈঠক করেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তিন-চার মাস পর পর নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। এতে দেশগুলোর মধ্যকার অনেক খুঁটিনাটি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথচ ১৯ মাস পর বৈঠক করলেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বের দুই পরাক্রমশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা যদি নিয়মিত বৈঠক করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা কেন আলোচনায় বসতে পারবেন না।
হাসিনা-মনমোহনের মধ্যে সীমানা নির্ধারণে যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মুহুরী নদী নিয়ে লেগে থাকা দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এই নদীর উৎসস্থল ভারতে হলেও পানির বেশির ভাগ অংশ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। র্যাডক্লিফ ভারতবর্ষের যে সীমানা নির্ধারণ করেছেন, তাতে মুহুরী নদীর মাঝবরাবর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমানা নির্ধারণ হওয়ার কথা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই আমলে এই নদীর সীমানা নিয়ে অনেক বিরোধ ও রক্তক্ষয় হয়েছে।
গত ৫০ বছরে মুুহুরীর ভারতীয় অংশের পুরোটাতেই চর পড়ে গেছে। নতুন সীমানা নির্ধারণের ফলে চরের অংশটা ভারতীয় অংশে পড়েছে, আর পানিপ্রবাহের অংশটি বাংলাদেশে পড়েছে। ভারত তার নিজের অংশে শ্মশানঘাটসহ অনেক কিছু নির্মাণ করেছে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, সীমানা সব সময় স্থির থাকলেও নদীর গতিপথ পাল্টাতে পারে।
মনমোহন সিং তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, নদীর পানি হতে পারে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার অস্ত্র। তিনি ১৯৭২ সালের যৌথ নদী কমিশনের সভার ভূমিকায় এ কথা বলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তিতেও (ট্রিটি) সমতার ভিত্তিতে যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। মনমোহন সিংয়ের বক্তৃতার সারবস্তু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, তিনি তিস্তার ক্ষেত্রে এই আদর্শ সামনে রেখে এগোতে চান। এটা খুবই ভালো লক্ষণ।
তবে সমতার ভিত্তিতে পানি বণ্টনের বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে দাঁড়ায়, ভারত অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার কথা বলছে, যা ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশও বলে আসছিল। কিন্তু অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা তখন সম্ভব, যখন কোনো একটি নদীর ওপর কোনো ধরনের স্থাপনা বা অমীমাংসিত সমস্যা থাকবে না।
আমরা গোমতী নদীর কথা ধরি। এই নদীর ভারতীয় অংশে একটি জলাধার ও মহারানী নামক স্থানে একটি ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে একটি সেচ প্রকল্প ও উঁচু বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। তিস্তা নদীর ওপরও ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশ ব্যারাজ তৈরি করেছে। এই স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে দুই দেশ আলোচনা করে মীমাংসা করার পর তবেই অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব, তার আগে নয়।
গঙ্গা, তিস্তা, মুহুরী ও ফেনী নদী ছাড়াও ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আরও প্রায় ৫০টি নদী আছে। এই নদীগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার মধ্যে অন্য নদীগুলোকে একটি গুচ্ছে (ক্লাস্টার) ফেলে সমঝোতা হতে পারে। সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য এটা বড় কাজ।
মনমোহন সিং ও শেখ হাসিনার আশাবাদ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমি মনে করি। এ জন্য যে ধরনের উদ্যোগ দরকার, তা এখনো দেখা যাচ্ছে না। অনেকে মনে করে, যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে দর-কষাকষি করে নদীর পানি বণ্টন সম্ভব। কিন্তু এটা সঠিক চিন্তা নয়, যৌথ নদী কমিশন কারিগরি দিকগুলো দেখবে। দর-কষাকষি করবেন রাজনৈতিক নেতারা। বড় নদীগুলো নিয়ে ভারত, নেপাল, চীন ও ভুটানকে একত্র করতে হবে, নয়তো অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হবে না। সার্ককে এ ক্ষেত্রে সক্রিয় করা যেতে পারে। এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা নিয়মিতভাবে হতে হবে।
গত বুধবার এবিসি রেডিওর মিঠা-কড়া অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।
আইনুন নিশাত: পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments