সুশাসন-মূল জায়গায় হাত দিতে হবে by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের অচলাবস্থাকে কেন্দ্র করে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। অদক্ষ শ্রমিকদের কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়া ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করা ও আবোলতাবোল কথা বলার জন্য নৌপরিবহনমন্ত্রীরও পদত্যাগের জোরালো দাবি উঠেছে। শেষ পর্যন্ত এই দুই মন্ত্রী কী করবেন জানি না।
অনেকের ধারণা, পদ্মা সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগমন্ত্রীকে হাতছাড়া করবেন না। যোগাযোগমন্ত্রী যে সেতু-বিশেষজ্ঞ, তা নয়। এর কারণ নাকি ভিন্ন।
একটা ফুটবল বা ক্রিকেট দলে কেউ ভালো না খেললে তার বদলে অন্য খেলোয়াড় নামায়। খেলা চলাকালীনও কোনো কোনো খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয়। কোনো টিম বারবার হারলে শুধু খেলোয়াড় বদল করলে হয় না। তখন ক্যাপ্টেন ও কোচ বদলাতে হয়। আমরা শুধু খেলোয়াড় বদলানোর দাবি করছি কেন? দু-একটা খেলোয়াড় বদলালে কি ম্যাচ জেতা যায়? যায় না। ক্যাপ্টেন বদলাতে হয়। কোচ বদলাতে হয়। ক্যাপ্টেন বা কোচ কার ছেলে বা কার জামাই, তা দেখলে খেলায় জেতা যায় না।
রাজনীতি বা সরকার পরিচালনাও কিন্তু একটা খেলার মতো। অনেক উঁচুমাপের খেলা, সন্দেহ নেই।
দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি বেশ জোরেশোরে উঠেছে। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা, সাংসদ বা আওয়ামী লীগ-সমর্থক কলামিস্টরাও এই দাবি তুলেছেন। এতে বোঝা যায়, এই দাবি খুবই ন্যায়সংগত। ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রী জনদাবির কাছে নতি স্বীকার করে দুজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন। তাতে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে কি? কিছু ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। নতুন নৌপরিবহনমন্ত্রী হয়তো পরিবহন শ্রমিকনেতা হবেন না। তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করবেন না। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী হয়তো অনেক উদ্যোগী হবেন। বড় বড় ব্রিজ বা ফ্লাইওভারের পাশাপাশি আন্তজেলা বা রাজধানীর রাস্তাগুলোর দিকেও দৃষ্টি দেবেন। এটুকু পার্থক্য হতেই পারে। নতুন দুই মন্ত্রী যে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা খুব বেশি নেই।
ঈদের আগে সড়ক মেরামত ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর মধ্যে যে বাহাস হয়ে গেল, তার পেছনের কারণ কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থা। প্রয়োজনের সময় টাকা চেয়ে পাওয়া যায়নি বা প্রয়োজনের সময় আদৌ টাকা চাওয়া হয়নি। বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা বারবার চাইতে হবে কেন? একসঙ্গে সব টাকা পেলে মন্ত্রণালয় অপচয় করতে পারে বা লুটপাটও করতে পারে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আর্থিক দিকটা কীভাবে স্বচ্ছ ও সাবলীল করা যায়, তার পদ্ধতিটা ঠিক করা না হলে একই সমস্যা থেকে যাবে। নতুন মন্ত্রী এলেও যথাসময়ে টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। টাকা ছাড় করা প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা পরীক্ষা। এসব কাজে কোথাও আইনের বা বিধির জটিলতা থাকলে, তা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগী হতে হবে।
গত কয়েক মাসে সরকারের নানা কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মন্ত্রণালয়ের বড় বড় সিদ্ধান্ত কে নেয়। বেশির ভাগ বড় সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে হয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হয়। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অবশ্যই মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্থির হতে হবে। কিন্তু যা মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে বসেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা-ও মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়। আর কত সিদ্ধান্ত যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। গত এক বছরের দৈনিক পত্রিকা স্ক্যান করলে দেখা যাবে কতবার মন্ত্রীরা বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এই প্রকল্প গ্রহণ করেছি।’
এ রকম একটা উক্তি করার সময় মন্ত্রী বুঝতে পারেন না এই উক্তির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অযোগ্যতা-অদক্ষতা স্বীকার করছেন। অবশ্য এমনও হতে পারে, মন্ত্রী নিজেই এই প্রকল্পের সব কাজ করেছেন। তবু প্রধানমন্ত্রীর সুনজর পাওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এর ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করাও মন্ত্রীর একটি কাজ।
মন্ত্রণালয়ের কাজ মন্ত্রী কতটা স্বাধীনভাবে করতে পারবেন, তার একটা আইনি প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতি চালু করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী সব সময় মন্ত্রণালয়ের কাজের নির্দেশনা দিলে ওই মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী নীতিগত দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। কাজের মনিটরিংও করতে পারেন। তাই বলে রাস্তা মেরামতের জন্যও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে ও থোক বরাদ্দ দিলে মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করা মুশকিল। যোগাযোগমন্ত্রী চাইলে কি ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের জরুরি মেরামতকাজের জন্য থোক বরাদ্দ পেতেন? থোক বরাদ্দ দূরে থাক, বাজেটে অনুমোদিত মন্ত্রণালয়ের সেই অর্থও বারবার তাগাদা দিয়ে ছাড় করাতে পারেননি মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীই যদি সব সমস্যার সমাধান করে দেন, তাহলে মন্ত্রী বা সচিবেরা কী করবেন? আর যে মন্ত্রী সমস্যার সমাধান করতে পারেন না, ওই মন্ত্রী রেখে লাভ কী?
সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অনেকটা রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির দৃষ্টিতে দেখা হয়। দু-তিনটা বিষয় বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আসলে রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির রাষ্ট্রপতির মতোই আচরণ করেন। তিনিই সব, পুরো মন্ত্রিসভা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি পতাকাও আছে, যা বিশ্বের কোনো সংসদীয় পদ্ধতির প্রধানমন্ত্রীর নেই। এসব কথা সাধারণত কেউ আলোচনা করেন না। সবাই এই গোঁজামিলের সংসদীয় পদ্ধতি মেনে নিয়েছেন।
একটা রব উঠেছে, সুশাসনের জন্য মন্ত্রিসভার পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু নতুন কারা মন্ত্রী হবেন? যাঁদের বাদ দেওয়া হবে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে হয়তো সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু কে মূল্যায়ন করছে? বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিচ্ছে। এই রিপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব কি তাদের? বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই মূল্যায়ন করেছেন। কাজেই মন্ত্রিসভার রদবদল বা কারা নতুন মন্ত্রী হবেন, সবই শুধু একজন জানেন। হয়তো তাঁর কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্যরা জানতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো একটা বিরাট রাজনৈতিক দল। এর লাখ লাখ কর্মী, হাজার হাজার নেতার শ্রমে দলটি নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছে। মন্ত্রিসভা গঠনে তাঁদের কোনো মতামত থাকবে না?
সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে মন্ত্রিসভা গঠনের এই একক ক্ষমতা প্রদানকে আমি সঠিক মনে করি না। প্রধানমন্ত্রী তো কোনো ব্যক্তি নন। তিনি দলের প্রতিনিধি। দল তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। দল কালকে প্রধানমন্ত্রী পাল্টেও দিতে পারে। আমি মনে করি, দলের গঠনতন্ত্রে এমন বিধান যুক্ত করা উচিত, প্রধানমন্ত্রী দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন বা রদবদল করবেন।
সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, দলের আনুষ্ঠানিক মতামত নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা গঠন করা উচিত। মন্ত্রিসভার ব্যর্থতার কারণে সরকারের যদি পতন হয়, তার দায় দলকেও নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীই বা মন্ত্রিসভা গঠন বা রদবদলের মতো বড় কাজ একা করার ঝুঁকি নেবেন কেন? তাঁর নিজের স্বার্থেই তো তিনি দলের হাইকমান্ডকে এই সিদ্ধান্তের অংশীদার করবেন; যাতে মন্ত্রিসভার বা মন্ত্রী-বিশেষের ব্যর্থতার দায়ভার তাঁকে একা নিতে না হয়।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী না হলে বড় কাজ করা সম্ভব হয় না। এখানেও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হবে। সড়ক বিভাগের দুর্নীতি বন্ধে তাঁকে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁর মন্ত্রী বা সচিব উদ্যোগী না হলেও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকে বলতে পারেন, দুর্নীতি বন্ধের সব কাজ প্রধানমন্ত্রীকে করতে হবে কেন? করতে না হলেই ভালো হতো। কিন্তু তিনি নিজেই তো সব কাজ নিজের হাতে পরোক্ষভাবে রেখে দিয়েছেন। যেসব মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে মেগা সাইজে দুর্নীতি হয় (টিআইবির গবেষণা দ্রষ্টব্য), সেগুলো বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সেগুলো সংখ্যায় বেশি নয়। প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেই দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে, তা আমি মনে করি না। তবে তা বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীই পারেন বিভিন্ন সরকারি অফিসের দুর্নীতির কিছু রাঘববোয়ালকে শাস্তির মুখোমুখি করতে। বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। তবে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী জিহাদের ভঙ্গিতে দুর্নীতি বন্ধ করার ব্রত নিয়ে মাঠে নামলে মেগা সাইজের দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস করতে পারবেন। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন ও আদালতকে এ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
অনেকে ভাবতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে এই লেখা লিখছি, তা ঠিক নয়। আমি ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদকে সামনে রেখে এই লেখা লিখছি। আজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও এই লেখার প্রতিটি কথা প্রযোজ্য হতো। বিএনপির আমলেও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘রাষ্ট্রপতির’ মতো একক কর্তৃত্ব নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। কাজেই যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন।
আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। কসমেটিক পরিবর্তনে কিছুটা লাভ হয়তো হতে পারে কিন্তু বড় কোনো উপকার আশা করা উচিত হবে না। মন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা বরখাস্ত হলে মানুষের ক্ষোভ কিছুটা কমে। সরকারও কিছুটা মাইলেজ পায়। ব্যস, এই পর্যন্তই। তার বেশি নয়। আমি মন্ত্রীর পদত্যাগের বিরোধিতা করছি না। অযোগ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ বা বরখাস্ত অবশ্যই চাই। কিন্তু শুধু মন্ত্রী যোগ্য হলেই হবে না, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। কেবল তাহলেই যোগ্য, স ৎ ও দক্ষ মন্ত্রী তাঁর কর্মক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
একটা ফুটবল বা ক্রিকেট দলে কেউ ভালো না খেললে তার বদলে অন্য খেলোয়াড় নামায়। খেলা চলাকালীনও কোনো কোনো খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয়। কোনো টিম বারবার হারলে শুধু খেলোয়াড় বদল করলে হয় না। তখন ক্যাপ্টেন ও কোচ বদলাতে হয়। আমরা শুধু খেলোয়াড় বদলানোর দাবি করছি কেন? দু-একটা খেলোয়াড় বদলালে কি ম্যাচ জেতা যায়? যায় না। ক্যাপ্টেন বদলাতে হয়। কোচ বদলাতে হয়। ক্যাপ্টেন বা কোচ কার ছেলে বা কার জামাই, তা দেখলে খেলায় জেতা যায় না।
রাজনীতি বা সরকার পরিচালনাও কিন্তু একটা খেলার মতো। অনেক উঁচুমাপের খেলা, সন্দেহ নেই।
দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি বেশ জোরেশোরে উঠেছে। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা, সাংসদ বা আওয়ামী লীগ-সমর্থক কলামিস্টরাও এই দাবি তুলেছেন। এতে বোঝা যায়, এই দাবি খুবই ন্যায়সংগত। ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রী জনদাবির কাছে নতি স্বীকার করে দুজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলেন। তাতে খুব বেশি ফল পাওয়া যাবে কি? কিছু ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। নতুন নৌপরিবহনমন্ত্রী হয়তো পরিবহন শ্রমিকনেতা হবেন না। তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করবেন না। নতুন যোগাযোগমন্ত্রী হয়তো অনেক উদ্যোগী হবেন। বড় বড় ব্রিজ বা ফ্লাইওভারের পাশাপাশি আন্তজেলা বা রাজধানীর রাস্তাগুলোর দিকেও দৃষ্টি দেবেন। এটুকু পার্থক্য হতেই পারে। নতুন দুই মন্ত্রী যে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা খুব বেশি নেই।
ঈদের আগে সড়ক মেরামত ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর মধ্যে যে বাহাস হয়ে গেল, তার পেছনের কারণ কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থা। প্রয়োজনের সময় টাকা চেয়ে পাওয়া যায়নি বা প্রয়োজনের সময় আদৌ টাকা চাওয়া হয়নি। বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা বারবার চাইতে হবে কেন? একসঙ্গে সব টাকা পেলে মন্ত্রণালয় অপচয় করতে পারে বা লুটপাটও করতে পারে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আর্থিক দিকটা কীভাবে স্বচ্ছ ও সাবলীল করা যায়, তার পদ্ধতিটা ঠিক করা না হলে একই সমস্যা থেকে যাবে। নতুন মন্ত্রী এলেও যথাসময়ে টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। টাকা ছাড় করা প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা পরীক্ষা। এসব কাজে কোথাও আইনের বা বিধির জটিলতা থাকলে, তা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগী হতে হবে।
গত কয়েক মাসে সরকারের নানা কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মন্ত্রণালয়ের বড় বড় সিদ্ধান্ত কে নেয়। বেশির ভাগ বড় সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে হয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে হয়। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অবশ্যই মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্থির হতে হবে। কিন্তু যা মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে বসেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা-ও মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়। আর কত সিদ্ধান্ত যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। গত এক বছরের দৈনিক পত্রিকা স্ক্যান করলে দেখা যাবে কতবার মন্ত্রীরা বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এই প্রকল্প গ্রহণ করেছি।’
এ রকম একটা উক্তি করার সময় মন্ত্রী বুঝতে পারেন না এই উক্তির মধ্য দিয়ে তিনি নিজের অযোগ্যতা-অদক্ষতা স্বীকার করছেন। অবশ্য এমনও হতে পারে, মন্ত্রী নিজেই এই প্রকল্পের সব কাজ করেছেন। তবু প্রধানমন্ত্রীর সুনজর পাওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এর ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করাও মন্ত্রীর একটি কাজ।
মন্ত্রণালয়ের কাজ মন্ত্রী কতটা স্বাধীনভাবে করতে পারবেন, তার একটা আইনি প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতি চালু করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী সব সময় মন্ত্রণালয়ের কাজের নির্দেশনা দিলে ওই মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী নীতিগত দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। কাজের মনিটরিংও করতে পারেন। তাই বলে রাস্তা মেরামতের জন্যও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে ও থোক বরাদ্দ দিলে মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করা মুশকিল। যোগাযোগমন্ত্রী চাইলে কি ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের জরুরি মেরামতকাজের জন্য থোক বরাদ্দ পেতেন? থোক বরাদ্দ দূরে থাক, বাজেটে অনুমোদিত মন্ত্রণালয়ের সেই অর্থও বারবার তাগাদা দিয়ে ছাড় করাতে পারেননি মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীই যদি সব সমস্যার সমাধান করে দেন, তাহলে মন্ত্রী বা সচিবেরা কী করবেন? আর যে মন্ত্রী সমস্যার সমাধান করতে পারেন না, ওই মন্ত্রী রেখে লাভ কী?
সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অনেকটা রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির দৃষ্টিতে দেখা হয়। দু-তিনটা বিষয় বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আসলে রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির রাষ্ট্রপতির মতোই আচরণ করেন। তিনিই সব, পুরো মন্ত্রিসভা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি পতাকাও আছে, যা বিশ্বের কোনো সংসদীয় পদ্ধতির প্রধানমন্ত্রীর নেই। এসব কথা সাধারণত কেউ আলোচনা করেন না। সবাই এই গোঁজামিলের সংসদীয় পদ্ধতি মেনে নিয়েছেন।
একটা রব উঠেছে, সুশাসনের জন্য মন্ত্রিসভার পরিবর্তন করা দরকার। কিন্তু নতুন কারা মন্ত্রী হবেন? যাঁদের বাদ দেওয়া হবে তাঁদের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে হয়তো সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু কে মূল্যায়ন করছে? বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থা রিপোর্ট দিচ্ছে। এই রিপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব কি তাদের? বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই মূল্যায়ন করেছেন। কাজেই মন্ত্রিসভার রদবদল বা কারা নতুন মন্ত্রী হবেন, সবই শুধু একজন জানেন। হয়তো তাঁর কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্যরা জানতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো একটা বিরাট রাজনৈতিক দল। এর লাখ লাখ কর্মী, হাজার হাজার নেতার শ্রমে দলটি নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করেছে। মন্ত্রিসভা গঠনে তাঁদের কোনো মতামত থাকবে না?
সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে মন্ত্রিসভা গঠনের এই একক ক্ষমতা প্রদানকে আমি সঠিক মনে করি না। প্রধানমন্ত্রী তো কোনো ব্যক্তি নন। তিনি দলের প্রতিনিধি। দল তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। দল কালকে প্রধানমন্ত্রী পাল্টেও দিতে পারে। আমি মনে করি, দলের গঠনতন্ত্রে এমন বিধান যুক্ত করা উচিত, প্রধানমন্ত্রী দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন বা রদবদল করবেন।
সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, দলের আনুষ্ঠানিক মতামত নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা গঠন করা উচিত। মন্ত্রিসভার ব্যর্থতার কারণে সরকারের যদি পতন হয়, তার দায় দলকেও নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীই বা মন্ত্রিসভা গঠন বা রদবদলের মতো বড় কাজ একা করার ঝুঁকি নেবেন কেন? তাঁর নিজের স্বার্থেই তো তিনি দলের হাইকমান্ডকে এই সিদ্ধান্তের অংশীদার করবেন; যাতে মন্ত্রিসভার বা মন্ত্রী-বিশেষের ব্যর্থতার দায়ভার তাঁকে একা নিতে না হয়।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী না হলে বড় কাজ করা সম্ভব হয় না। এখানেও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হবে। সড়ক বিভাগের দুর্নীতি বন্ধে তাঁকে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁর মন্ত্রী বা সচিব উদ্যোগী না হলেও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকে বলতে পারেন, দুর্নীতি বন্ধের সব কাজ প্রধানমন্ত্রীকে করতে হবে কেন? করতে না হলেই ভালো হতো। কিন্তু তিনি নিজেই তো সব কাজ নিজের হাতে পরোক্ষভাবে রেখে দিয়েছেন। যেসব মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে মেগা সাইজে দুর্নীতি হয় (টিআইবির গবেষণা দ্রষ্টব্য), সেগুলো বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সেগুলো সংখ্যায় বেশি নয়। প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেই দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে, তা আমি মনে করি না। তবে তা বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীই পারেন বিভিন্ন সরকারি অফিসের দুর্নীতির কিছু রাঘববোয়ালকে শাস্তির মুখোমুখি করতে। বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। তবে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী জিহাদের ভঙ্গিতে দুর্নীতি বন্ধ করার ব্রত নিয়ে মাঠে নামলে মেগা সাইজের দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস করতে পারবেন। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন ও আদালতকে এ ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।
অনেকে ভাবতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে এই লেখা লিখছি, তা ঠিক নয়। আমি ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদকে সামনে রেখে এই লেখা লিখছি। আজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও এই লেখার প্রতিটি কথা প্রযোজ্য হতো। বিএনপির আমলেও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘রাষ্ট্রপতির’ মতো একক কর্তৃত্ব নিয়ে দেশ শাসন করেছেন। কাজেই যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন।
আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। কসমেটিক পরিবর্তনে কিছুটা লাভ হয়তো হতে পারে কিন্তু বড় কোনো উপকার আশা করা উচিত হবে না। মন্ত্রী পদত্যাগ করলে বা বরখাস্ত হলে মানুষের ক্ষোভ কিছুটা কমে। সরকারও কিছুটা মাইলেজ পায়। ব্যস, এই পর্যন্তই। তার বেশি নয়। আমি মন্ত্রীর পদত্যাগের বিরোধিতা করছি না। অযোগ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ বা বরখাস্ত অবশ্যই চাই। কিন্তু শুধু মন্ত্রী যোগ্য হলেই হবে না, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। কেবল তাহলেই যোগ্য, স ৎ ও দক্ষ মন্ত্রী তাঁর কর্মক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
No comments