স্মরণ-গাজীউল হক by কাইউম পারভেজ

১৯৬৪ সালে আমি যশোর জিলা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের সাহিত্য প্রতিযোগিতায় কী একটা বিষয়ে যেন পুরস্কার পেয়েছিলাম একটি বই। নাম 'জেলের কবিতা'। বাড়িতে এসে যখন পুরস্কার পাওয়া বইগুলো তুলে দিলাম আম্মার হাতে, আম্মা লেখকের নাম দেখে ওই বইটি ছোঁ মেরে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।


একটু পর আনন্দে আটখানা হয়ে বললেন, 'জানিস, এটা গাজী ভাইয়ের লেখা কবিতার বই। গাজীউল হক। আমার মামাতো ভাই। জেলে বসে এ কবিতাগুলো লিখেছেন।' আম্মা বললেন ভাষা আন্দোলনের কথা, তাঁর গাজী ভাইয়ের বীরোচিত ভূমিকার কথা। পাশাপাশি এটাও বললেন, তাঁর গাজী ভাই হাসি-আনন্দে, নাচে-গানে ভরপুর এক মানুষ। ওদিকে ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাঁর স্বভাব।
সেদিনই প্ল্যান, সবাই বগুড়ায় যাবে। সে মোতাবেক আমরা চললাম বগুড়ায়। ট্রেনের ঝুকুরঝুকুর শব্দের সঙ্গে ছড়া মিলাচ্ছি_'তাই তাই তাই, মামা বাড়ি যাই'। কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করছি মামা-মামির মুখ। কেমন হবে গাজী মামার মুখ? খুব কি গুরুগম্ভীর? আম্মা বলেছেন, গাজী মামা নাকি ব্যায়াম করেন নিয়মিত। কিন্তু আবার তো বলেছেন, মামা গানও করেন। খুব আমুদে লোক। যা-ই হোক, দুরুদুরু বুকে যখন মামার বাড়িতে পেঁৗছলাম, দেখি, চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছেন গাজী মামা_'কই, আমার মামু কই।' দৌড়ে আমায় বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। কয়েকদিনেই মনে হলো, আমার খেলার সঙ্গী পেয়ে গেলাম। কখনো তাঁর বাগান দেখাচ্ছেন, কখনো আবৃত্তি করছেন, কখনো গান গাইছেন। সময় গড়িয়ে গেছে। গাজী মামার সঙ্গে পরে আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। সময় গড়াতে গড়াতে তখন ১৯৮২ সালে এসে ঠেকেছে। সেই বছরই বিয়ে করলাম, এম আর আখতার মুকুলের বড় মেয়ে কবিতাকে। দেখি, আমার শ্বশুর আর গাজী মামা হরিহর আত্মার দুই বন্ধু।
গাজীউল হক ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, 'বায়ান্ন সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেটা আমাদের কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। এ রকম একটা বিপদ সংকেতের মতো শোনানোর জন্য সরকারি গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির বার্তা সর্বত্র জানান দেয়া হচ্ছিল। যখন শুনলাম, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। মনে হচ্ছিল, আমাদের আন্দোলন কারা যেন বানচাল করে দেয়ার চেষ্টা করছে। রাত ৯টা-১০টার সময় আমরা ৭-৮ জন বন্ধু মিলিত হই ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে। যত দূর মনে পড়ে, সেখানে মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মোমেন, জিল্লুর রহমান, কমরুদ্দীন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান, এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। আমি নিজেও ছিলাম।' (গাজীউল হক আমার সমসাময়িক, আমাদের গাজীউল হক, পৃষ্ঠা_১৭)। সেদিনের সেই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হলো। এম আর আখতার মুকুলের প্রস্তাবে এবং কমরুদ্দীন শহুদের সমর্থনে গাজীউল হক সভায় সভাপতিত্ব করলেন। ঘোষণা দিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হলো। তার পরই টিয়ারগ্যাস, গুলি। শহীদ হলেন সালাম, বরকত, রফিকউদ্দীন, জব্বার।
সিডনি চলে এসেছি ১৯৯২ সালে। গাজীউল হক এসেছিলেন দুইবার। প্রথমবার ১৯৯৭ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০২ সালে। এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের অতিথি হয়ে। প্রথমবার যখন গাজীউল হক এসেছিলেন, সেবার বিজয় দিবস উপলক্ষে আমরা আয়োজন করেছিলাম কবিতার আসরের। অনুষ্ঠানে তিনি আবৃত্তি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়বার গাজীউল হক যখন সস্ত্রীক সিডনি এলেন, তখন তাঁর দুই মেয়ে নতুনা আর সুমনিকা সিডনিতে এসে গেছে। ওদের নিয়ে সে যে কী হৈ-হুল্লোড়! মনে হচ্ছিল, ২০০২ সালে আমি ১৯৬৪ সালের গাজী মামাকে খুঁজে পেয়েছি। সেই মামাটা শেষের দিকে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। স্মৃতিও লোপ পেতে থাকল। জীবনের শেষ দিনগুলো খুব কষ্টে পার করে দিলেন। অথচ সারা জীবন দেশের কষ্ট, দেশের মানুষের কষ্টের কথাই ভেবে গেছেন। দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। গাজীউল হক ২০০৯ সালের ১৭ জুন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চলে গেলেন নতুন কোনো এক অজানা লড়াইয়ে। করুণাময় তাঁর আত্মার শান্তি দিন। তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।
কাইউম পারভেজ, সিডনি থেকে

No comments

Powered by Blogger.