চালচিত্র-বিকল্পের সন্ধান ও হরতালের সাতকাহন by শুভ রহমান
বিকল্প চাই। প্রায় সব কিছুরই একটা বিকল্প খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। জীর্ণ, পুরনো সমাজটার বিকল্প চাই। নেতিবাচক ও দেউলিয়া রাজনীতির বিকল্প চাই। মানুষ পচে গেছে, নষ্ট মানুষের বিকল্প চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের ওপর পাষণ্ড স্বামীর হিংস্র পশুর মতো নির্যাতন বলে দিচ্ছে, এ সমাজ বদলাতে হবে।
এর বিকল্প হয়ে পড়েছে অত্যন্ত জরুরি। শুধু রাজনীতি ঠিক করলেই হবে না, রাজনীতিবিদদের, তাঁদের ব্যবস্থার, তাঁদের দর্শন ও চাওয়া-পাওয়ার, সব কিছুরই বিকল্প খুবই জরুরি।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে গত শতকের প্রথম দিকে হরতাল, সত্যাগ্রহ, অনশন_এসব অহিংস পন্থায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর উদ্ভাবিত সে আন্দোলনের যৌক্তিকতা ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরও, পাকিস্তান আমলজুড়ে ইসলামাবাদের সামরিক স্বৈরশাসকদের শোষণ, নিপীড়ন-বঞ্চনা-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মোক্ষম ভাষা হিসেবে খুবই কার্যকর ছিল।
কিন্তু এ সবই ছিল সমাজের উপরিকাঠামো বদলানোর লড়াই। ভেতরটা সেই শত বছরের অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্মম সমাজেই রয়ে গেছে। শুধু একের পর এক ওপরের বিকল্প দিয়ে পচা-গলা সমাজের আসল বিকল্প বের করা যাচ্ছে না।
গান্ধীর পথ ধরেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এখানেও তুমুল অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। হরতালের তা ছিল একটি উচ্চপর্যায়। তারই সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ দেশে একাত্তরে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার শুরু করতে হলো কেঁচে গণ্ডূষ। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কায়দায় পুলিশি নির্যাতনও চলল। অবশ্য তৎকালীন পাকিস্তানের অপর অংশে তথা পশ্চিম পাকিস্তানেই তার মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি।
এখানে '৪৭-এর পর মহান ভাষাসংগ্রাম থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের সেনা-পুলিশের বর্বরতা-নির্যাতন ক্রমে রুখে দেওয়া গিয়েছিল। হরতালের চেয়ে অনেক উচ্চগ্রামে তখন সত্তরের নির্বাচনী রায় কার্যকর করতে বাঙালিকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের কারাগারে বন্দি থাকা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অস্ত্রই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। পৃথিবীতে এ ভূখণ্ডে উঠতি ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ বাঙালি ধনিক শ্রেণী যে কোনো দিন সশস্ত্র যুদ্ধ করতে পারবে এবং তার পেছনে দেশের শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণ গ্রানাইট পাথরের মতো দুর্ভেদ্য ঐক্য নিয়ে, একাট্টা শক্তি ও সাহস নিয়ে সত্যিকার হিউম্যান ওয়াল তথা মানব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে_এ ছিল বিশ্ববাসীর কাছে এক পরম বিস্ময়। সে যুদ্ধে বাঙালি প্রথমবারের মতো জয়ী হয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাঙালির স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করল।
হরতাল-অসহযোগের এই যৌক্তিক বিকল্প ও বিবর্তনের পর এ ভূখণ্ডে তো আর সেসবের কোনো আবশ্যকতাই থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা গেল, পাশের দেশ ভারতে স্বাধীনতা অর্জনের পরও যেমন হরতালের নব সংস্করণ বন্ধ্ টিকে রইল, এখানেও দুনিয়া-কাঁপানো সশস্ত্র যুদ্ধের পরও একদিকে যেমন কার্যত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কায়দারই শাসন-শোষণ টিকে রইল, তেমনি অন্যদিকে শত বছরের সব পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনকানুনও একশ্রেণীর শাসক-শোষক তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে প্রয়োজনমতো প্রয়োগ করতে থাকল। শ্রমিক-কৃষক নির্যাতন থেকে নারী-শিশু নির্যাতন পর্যন্ত সব রকম সামাজিক নিপীড়ন, বৈষম্য ঔপনিবেশিক আমলের মতোই বহাল রইল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের মতো শাসনকালটুকু বাদ দিলে কার্যত ব্রিটিশধারার শাসন পদ্ধতিই এখানে গত ৪০ বছরে অন্তত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অনুসৃত হতে থাকল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার পাঁচ বছরের শাসনামলে আর বর্তমানে তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আড়াই বছরের শাসনকাল_মোট এই সাড়ে সাত বছর ও বঙ্গবন্ধুর আমলের সাড়ে তিন বছর, মোটামুটি ১১ বছর এ দেশে আর হরতাল বা অসহযোগ ধরনের আন্দোলনের কালচার আঁকড়ে থাকার দরকার ছিল না। কিন্তু এই সময়কালে শাসকগোষ্ঠীর মনমানসিকতার ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনেই তাদের সময়কার কিছু চরমপন্থী বাদে বিরোধী রাজনীতির ধারকরা আগের মতোই হরতাল-অসহযোগের পথ আঁকড়ে থাকল। শাসকগোষ্ঠীর উদার গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা ও নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একশ্রেণীর পাকিস্তানি স্বৈরমানসিকতার অনুসারী রাজনীতিক ও ধর্মব্যবসায়ী এখনো বারংবার অযৌক্তিকভাবে এবং গায়ের জোরেই পুরনো পরিত্যক্ত হরতাল ও অসহযোগ ধরনের কার্যক্রম, যেমন সংসদ বর্জন ইত্যাদি কর্মসূচি দিয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ ও জনগণের অশেষ ক্ষতিসাধন করে চলেছে। আজকের হরতাল গান্ধীবাদী অহিংস হরতাল নয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কায়দায় গানপাউডার দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করে তাকে সহিংস হরতালে পরিণত করা হয়েছে। এ হরতাল জনবিচ্ছিন্নতার হরতাল, জনসম্পৃক্ততার নয়।
আজ জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার আলোকেই এমন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমরা চাইছি, যেখানে চিরতরে অযৌক্তিক হরতাল, অহেতুক ও ক্ষমতাদর্পী সংসদ বর্জন, গাড়ি পোড়ানো এবং দেশের সম্পদ ধ্বংসের দায়িত্বজ্ঞানহীন সব কার্যক্রমই চিরতরে বন্ধ হবে। যেখানে নিজেদেরই প্রত্যাখ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চরম সুবিধাবাদের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বহাল রাখার জন্য হরতালের পর হরতাল, লং মার্চ, রোড মার্চ ইত্যাকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল অবলম্বনের ঔদ্ধত্যকে গণপ্রতিরোধ দিয়ে চিরতরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নিছক ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার করে, টোটকা দাওয়াই দিয়ে, তাৎক্ষণিক কিছু দণ্ড দিয়ে হরতালকারীদের নিরস্ত করতে যাওয়ার মূঢ়তা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য।
আমাদের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন প্রিয়তম স্বাধীনতা ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কোনো রকম অযৌক্তিক মনোভাব দিয়ে, হরতালের ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে, একটানা সংসদ বর্জনের চরম নেতিবাচক রাজনীতি দিয়ে আবার একটি ১/১১-র পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র সচেতন দেশবাসী কিছুতেই সফল হতে দেবে না। সাধারণ মানুষের ঘোরতর সন্দেহ, তিনটি মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্যই_১. তারেক ও কোকোকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও তাঁদের সব অপরাধের দায় থেকে মুক্ত করা; ২. যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠান ব্যর্থ করে দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা এবং ৩. কার্যত দেশে আরেক সামরিকতন্ত্র তথা পরাধীন আমলের পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাষ্ট্র কায়েম করাই বর্তমান সব রকম অযৌক্তিক, অস্থিতিশীল ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যের বিরুদ্ধে সচেতন গণমানুষকে আজ সর্বাত্মক ঐক্যের দুর্ভেদ্য ও সুদৃঢ় প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। শুধু দেউলিয়া ও বন্ধ্যা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, দেশের চরম বিশৃঙ্খল ও শোষণ-নিপীড়নযুক্ত সমাজ ও অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে জিইয়ে রাখার গভীর ষড়যন্ত্র চিরতরে খতম করে এক নতুন ও গণমানুষের বিকল্প আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমই দেশবাসীর প্রকৃত মুক্তির পথ। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে আজ সে পথই গ্রহণ করতে হবে। নিছক ক্ষমতার হাতবদলের রাজনীতি আর নয়, শুরু হোক অত্যন্ত সচেতনভাবেই সমাজবদলের রাজনীতি।
১৪.৬.২০১১
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে গত শতকের প্রথম দিকে হরতাল, সত্যাগ্রহ, অনশন_এসব অহিংস পন্থায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর উদ্ভাবিত সে আন্দোলনের যৌক্তিকতা ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পরও, পাকিস্তান আমলজুড়ে ইসলামাবাদের সামরিক স্বৈরশাসকদের শোষণ, নিপীড়ন-বঞ্চনা-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মোক্ষম ভাষা হিসেবে খুবই কার্যকর ছিল।
কিন্তু এ সবই ছিল সমাজের উপরিকাঠামো বদলানোর লড়াই। ভেতরটা সেই শত বছরের অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্মম সমাজেই রয়ে গেছে। শুধু একের পর এক ওপরের বিকল্প দিয়ে পচা-গলা সমাজের আসল বিকল্প বের করা যাচ্ছে না।
গান্ধীর পথ ধরেই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এখানেও তুমুল অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। হরতালের তা ছিল একটি উচ্চপর্যায়। তারই সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ দেশে একাত্তরে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার শুরু করতে হলো কেঁচে গণ্ডূষ। সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কায়দায় পুলিশি নির্যাতনও চলল। অবশ্য তৎকালীন পাকিস্তানের অপর অংশে তথা পশ্চিম পাকিস্তানেই তার মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি।
এখানে '৪৭-এর পর মহান ভাষাসংগ্রাম থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের সেনা-পুলিশের বর্বরতা-নির্যাতন ক্রমে রুখে দেওয়া গিয়েছিল। হরতালের চেয়ে অনেক উচ্চগ্রামে তখন সত্তরের নির্বাচনী রায় কার্যকর করতে বাঙালিকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের কারাগারে বন্দি থাকা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অস্ত্রই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। পৃথিবীতে এ ভূখণ্ডে উঠতি ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ বাঙালি ধনিক শ্রেণী যে কোনো দিন সশস্ত্র যুদ্ধ করতে পারবে এবং তার পেছনে দেশের শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত তথা আপামর জনসাধারণ গ্রানাইট পাথরের মতো দুর্ভেদ্য ঐক্য নিয়ে, একাট্টা শক্তি ও সাহস নিয়ে সত্যিকার হিউম্যান ওয়াল তথা মানব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে_এ ছিল বিশ্ববাসীর কাছে এক পরম বিস্ময়। সে যুদ্ধে বাঙালি প্রথমবারের মতো জয়ী হয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম বাঙালির স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করল।
হরতাল-অসহযোগের এই যৌক্তিক বিকল্প ও বিবর্তনের পর এ ভূখণ্ডে তো আর সেসবের কোনো আবশ্যকতাই থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা গেল, পাশের দেশ ভারতে স্বাধীনতা অর্জনের পরও যেমন হরতালের নব সংস্করণ বন্ধ্ টিকে রইল, এখানেও দুনিয়া-কাঁপানো সশস্ত্র যুদ্ধের পরও একদিকে যেমন কার্যত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কায়দারই শাসন-শোষণ টিকে রইল, তেমনি অন্যদিকে শত বছরের সব পুরনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনকানুনও একশ্রেণীর শাসক-শোষক তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে প্রয়োজনমতো প্রয়োগ করতে থাকল। শ্রমিক-কৃষক নির্যাতন থেকে নারী-শিশু নির্যাতন পর্যন্ত সব রকম সামাজিক নিপীড়ন, বৈষম্য ঔপনিবেশিক আমলের মতোই বহাল রইল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের মতো শাসনকালটুকু বাদ দিলে কার্যত ব্রিটিশধারার শাসন পদ্ধতিই এখানে গত ৪০ বছরে অন্তত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অনুসৃত হতে থাকল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার পাঁচ বছরের শাসনামলে আর বর্তমানে তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আড়াই বছরের শাসনকাল_মোট এই সাড়ে সাত বছর ও বঙ্গবন্ধুর আমলের সাড়ে তিন বছর, মোটামুটি ১১ বছর এ দেশে আর হরতাল বা অসহযোগ ধরনের আন্দোলনের কালচার আঁকড়ে থাকার দরকার ছিল না। কিন্তু এই সময়কালে শাসকগোষ্ঠীর মনমানসিকতার ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনেই তাদের সময়কার কিছু চরমপন্থী বাদে বিরোধী রাজনীতির ধারকরা আগের মতোই হরতাল-অসহযোগের পথ আঁকড়ে থাকল। শাসকগোষ্ঠীর উদার গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা ও নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একশ্রেণীর পাকিস্তানি স্বৈরমানসিকতার অনুসারী রাজনীতিক ও ধর্মব্যবসায়ী এখনো বারংবার অযৌক্তিকভাবে এবং গায়ের জোরেই পুরনো পরিত্যক্ত হরতাল ও অসহযোগ ধরনের কার্যক্রম, যেমন সংসদ বর্জন ইত্যাদি কর্মসূচি দিয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ ও জনগণের অশেষ ক্ষতিসাধন করে চলেছে। আজকের হরতাল গান্ধীবাদী অহিংস হরতাল নয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কায়দায় গানপাউডার দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করে তাকে সহিংস হরতালে পরিণত করা হয়েছে। এ হরতাল জনবিচ্ছিন্নতার হরতাল, জনসম্পৃক্ততার নয়।
আজ জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার আলোকেই এমন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমরা চাইছি, যেখানে চিরতরে অযৌক্তিক হরতাল, অহেতুক ও ক্ষমতাদর্পী সংসদ বর্জন, গাড়ি পোড়ানো এবং দেশের সম্পদ ধ্বংসের দায়িত্বজ্ঞানহীন সব কার্যক্রমই চিরতরে বন্ধ হবে। যেখানে নিজেদেরই প্রত্যাখ্যাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চরম সুবিধাবাদের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বহাল রাখার জন্য হরতালের পর হরতাল, লং মার্চ, রোড মার্চ ইত্যাকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল অবলম্বনের ঔদ্ধত্যকে গণপ্রতিরোধ দিয়ে চিরতরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নিছক ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার করে, টোটকা দাওয়াই দিয়ে, তাৎক্ষণিক কিছু দণ্ড দিয়ে হরতালকারীদের নিরস্ত করতে যাওয়ার মূঢ়তা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য।
আমাদের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন প্রিয়তম স্বাধীনতা ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কোনো রকম অযৌক্তিক মনোভাব দিয়ে, হরতালের ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে, একটানা সংসদ বর্জনের চরম নেতিবাচক রাজনীতি দিয়ে আবার একটি ১/১১-র পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র সচেতন দেশবাসী কিছুতেই সফল হতে দেবে না। সাধারণ মানুষের ঘোরতর সন্দেহ, তিনটি মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্যই_১. তারেক ও কোকোকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও তাঁদের সব অপরাধের দায় থেকে মুক্ত করা; ২. যুদ্ধাপরাধের বিচার অনুষ্ঠান ব্যর্থ করে দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা এবং ৩. কার্যত দেশে আরেক সামরিকতন্ত্র তথা পরাধীন আমলের পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাষ্ট্র কায়েম করাই বর্তমান সব রকম অযৌক্তিক, অস্থিতিশীল ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যের বিরুদ্ধে সচেতন গণমানুষকে আজ সর্বাত্মক ঐক্যের দুর্ভেদ্য ও সুদৃঢ় প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। শুধু দেউলিয়া ও বন্ধ্যা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, দেশের চরম বিশৃঙ্খল ও শোষণ-নিপীড়নযুক্ত সমাজ ও অবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে জিইয়ে রাখার গভীর ষড়যন্ত্র চিরতরে খতম করে এক নতুন ও গণমানুষের বিকল্প আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমই দেশবাসীর প্রকৃত মুক্তির পথ। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে আজ সে পথই গ্রহণ করতে হবে। নিছক ক্ষমতার হাতবদলের রাজনীতি আর নয়, শুরু হোক অত্যন্ত সচেতনভাবেই সমাজবদলের রাজনীতি।
১৪.৬.২০১১
No comments