ভিন্নমত-সভরিন বন্ড ইস্যু করা এত সহজ হবে না by আবু আহমেদ
বাংলাদেশ অর্থনীতি এক বড় ধরনের ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্যতার সংকটের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি এখন যে আকার এবং আমদানির যে পরিমাণ তাতে এই দেশের তহবিলে সব সময়ই কমপক্ষে ১১-১২ বিলিয়ন ডলার জমা থাকা দরকার।
এর নিচে থাকলে আমদানির বিপরীতে পে করা যেমন মুশকিল হবে, তেমনি কোনো বিদেশি সহজে এই অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না এই ভেবে যে বাংলাদেশ বুঝি পাছে তাঁদের আয়কে বৈদেশিক মুদ্রা ডলারে বাইরে নিতে দেবে না। বর্তমানে যেসব বহুজাতিক কম্পানি বাংলাদেশে চুটিয়ে ব্যবসা করছে তারাও সেই একই শঙ্কাবোধ করতে পারে। তারাও যে বিভিন্ন কায়দায় আয়কে বিদেশে পাঠাচ্ছে না বা আয়কে দেশে আনার পরিবর্তে বিদেশে ধারণ করছে না সে কথা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারবে না। বিদেশে বেআইনিভাবে অর্থ পাঠানোর এক পদ্ধতি হলো ট্রান্সফার প্রাইসিং। এই ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে পণ্য ও মেশিনপত্র কেনার ক্ষেত্রে ওভার ইন ভয়েসিং (Over Invoicing) করা হয়। দেশ থেকে বেশি অর্থ ডলারে বিদেশে চলে যাবে। এতে তাদেরই আর এক বিদেশি সিসটার কনসার্ন বা Subsidiary লাভবান হয় বেশি। ফলে তাদের বিদেশি শেয়ারহোল্ডাররা উপকৃত হন বেশি আর ঠকেন বাংলাদেশি শেয়ারহোল্ডাররা এবং বাংলাদেশ সরকার তথ্য রাজস্ব বোর্ড।
বাংলাদেশে কোনো স্বদেশি কম্পানি আজতক ট্রান্সফার প্রাইসিং (Transfer pricing) এর জন্য দণ্ডিত হয়েছে এমন জানা নেই। সত্য হলো এই আমাদের দেশে কোনো উপযুক্ত আইন নেই। অন্যদিকে রাজস্ব বোর্ডের নেই সেই ফাঁকি পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত লোকবল। তাই অনেকে বলেন, বাংলাদেশ হলো বিদেশি কম্পানিগুলোর জন্য বেআইনিভাবে আয়কে বিদেশে পাঠানোর জন্য স্বর্গরাজ্য।
বাংলাদেশ সরকার ফরেন এক্সচেঞ্জ ক্রাইসিসে পড়ে বা সম্ভাব্য ফরেন এক্সচেঞ্জ সংকট মোকাবিলা করার জন্য সোভারেন বন্ড তথা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব গ্যারান্টিতে ডলারে বিদেশিদের ক্রয় করার জন্য বন্ড ইস্যু করার কথা ভাবছে। একটা কথা সামনে আসতে পারে। সেটা হলো বাংলাদেশে যখন সুদের হার এতই বেশি তাহলে বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের থেকে কেন ডলার এনে এই দেশের সুদের বাজারে বিনিয়োগ করছে না? এর উত্তর হলো বাংলাদেশ যত বেশি সুদই দেক না কেন বিদেশিরা এই সুদকে নিরাপদ মনে করছে না। তাদের বড় ভয় হলো টাকার অব্যাহত মূল্য পতন। এই দেশে বিনিয়োগ করলে তো তারা টাকার সুদ পাবে। পরে ডলারে নিতে গেলে সেই সুদ আয় প্রকৃত অর্থে কত দাঁড়াবে?
বিদেশ থেকে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই টাকা-ডলার বিনিময় হারের At ability বা স্থিতিশীলতা দিতে হবে। কিন্তু সেটা কি বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব হবে? তাই বাংলাদেশ সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে আশু সংকট মোকাবিলা করার জন্য কথিত সভরিন বন্ড বা সরকারি গ্যারান্টিতে ডলার ডিনোমিনিটেড (Dollar denominated) বন্ড ছাড়তে চাচ্ছে। এই বন্ড যারা কিনে তারা সুদ-আসল ডলারে পাবে। পরিশোধের গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা যে প্রশ্ন তুলবে সেটা হলো বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের সুদ-আসলে ডলারে পে করতে পারবে তো? এখন বাংলাদেশের ডলার ক্রাইসিস হলে পাঁচ বছর পর যদি বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর হয়, তখন কিভাবে ডলারে পে করবে? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই বাংলাদেশকে দিতে হবে। এই অবস্থায় বিদেশি ক্রেতারা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি চাইবে। সেই গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্রের বা ইউরোপের কোনো বড় বিনিয়োগ ব্যাংক বা বীমা কম্পানিকে দিতে হবে। এর অর্থ হলো বাংলাদেশ সরকারকে বাড়তি অর্থ ব্যয় গুনতে হবে। সব মিলিয়ে এই বন্ড বাংলাদেশের জন্য অতি ব্যয়বহুল মনে হবে। একে তো বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশ থেকে সুদ দিতে হবে বেশি। দ্বিতীয়ত তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কমিশন দিতে হবে। এর পর আছে বিদেশি ইস্যু ম্যানেজারের এবং আন্ডারবাইটারসদের ফি যেগুলো বাংলাদেশের কাছে হাতির খোরাক মনে হবে। সেই জন্য বলছি সোভারেন বন্ড ইস্যু করতে গিয়ে বাংলাদেশ অতি ব্যয়ের ফাঁদে আটকা পড়ছে কি না সেটা ভালোভাবে ভেবে দেখা উচিত।
পাঁচ বছর পর সুদ-আসলে এই বোঝা বাংলাদেশ কিভাবে পরিশোধ করবে তাও দেখা উচিত। সোভারেন বন্ড ইস্যু করা যদি এত সহজ হতো তাহলে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশও এই বন্ড ইস্যু করে সংকট মোকাবিলা করত। সত্য হলো, গরিবের ঋণ কেউ কিনতে চাইবে না। চাইলেও সুদ দাবি করবে বেশি। কারণ ভয় হলো গরিব পরে তাদের অর্থকে ফেরত দিতে পারবে না। আর তাদের প্রেক্ষাপট থেকে এখানে জামানত কী? সেই জামানত সংগ্রহ করতে হবে সেই বিদেশ থেকে মূল্য দিয়েই। এসব চিন্তা করার পরও বাংলাদেশ কি ওই পথে হাটবে? তারপর প্রশ্ন হলো কত ডলারের বন্ড ইস্যু করা হবে? ৫০০ মিলিয়ন না এক বিলিয়ন ডলারের না আরো বেশি অঙ্কের? সোভারেন বন্ড ইস্যু করে অন্য দেশ সাধারণত বড় রকমের প্রকল্প অর্থায়ন করে যে প্রকল্প থেকে প্রাক্কলিত আয় আসতেই থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোন প্রকল্প অর্থায়নের জন্য সোভারেন বন্ড ইস্যু করার কথা চিন্তা করছে? শুধু কি বাজেটে ব্যয় করার জন্য এই ইস্যু? তাহলে বাংলাদেশ ভুল করছে। অর্থ পেলেই যে সব উৎস থেকে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কমিশন এজেন্ট এবং কনসালট্যান্টরা বন্ড ইস্যু করার জন্য অনেক উৎসাহ দেবে। কিন্তু সাবধান হতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে জনস্বার্থে। এটা ভুল হলে যে আপত সংকট উত্তরণের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া। কাজটা ভবিষ্যতের জন্যও করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশে কোনো স্বদেশি কম্পানি আজতক ট্রান্সফার প্রাইসিং (Transfer pricing) এর জন্য দণ্ডিত হয়েছে এমন জানা নেই। সত্য হলো এই আমাদের দেশে কোনো উপযুক্ত আইন নেই। অন্যদিকে রাজস্ব বোর্ডের নেই সেই ফাঁকি পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত লোকবল। তাই অনেকে বলেন, বাংলাদেশ হলো বিদেশি কম্পানিগুলোর জন্য বেআইনিভাবে আয়কে বিদেশে পাঠানোর জন্য স্বর্গরাজ্য।
বাংলাদেশ সরকার ফরেন এক্সচেঞ্জ ক্রাইসিসে পড়ে বা সম্ভাব্য ফরেন এক্সচেঞ্জ সংকট মোকাবিলা করার জন্য সোভারেন বন্ড তথা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এবং বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব গ্যারান্টিতে ডলারে বিদেশিদের ক্রয় করার জন্য বন্ড ইস্যু করার কথা ভাবছে। একটা কথা সামনে আসতে পারে। সেটা হলো বাংলাদেশে যখন সুদের হার এতই বেশি তাহলে বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের থেকে কেন ডলার এনে এই দেশের সুদের বাজারে বিনিয়োগ করছে না? এর উত্তর হলো বাংলাদেশ যত বেশি সুদই দেক না কেন বিদেশিরা এই সুদকে নিরাপদ মনে করছে না। তাদের বড় ভয় হলো টাকার অব্যাহত মূল্য পতন। এই দেশে বিনিয়োগ করলে তো তারা টাকার সুদ পাবে। পরে ডলারে নিতে গেলে সেই সুদ আয় প্রকৃত অর্থে কত দাঁড়াবে?
বিদেশ থেকে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই টাকা-ডলার বিনিময় হারের At ability বা স্থিতিশীলতা দিতে হবে। কিন্তু সেটা কি বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব হবে? তাই বাংলাদেশ সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে আশু সংকট মোকাবিলা করার জন্য কথিত সভরিন বন্ড বা সরকারি গ্যারান্টিতে ডলার ডিনোমিনিটেড (Dollar denominated) বন্ড ছাড়তে চাচ্ছে। এই বন্ড যারা কিনে তারা সুদ-আসল ডলারে পাবে। পরিশোধের গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা যে প্রশ্ন তুলবে সেটা হলো বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের সুদ-আসলে ডলারে পে করতে পারবে তো? এখন বাংলাদেশের ডলার ক্রাইসিস হলে পাঁচ বছর পর যদি বন্ডের মেয়াদ পাঁচ বছর হয়, তখন কিভাবে ডলারে পে করবে? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই বাংলাদেশকে দিতে হবে। এই অবস্থায় বিদেশি ক্রেতারা কোনো বিশ্বাসযোগ্য তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি চাইবে। সেই গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্রের বা ইউরোপের কোনো বড় বিনিয়োগ ব্যাংক বা বীমা কম্পানিকে দিতে হবে। এর অর্থ হলো বাংলাদেশ সরকারকে বাড়তি অর্থ ব্যয় গুনতে হবে। সব মিলিয়ে এই বন্ড বাংলাদেশের জন্য অতি ব্যয়বহুল মনে হবে। একে তো বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশ থেকে সুদ দিতে হবে বেশি। দ্বিতীয়ত তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কমিশন দিতে হবে। এর পর আছে বিদেশি ইস্যু ম্যানেজারের এবং আন্ডারবাইটারসদের ফি যেগুলো বাংলাদেশের কাছে হাতির খোরাক মনে হবে। সেই জন্য বলছি সোভারেন বন্ড ইস্যু করতে গিয়ে বাংলাদেশ অতি ব্যয়ের ফাঁদে আটকা পড়ছে কি না সেটা ভালোভাবে ভেবে দেখা উচিত।
পাঁচ বছর পর সুদ-আসলে এই বোঝা বাংলাদেশ কিভাবে পরিশোধ করবে তাও দেখা উচিত। সোভারেন বন্ড ইস্যু করা যদি এত সহজ হতো তাহলে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশও এই বন্ড ইস্যু করে সংকট মোকাবিলা করত। সত্য হলো, গরিবের ঋণ কেউ কিনতে চাইবে না। চাইলেও সুদ দাবি করবে বেশি। কারণ ভয় হলো গরিব পরে তাদের অর্থকে ফেরত দিতে পারবে না। আর তাদের প্রেক্ষাপট থেকে এখানে জামানত কী? সেই জামানত সংগ্রহ করতে হবে সেই বিদেশ থেকে মূল্য দিয়েই। এসব চিন্তা করার পরও বাংলাদেশ কি ওই পথে হাটবে? তারপর প্রশ্ন হলো কত ডলারের বন্ড ইস্যু করা হবে? ৫০০ মিলিয়ন না এক বিলিয়ন ডলারের না আরো বেশি অঙ্কের? সোভারেন বন্ড ইস্যু করে অন্য দেশ সাধারণত বড় রকমের প্রকল্প অর্থায়ন করে যে প্রকল্প থেকে প্রাক্কলিত আয় আসতেই থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোন প্রকল্প অর্থায়নের জন্য সোভারেন বন্ড ইস্যু করার কথা চিন্তা করছে? শুধু কি বাজেটে ব্যয় করার জন্য এই ইস্যু? তাহলে বাংলাদেশ ভুল করছে। অর্থ পেলেই যে সব উৎস থেকে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কমিশন এজেন্ট এবং কনসালট্যান্টরা বন্ড ইস্যু করার জন্য অনেক উৎসাহ দেবে। কিন্তু সাবধান হতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে জনস্বার্থে। এটা ভুল হলে যে আপত সংকট উত্তরণের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া। কাজটা ভবিষ্যতের জন্যও করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতিবিদ
No comments