বিশেষ সাক্ষাৎকার : মো. শাকিল রিজভী-শেয়ারবাজার আপন শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়াবে
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যাপকভাবে আলোচিত শেয়ারবাজার। ২০১০ সালের শেষার্ধ থেকে পতনের যে ধারা সেটা আর রোধ করা যায়নি। প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েও শেয়ারবাজারকে সঠিক ধারায় ফেরানো যায়নি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী অনেকেরই পথে বসার জোগাড় হয়েছে। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রেসিডেন্ট মো. শাকিল রিজভী।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। বাজারের আজকের এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করবেন।
মো. শাকিল রিজভী : বাজারে যে দরপতনের ধারা, এটা শুরু হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে। এর আগে তিন বছর ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ পর্যন্ত বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সূচক ছিল ৫৩০০। যেটা ওই বছরই শেষের দিকে গিয়ে ৮৯০০ হয়। এই যে উত্থান, এটাই হলো পতনের প্রধান কারণ। অস্বাভাবিক উপরে উঠে গেলে বাজার পড়বেই। এটাই বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। সেই পতনটা কত সহনীয়ভাবে হতে পারে, সেটাই হচ্ছে বিবেচনার বিষয়। তার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাটা ছিল বাজার অস্বাভাবিকভাবে উপরে উঠে যাওয়াটা। এর পেছনে অনেক ছোটখাটো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মৌলিক কারণ ছিল সুদের হার। ২০০৯ সালে এটাকে সিঙ্গেল ডিজিটে আনা হলো। সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানো হলো। সুদের ওপর কর ধার্য করা হলো। এফডিআর ইন্টারেস্ট রেটকে সিঙ্গেল ডিজিট করা হলো। যখন এভাবে অর্থাৎ কম সুদের কারণে সঞ্চয়ের ওপর একটা চাপ এলো, তখন কিছু ফান্ড এদিকে এসেছে। শেয়ারবাজারে টাকা ঢুকলে শেয়ারের দাম বাড়ে। এটাই স্বাভাবিক। এটা হচ্ছে একটা কারণ। এবার আরেকটা কারণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। মার্চেন্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প ব্যবসার কোনো সুযোগ না পেয়ে এখানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করল। অনেক ক্ষেত্রে সেটা নিয়মের বাইরে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুই জায়গা থেকে টাকা এসেছে বাজারে। একদিকে ব্যক্তিপর্যায়ের টাকা। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক টাকা। তো, বাজারে ওই সময়ে কিছু শেয়ার এলেও শেয়ারের সরবরাহ সেভাবে ছিল না। সে সময়ে অন্তত সরকারের কিছু শেয়ার ছাড়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের যেকোনো কাজের প্রক্রিয়া হতে একটু সময় লাগে। কিছু নিয়ম তো আছে। ফলে অনেকটা সময় চলে যায়। কিন্তু বাজার ক্রমাগত বাড়ার ফলে, সাধারণ মানুষ, যাঁরা এ ব্যবসার সঙ্গে কোনো দিন জড়িত ছিলেন না, এ পেশার সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন না_তাঁরা ভাবলেন, ট্রেনটা তাঁরা মিস করছেন। সবাই যখন টাকা বানাচ্ছে, তখন তাঁরা আর বসে থাকবেন কেন? তাঁরা ভাবলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে অল্প সুদ পাওয়া যায়। শেয়ারবাজারে ১০ লাখ টাকা নিয়ে গেলে মাসে এক লাখ টাকা উঠে আসে। টাকা বানানোর একটা লোভ সবার মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকার ফলে আমাদের হাউসগুলো, অর্থাৎ ব্রোকারেজ হাউসগুলো ঠিকমতো স্থান সংকুলানও করতে পারেনি। এর ফলে আমাদের অনেক শাখাও করতে হয়েছে। বিনিয়োগকারীদেরও সে রকম দাবি ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রাঞ্চ কম এমন সমালোচনাও এসেছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। মার্কেটিং ও টাকা ফুলে-ফেঁপে ওঠা সমানতালে হয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে শেয়ারের জোগান বা সরবরাহ হয়নি। এর সঙ্গে আরেকটা কারণ আছে, সেটা আরো ভয়ংকর। যেটা বিপজ্জনকভাবে বাজারকে বাড়াতে সাহায্য করেছে। এটা হচ্ছে বুক বিল্ডিং। যেমন একটা কম্পানির শেয়ারের দাম, কী পাবে প্রিমিয়াম, সেটা নির্ধারণ হবে অন্য আরেকটি লিস্টেড কম্পানির দামের ওপর। কিন্তু যেটার কোনো ডিভিডেন্ট নেই, সেটাকেও ওপরে ওঠানোর চেষ্টা হয়েছে এই বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে। কাজেই এটা স্পষ্ট যেসব কম্পানি বুক বিল্ডিংয়ের জন্য এসেছিল, তারা বাজারকে ওপরে তোলার জন্য প্রভাবিত করেছে। তাদের তথ্য-উপাত্ত তো আছে, সেগুলো দেখলেও স্পষ্ট হবে যে এর পেছনে একটি অশুভ চিন্তা কাজ করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বেচাকেনার বাজার তৈরি হয়েছিল কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে। যেখানে অতিমূল্যায়িত দামে নতুন কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বেচাকেনা হতো। এতে এসইসির আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। এই প্লেসমেন্টের পেছনে বিনিয়োগকারীদের তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা আটকা পড়ে গেছে। এই চার-পাঁচটা প্রক্রিয়া যখন একসঙ্গে বাজারে কাজ করে, তখন বাজারে দাম বাড়বেই। সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাধারণ মানুষ তো আসবেই। লাভ করতে তো সবাই চায়। লোভ সবার মধ্যেই কাজ করে। আবার, প্রাতিষ্ঠানিক লোভও কাজ করেছে। নিয়ম ও নৈতিকতার বাইরে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ৪৮টা কম্পানির বুক বিল্ডিংয়ের যে ব্যালান্স শিট তৈরি হয়েছিল, যে প্রসপেক্ট দেখানো হয়েছিল_তা কি আসলেই ঠিক ছিল? এমন অনেক অনিয়ম আছে। বাজারের আজকের যে অবস্থা এটার জন্য এসব কারণই হচ্ছে প্রধান। আবার ঢাকার বাইরে ব্রোকারেজ হাউস নিয়ে যাওয়াটাও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এতে অনেকেই প্রলুব্ধ হয়েছেন। এটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এটা সাধারণ মানুষের না। বেকারেরও না। যাঁর উদ্বৃত্ত অলস টাকা আছে, এ ব্যবসাটা তাঁর।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল, তদন্ত কমিটি একটি রিপোর্টও দিয়েছিল। সে অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
মো. শাকিল রিজভী : এসইসি রিপোর্ট অনুযায়ী অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে। বেশ কয়েকটা মামলা বোধ হয় করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে যেটা করার সেটা এসইসি করেছে। স্টক একচেঞ্জের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন, নতুন একটা করপোরেট ডিপার্টমেন্ট করা, সার্ভিলেন্স, মনিটরিং_এগুলোর জায়গা আরো শক্তিশালী হয়েছে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে। আমার মনে হয়, খুব অল্প সময়ে রিপোর্ট দেওয়াতে একটি দিক একেবারেই বাদ পড়েছে। এতে রিপোর্ট পূর্ণাঙ্গ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু কারণ অনুসন্ধানে ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়মগুলো একেবারেই বাদ দিয়ে গেছেন। রিপোর্ট নিয়ে যে সমালোচনা হয়, এ কারণেই সেটা হয়ে থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্টে সেটা থাকলে সমালোচনার কোনো জায়গা থাকত না। রিপোর্টে প্লেসমেন্টের ব্যাপারে অনেকের নাম এসেছে। কিন্তু মূল কারসাজি যারা করেছেন, তাঁদের নাম আসেনি। হ্যাঁ, প্লেসমেন্ট কোনো অপরাধ নয়। দেখতে হবে অনিয়ম হয়েছে কি না। তবে আমার জানা মতে, তাঁর তদন্ত রিপোর্টে অনিয়মের ব্যাপারে স্টক একচেঞ্জ এন্ডে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু প্রক্রিয়াধীন।
কালের কণ্ঠ : ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ১৫টি মামলার অধিকাংশই এখনো ঝুলে আছে বলে জানা যায়। মামলাগুলোর অবস্থা কী?
মো. শাকিল রিজভী : আমি যতটুকু জানি মামলাগুলো বিচারাধীন। এর বাইরে আমার এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই।
কালের কণ্ঠ : বাজারে যে ২৬ সরকারি কম্পানির শেয়ার আসার কথা ছিল সেগুলো কী অবস্থায় আছে?
মো. শাকিল রিজভী : আমি যতটুকু জানি অনেক কম্পানি এখন বাজারে আসার জন্য তৈরি হয়েছে। কাগজে-কলমে বাজারে আসার জন্য তারা প্রস্তুত। আমার ধারণা কম্পানিগুলো উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছে। সময় হলেই তারা বাজারে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে উপযুক্ত সময়টা কখন? একটু লেনদেন প্রক্রিয়া ভালো হলে, বাজার একটু স্থিতিশীল হলে তারা বাজারে আসবে বলে আমার ধারণা। বাজারের এখন যে অস্থিরতা, এটা কেটে গেলেই হয়তো বাজারে আসবে তারা। এখন আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, অস্থিরতা কাটবে কবে? হ্যাঁ, যদি দেখা যায় যে টার্নওভার বাড়ছে, ওঠানামা খুব বেশি করছে না_তাহলে বাজার স্থিতিশীল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : সূচক নিয়ে কথা বলা যাক। সূচকের এই যে ওঠানামা, যখন স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটা রোধ করা যায় কিভাবে?
মো. শাকিল রিজভী : এই বাজারকে অন্য বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। শেয়ারবাজার এত গতিশীল যে, কোনো জায়গায় স্থির করে রাখা যায় না। কারণ, শেয়ারবাজারের সঙ্গে অন্য অনেক কিছু জড়িত। যদি অন্য বিষয়গুলো জড়িত না থাকত, তাহলে হয়তো বলে দেওয়া যেত সূচক কত হতে পারে। সুদের হার পরিবর্তনের প্রভাব পড়বেই স্টক মার্কেটে। ক্যাপ উঠিয়ে দিলে এক রকম প্রভাব পড়বে, ক্যাপ দিয়ে দিলে তার প্রভাব ভিন্ন হবে। আমাদের বিকাশমান অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। তার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়বেই। অর্থনীতি যদি পরিবর্তনের মধ্যে থাকে, তাহলে শেয়ারবাজার কেমন করে স্থিতিশীল হবে? সার্বিক অর্থনীতির একটা প্রভাব আছে না? তিন মাস আগে ডলারের যে দাম ছিল, সেটা তো এখন নেই। বাজারদর কি এক সপ্তাহ আগের জায়গায় আছে? আপনি শেয়ারবাজারকে এর বাইরে রাখবেন কেমন করে? আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। অনেকে বলে থাকেন, সূচকটা পাঁচ হাজার বা ছয় হাজারে তুলে রেখে দেন। এটা তুলে রাখার কোনো সেলফ নেই। এটা রাখার জিনিসও নয়। ইনডেঙ্ আসে শেয়ারের দাম থেকে। এখানে কারো কোনো হাত নেই। প্রত্যেকটি কম্পানির পারফরম্যান্স যদি ভালো হয়, ডিভিডেন্ট হয়, আস্থা আসে, তাহলে মানুষ ওই শেয়ারটা কিনবে। তাহলে ইনডেঙ্ উঠবে। কম্পানির লাভের দিকে দেখতে হবে। সেটার ওপর নির্ভর করছে ইনডেঙ্। আবার, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে, ডলারের দাম বাড়ে, বিদ্যুৎ না থাকে, যদি উৎপাদন বিঘি্নত হয়, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল না থাকে_এর প্রভাব তো কম্পানির লাভের ওপর পড়বে। লাভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া মানে সূচক পড়বে। হ্যাঁ, না হয় বাড়িয়ে দিলাম সূচক। সেটা তো স্থিতিশীল হবে না। নিচের দিকে আসবেই।
কালের কণ্ঠ : লাভের জায়গাটি নিয়ে কথা বলা যাক। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ষান্মাসিক রিপোর্ট, যেটা অডিট করা হয় না, সেখানে অনেক লুকোছাপা করা হয়। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ কি আছে?
মো. শাকিল রিজভী : এই রিপোর্টটা তো অডিট ছাড়াই করা হয়, কাজেই এককথায় নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিনিয়োগকারীকে বিষয়টি নিজে থেকে বুঝে নিতে হবে। তবে বিনিয়োগকারীর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এমন অনেক বিষয় আছে, সেগুলো আমাদের করপোরেট বিভাগ তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। বিনিয়োগকারীকে অনেক কিছু জানতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মূল্যসূচক নিয়ে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। এক সময় সার্কিট ব্রেকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাজার চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমন কেন ঘটল?
মো. শাকিল রিজভী : যখন বাজারে বিনিয়োগকারী বেড়েছে, নতুন কিছু লোক ঢুকেছে বাজারে, তখন তো সার্কিট ব্রেকার দিয়েও ঠেকানো যায়নি। এটা কিন্তু স্বাভাবিক প্রবণতা। আবার বাজার থেকে যখন বিনিয়োগকারীরা বেরিয়ে গেছে, তখনও ঠিক সেই একই অবস্থা ঘটেছে। বাজারের পতন যাতে সহনীয় হয়, তার চেষ্টা করা হয়েছে। সার্কিট ব্রেকার দিয়ে এসইসি চেষ্টা করেছে সহনীয় করতে। ভুল যে একটা হয়েছে, এটা মেনে নিতে হবে। যে পতন আমরা এখন দেখছি এটা দুই বা তিন মাসেই শেষ হয়ে যেত। এটা এখন এক বছর ধরে হচ্ছে। সার্কিট ব্রেকার না থাকলে এটা দুই মাসেই হয়ে যেত। তবে বাজার আবার আপন শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ, ভালো ভালো অনেক কম্পানি আছে। কম্পানিগুলোর সম্পদ আছে, আয় আছে, লাভও আছে। ব্যাংক আছে, ইনস্যুরেন্স কম্পানি আছে। বাজার ঘুরবেই।
কালের কণ্ঠ : অনেকে বলে থাকেন ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এই অভিযোগের জবাবে কী বলবেন?
মো. শাকিল রিজভী : হ্যাঁ, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী আমাদের আছে। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগকারী ৩৩ লাখ নয়। এর মধ্যে ১০ লাখ আইপিও করেন। তাঁরা কিন্তু সত্যিকার অর্থে লোকসান করেননি। তাঁরা এই বাজার থেকে লাভ করেছেন। ধরুন বাজারে একটা শেয়ার এলো। ১০ টাকার শেয়ার। ১০ টাকার শেয়ারে ১০ টাকা প্রিমিয়াম পেল সেই কম্পানি। এই ১০ টাকা প্রিমিয়াম পাওয়ার ব্যাপারটি এসইসির কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা যখন সেকেন্ডারি মার্কেটে এলো, দাম হয়ে গেল ১৫০ টাকা। আমরা যারা সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে এটা কিনছি, তাঁরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই না করেই কিনছি। আমি মনে করি এসইসি যা প্রিমিয়াম দেবে তার চেয়ে সহনীয় ঊর্ধ্বমূল্যে কিনলে তবেই আমি নিরাপদ। ধরা গেল বাজার ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক আছে, আমি সেটা ২৫ টাকা দিয়ে কিনব। কিন্তু কিনছি ১৫০ টাকা। এই যে বেড়ে গেল, এ ক্ষেত্রে লোকসানের সম্ভাবনা থেকেই যায়। ২০১০-এর শেষের দিকে যাঁরা সেকেন্ডারি মার্কেটে এসেছেন, তাঁরাই বেশি লোকসান করেছেন।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে একগুচ্ছ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো কি কার্যকর হয়েছে। ২১ দফা ঘোষণার বাস্তবায়ন তো এসইসির দায়িত্ব। তারা কতটুকু করতে পেরেছে?
মো. শাকিল রিজভী : এসইসি অনেকগুলোই বাস্তবায়ন করেছে। কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোর প্রণোদনা প্যাকেজ কী অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিছু আছে সংস্কারের ব্যাপার। এটা সহজ নয়। সংস্কারের সুফল একসময় পাওয়া যাবে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। স্টক মার্কেটের সংস্কার খুব কঠিন কাজ। এতে শুরুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমার ধারণা, বাজারে যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখেই সংস্কারের কাজ করছে এসইসি। এসইসি অনেক কাজই দৃঢ়তার সঙ্গে করেছে। অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সব দুর্নীতি-অনিয়মের বৈধতা দিয়েছে এসইসি_তদন্ত কমিটির এমন মন্তব্যের জবাবে কী বলবেন?
মো. শাকিল রিজভী : বলার অপেক্ষা রাখে না, আগের এসইসির বেশ কিছু ভুল আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসইসিতে পরিবর্তনও হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান, নতুন সদস্য দেওয়া হয়েছে। কিছু অনিয়ম হয়েছে বলেই আমি মনে করি। এসইসি সেগুলো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এটা আগের এসইসির ব্যর্থতা। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও আগের এসইসিকে ঠিকমতো সহযোগিতা করেনি। আগের এসইসি কিন্তু রেগুলেটর ব্যাংকের কাছ থেকে সে রকম সহযোগিতা পায়নি। দুই রেগুলেটরি সংস্থা একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে কাজ করবে, সেটা দেখা যায়নি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে অনিয়ম, দুর্নীতি। অনিয়ম, দুর্নীতি যে হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি একমত। অনিয়ম, দুর্নীতি না হলে চোখের সামনে কেন ডাইরেক্ট লিস্টিং, বুক বিল্ডিংয়ের এই অরাজকতা চলবে? নিজের অনেক কাজ ফেলে রেখে অন্যদিকে বেশি নজর দিয়েছে এসইসি। মার্জিন রেশিও কমানো-বাড়ানো, এটা এসইসির কাজ নয়। এটা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো করবে। এসব করতে যাওয়া ভুল ছিল। তবে সব দোষ আগের এসইসিকে না দিয়ে অন্যদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। অন্যদেরও কিছু ভুল ছিল। এসইসির ওপরও কিছু রেগুলেটর হয়ে গিয়েছিল। সুপার রেগুলেটর সেজে বসার একটা প্রবণতা তখন দেখা গেছে। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। ভবিষ্যতেও এটা হলে সেটাও হবে দুঃখজনক। এসইসিকে শক্তিশালী করতে হবে। কমিশনকে কমিশনের মতো সম্মান দিতে হবে। কারো কোনো বক্তব্য থাকলে সেটা এসইসির মাধ্যমে দিতে হবে। এমন কোনো ঘোষণা কেউ দিতে পারবেন না, যেটা বাজারে প্রভাব ফেলবে। সবারই উচিত এসইসিকে সাপোর্ট দেওয়া। এসইসি যত শক্তিশালী হবে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা তত বাড়বে। আবার বেশি দামে শেয়ার কিনে এসইসিকে দোষ দেওয়াটাও ঠিক নয়। বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন হতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এসইসিকে আরো শক্তিশালী করার ব্যবস্থা কী হতে পারে?
মো. শাকিল রিজভী : এই দায়িত্বটা সরকারের। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বটা এসইসিকে দিয়ে দিতে হবে। সোজা কথা, অর্থ মন্ত্রণালয় বলে দেবে, আমাদের কাছে এসে কোনো লাভ নেই। শেয়ারবাজারের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত এসইসি নেবে। এসইসি শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক। সব সিদ্ধান্ত, দায়-দায়িত্ব এসইসির।
কালের কণ্ঠ : কারসাজিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া নাম, ভুতুড়ে অমনিবাস অ্যাকাউন্ট। এই ভুতুড়ে অ্যাকাউন্টধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া গেছে?
মো. শাকিল রিজভী : ভুতুড়ে অমনিবাস অ্যাকাউন্টধারীদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই। এমন কোনো অ্যাকাউন্ট সম্পর্কেও আমার ধারণা নেই। যদি এমন অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, সেটা শক্ত হাতে দেখা উচিত।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এখন কী অবস্থায় আছে? মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো যে বিনিয়োগ করেছিল সেগুলোর এখন কী অবস্থা? ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে কিছু ফান্ড আসার কথা ছিল। সেগুলোর কী অবস্থায় আছে?
মো. শাকিল রিজভী : প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আছে। একসময় একসঙ্গে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ঢুকেছিল, সেভাবে নতুন কেউ ঢুকছে না। এখন যাদের কাছে শেয়ার আছে, তাদেরও বোধ হয় বেশি দামে কেনা আছে। ব্যাংকগুলো দুই বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার মতো এই বাজার থেকে লাভ করেছে বলে শোনা যায়। সেটা তারা নিয়ে গেছে। তাদের অংশগ্রহণ এখন আর তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। অংশগ্রহণ সক্রিয় নয়। এখন নিয়ন্ত্রণ অনেক কঠিন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে জোর করারও সুযোগ বোধ হয় নেই। প্রণোদনা প্যাকেজে ব্যাংকগুলো অনেক সুযোগ নিয়েছিল। যারা লাভ করেছে, নৈতিক কারণেই তাদের কিছু দায়িত্ব কিন্তু থেকেই যায়। কারণ একদিকে যেমন ব্যাংকগুলো নিজের পোর্টফোলিও থেকে লাভ করেছে, অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালকরাও ভালো টাকা তুলে নিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে এত বেশি চলে গেছে যে তাতে একধরনের অসাম্য দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তখন সত্যিকার অর্থে অসুবিধায় ছিল। ওই সময়ে ছাড় না নিলে অসুবিধায় পড়ত। কিন্তু কমিটমেন্ট করে সেটা কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তা এখন বিবেচনা করতে হবে। কমিটমেন্ট রক্ষিত না হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তবে ব্যাংকগুলোর উচিত কমিটমেন্ট রাখা। আমি আশাবাদী, তারা কমিটমেন্ট রক্ষা করবে। দৃশ্যমান কিছু দেখানো গেলে বাজারের আস্থা ফিরে আসবে।
কালের কণ্ঠ : কম্পানিগুলোর এজিএম, লভ্যাংশ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে কি যথার্থ মনিটরিং হয়েছে?
মো. শাকিল রিজভী : ২০১০ সালে অনেকগুলো মনিটরিং করে এসইসিকে দেওয়া হয়েছিল। এসইসি তখন কতটুকু সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছে সেটা দেখার ব্যাপার। হয়তো কিছু কম্পানি জালিয়াতি করতে পারে। অনেকেই তো ডিভিডেন্ট দেয়। অনেকে আবার শেয়ারবাজারের নিয়মকানুন জানেই না। এগুলো তাদের জানানো উচিত। তবে মনিটরিং হওয়া উচিত। শক্তভাবে দেখা উচিত। আবার কম্পানি যদি সত্যিকার অর্থে লোকসান করে সেটা শেয়ারহোল্ডারদের মানতে হবে। অনিয়ম যদি থাকে সেটা যেমন দেখতে হবে, তেমনি বিনিয়োগকারী হিসেবে লাভ-লোকসানও বিনিয়োগকারীদের দেখতে হবে। তবে কেউ বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রাখতে পারবেন না। তথ্য সঠিকভাবে দেওয়াটা জরুরি। ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীকে বিভ্রান্ত করা বা প্রলুব্ধ করা যাবে না। এটা আইনের লঙ্ঘন।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে দরপতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করে থাকেন। আপনার মত কী?
মো. শাকিল রিজভী : সুদের হার কমালে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে বা হতে পারে, এ নিয়ে কোনো দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ছিল না। কিছু বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আগেই দেখা উচিত ছিল। নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কি না সেটা দেখা উচিত ছিল। সচেতন করা উচিত ছিল। রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিভিন্ন কম্পানির পরিচালকদের শেয়ার কেনার কথা ছিল। সময়টা কেন ছয় মাস করা হলো? পরিচালকদের শেয়ার কেনার সুযোগ তৈরির জন্যই বাজারে দরপতন ঘটানো হচ্ছে_এ অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
মো. শাকিল রিজভী : এটা আগের আইনে ছিল না। প্রত্যিটি কম্পানির একটা আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম আছে। সেখানে বলা আছে, পরিচালকদের কতটা শেয়ার কিনতে হবে। আগের শেয়ার নিয়মের মধ্যেই আছে। এখন নতুন এসইসি একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এখন তো একটা সুযোগ দিতে হবে। সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেই চলবে না। আমার মনে হয় ছয় মাস সময় খুব বেশি সময় না। পরিবর্তন করলেই তো হলো না। টাকার ব্যবস্থা তো করতে হবে। অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণও কিন্তু বাজারের জন্য ভালো নয়। ছয় মাস যৌক্তিক সময় বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয় এই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে? বিকল্প কর্মসংস্থানের একটি জায়গা হবে? কেমন করে সেটা সম্ভব? সূচক ৮০০০ পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল একসময়। এখন গড়ে ৪২০০। ঘুরে দাঁড়ানো বলতে অনেকে ৮০০০ পয়েন্টে পেঁৗছানোকে বোঝেন। আপনার কী মত?
মো. শাকিল রিজভী : আগেই বলেছি এই বাজার গতিশীল। ওঠানামার ভেতর দিয়ে নতুন বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করবে। ফ্রেশ বিনিয়োগকারী তো আসবেই বাজারে। এখন বাজারের পিই রেশিও ১১। বলা যায় এটা সহনীয়। এটা যদি ২০ থাকত, তাহলে বলা যেত সংশোধনের সময় এসেছে। আমি মনে করি নতুন বিনিয়োগকারী এলেই বাজার ভালো হবে। ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে বাজার নিরাপদ হলেই বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করা যাবে। প্রতিদিনের বেচাকেনার লোক নয়, বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগকারী। শেয়ার ধরে রাখার মতো বিনিয়োগকারী দরকার। তবে এ বাজারে ঝুঁকি কিন্তু সব সময় থাকে। তবে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পিই রেশিও অনুযায়ী এটাই বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট সময়।
কালের কণ্ঠ : সব সময় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়কে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। এটা কতটা যৌক্তিক? পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক এসইসিকে কি ইচ্ছে করেই আড়াল করা হচ্ছে?
মো. শাকিল রিজভী : কথায় কথায় পদত্যাগের দাবি তোলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। পলিসিগত কারণে কোনো সমস্যা হলে তার সমালোচনা করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট বিষয়ে সমালোচনা করতে হবে। তবে বিনিয়োগকারীকে সচেতন হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অধিক দামে শেয়ার কিনে সেটা বিক্রি করতে না পারলে কাউকে দায়ী করা যাবে না। এটাকে আপনার কর্মসংস্থানের জায়গা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে বিনিয়োগ করতে হবে উদ্বৃত্ত অলস টাকা। হ্যাঁ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা দায়িত্ব তো আছেই। পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এসইসির সঙ্গে বসা উচিত। প্রতিক্রিয়া নিয়ে অন্তত ভাবা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক সিকিউরিটিজ উইং করতে পারে। হ্যাঁ, স্টক মার্কেট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব চিন্তা থাকতে পারে। সেটা আগেই জনসমক্ষে চলে আসা উচিত নয়। একটা সমন্বয় থাকা উচিত। এখানে ঘাটতি থাকা উচিত নয়। গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত। সিদ্ধান্ত দেবে এসইসি। অন্য কেউ নয়। সবার চিন্তা এসইসির কাছ থেকে যাবে।
কালের কণ্ঠ : যেকোনো বিনিয়োগ সংরক্ষণের প্রাথমিক দায়িত্ব বিনিয়োগকারীর নিজের। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে কি এর ব্যত্যয় ঘটেছে?
মো. শাকিল রিজভী : এখানে আমাদেরও কিছু ঘাটতি আছে। মার্কেটের ব্যাপারে যথাযথ উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই। বিদেশে উপদেশ দেওয়ার জন্য অ্যাডভাইজরি সার্ভিস আছে। আমাদের দেশে নেই। বিনিয়োগকারীকে তাই নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কিছু বিশেষজ্ঞ তৈরি করা দরকার। আমাদের বন্ড মার্কেট সক্রিয় নয়। আইন থাকলেও এখানে মার্কেট মেকার নেই। ফলে বিনিয়োগকারী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : পুঁজিবাজার পরিচালনাকারী ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কি যথাযথ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন আপনি?
মো. শাকিল রিজভী : স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব বেচাকেনা দেখা। সেটা নিশ্চিত করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। দাম কী হবে সেটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। স্টক এক্সচেঞ্জ তার কাজ ঠিকমতোই করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। কিছু কার্যক্রম চলছে। স্টক এক্সচেঞ্জের একটা ট্রেনিং একাডেমী আছে। সেটা সক্রিয়। সরকার পিপিপির আওতায় একটি ট্রেনিং একাডেমী করেছে। সব মিলিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালিত হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসইসি, ভারতে সেবি (ঝঊইও) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে মাথা ঘামাতে হয় না। এখানে ভিন্ন চিত্র কেন?
মো. শাকিল রিজভী : উন্নত বিশ্বে সরকারের নীতিনির্ধারকরা স্টক মার্কেট নিয়ে মাথা ঘামাতে যান না। এটা তাঁদের কাজও না। উন্নত বিশ্বে এসইসি বা সেবি স্বাধীন। সেখানেও কিন্তু শেয়ারের দাম ওঠানামা করে। দামের ব্যাপারে এসইসির কিছু করার নেই। এসইসির দায়িত্ব অনিয়ম দেখা। এসইসি শক্তিশালী হলে অনেক সমস্যা চলে যাবে। বাজারের অনিয়ম এসইসি দেখবে। এখানে ভিন্ন চিত্র যদি থেকেই থাকে, সেটা পাল্টাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. শাকিল রিজভী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। বাজারের আজকের এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করবেন।
মো. শাকিল রিজভী : বাজারে যে দরপতনের ধারা, এটা শুরু হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে। এর আগে তিন বছর ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ পর্যন্ত বাজার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ২০১০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সূচক ছিল ৫৩০০। যেটা ওই বছরই শেষের দিকে গিয়ে ৮৯০০ হয়। এই যে উত্থান, এটাই হলো পতনের প্রধান কারণ। অস্বাভাবিক উপরে উঠে গেলে বাজার পড়বেই। এটাই বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। সেই পতনটা কত সহনীয়ভাবে হতে পারে, সেটাই হচ্ছে বিবেচনার বিষয়। তার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাটা ছিল বাজার অস্বাভাবিকভাবে উপরে উঠে যাওয়াটা। এর পেছনে অনেক ছোটখাটো কারণ থাকতে পারে। কিন্তু মৌলিক কারণ ছিল সুদের হার। ২০০৯ সালে এটাকে সিঙ্গেল ডিজিটে আনা হলো। সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানো হলো। সুদের ওপর কর ধার্য করা হলো। এফডিআর ইন্টারেস্ট রেটকে সিঙ্গেল ডিজিট করা হলো। যখন এভাবে অর্থাৎ কম সুদের কারণে সঞ্চয়ের ওপর একটা চাপ এলো, তখন কিছু ফান্ড এদিকে এসেছে। শেয়ারবাজারে টাকা ঢুকলে শেয়ারের দাম বাড়ে। এটাই স্বাভাবিক। এটা হচ্ছে একটা কারণ। এবার আরেকটা কারণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। মার্চেন্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প ব্যবসার কোনো সুযোগ না পেয়ে এখানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করল। অনেক ক্ষেত্রে সেটা নিয়মের বাইরে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুই জায়গা থেকে টাকা এসেছে বাজারে। একদিকে ব্যক্তিপর্যায়ের টাকা। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক টাকা। তো, বাজারে ওই সময়ে কিছু শেয়ার এলেও শেয়ারের সরবরাহ সেভাবে ছিল না। সে সময়ে অন্তত সরকারের কিছু শেয়ার ছাড়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের যেকোনো কাজের প্রক্রিয়া হতে একটু সময় লাগে। কিছু নিয়ম তো আছে। ফলে অনেকটা সময় চলে যায়। কিন্তু বাজার ক্রমাগত বাড়ার ফলে, সাধারণ মানুষ, যাঁরা এ ব্যবসার সঙ্গে কোনো দিন জড়িত ছিলেন না, এ পেশার সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন না_তাঁরা ভাবলেন, ট্রেনটা তাঁরা মিস করছেন। সবাই যখন টাকা বানাচ্ছে, তখন তাঁরা আর বসে থাকবেন কেন? তাঁরা ভাবলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে অল্প সুদ পাওয়া যায়। শেয়ারবাজারে ১০ লাখ টাকা নিয়ে গেলে মাসে এক লাখ টাকা উঠে আসে। টাকা বানানোর একটা লোভ সবার মধ্যেই তৈরি হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকার ফলে আমাদের হাউসগুলো, অর্থাৎ ব্রোকারেজ হাউসগুলো ঠিকমতো স্থান সংকুলানও করতে পারেনি। এর ফলে আমাদের অনেক শাখাও করতে হয়েছে। বিনিয়োগকারীদেরও সে রকম দাবি ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রাঞ্চ কম এমন সমালোচনাও এসেছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। মার্কেটিং ও টাকা ফুলে-ফেঁপে ওঠা সমানতালে হয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে শেয়ারের জোগান বা সরবরাহ হয়নি। এর সঙ্গে আরেকটা কারণ আছে, সেটা আরো ভয়ংকর। যেটা বিপজ্জনকভাবে বাজারকে বাড়াতে সাহায্য করেছে। এটা হচ্ছে বুক বিল্ডিং। যেমন একটা কম্পানির শেয়ারের দাম, কী পাবে প্রিমিয়াম, সেটা নির্ধারণ হবে অন্য আরেকটি লিস্টেড কম্পানির দামের ওপর। কিন্তু যেটার কোনো ডিভিডেন্ট নেই, সেটাকেও ওপরে ওঠানোর চেষ্টা হয়েছে এই বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে। কাজেই এটা স্পষ্ট যেসব কম্পানি বুক বিল্ডিংয়ের জন্য এসেছিল, তারা বাজারকে ওপরে তোলার জন্য প্রভাবিত করেছে। তাদের তথ্য-উপাত্ত তো আছে, সেগুলো দেখলেও স্পষ্ট হবে যে এর পেছনে একটি অশুভ চিন্তা কাজ করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বেচাকেনার বাজার তৈরি হয়েছিল কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে। যেখানে অতিমূল্যায়িত দামে নতুন কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বেচাকেনা হতো। এতে এসইসির আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। এই প্লেসমেন্টের পেছনে বিনিয়োগকারীদের তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা আটকা পড়ে গেছে। এই চার-পাঁচটা প্রক্রিয়া যখন একসঙ্গে বাজারে কাজ করে, তখন বাজারে দাম বাড়বেই। সাধারণ মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সাধারণ মানুষ তো আসবেই। লাভ করতে তো সবাই চায়। লোভ সবার মধ্যেই কাজ করে। আবার, প্রাতিষ্ঠানিক লোভও কাজ করেছে। নিয়ম ও নৈতিকতার বাইরে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ৪৮টা কম্পানির বুক বিল্ডিংয়ের যে ব্যালান্স শিট তৈরি হয়েছিল, যে প্রসপেক্ট দেখানো হয়েছিল_তা কি আসলেই ঠিক ছিল? এমন অনেক অনিয়ম আছে। বাজারের আজকের যে অবস্থা এটার জন্য এসব কারণই হচ্ছে প্রধান। আবার ঢাকার বাইরে ব্রোকারেজ হাউস নিয়ে যাওয়াটাও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। এতে অনেকেই প্রলুব্ধ হয়েছেন। এটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। এটা সাধারণ মানুষের না। বেকারেরও না। যাঁর উদ্বৃত্ত অলস টাকা আছে, এ ব্যবসাটা তাঁর।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল, তদন্ত কমিটি একটি রিপোর্টও দিয়েছিল। সে অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
মো. শাকিল রিজভী : এসইসি রিপোর্ট অনুযায়ী অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে। বেশ কয়েকটা মামলা বোধ হয় করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে যেটা করার সেটা এসইসি করেছে। স্টক একচেঞ্জের ডি-মিউচুয়ালাইজেশন, নতুন একটা করপোরেট ডিপার্টমেন্ট করা, সার্ভিলেন্স, মনিটরিং_এগুলোর জায়গা আরো শক্তিশালী হয়েছে ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে। আমার মনে হয়, খুব অল্প সময়ে রিপোর্ট দেওয়াতে একটি দিক একেবারেই বাদ পড়েছে। এতে রিপোর্ট পূর্ণাঙ্গ হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু কারণ অনুসন্ধানে ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়মগুলো একেবারেই বাদ দিয়ে গেছেন। রিপোর্ট নিয়ে যে সমালোচনা হয়, এ কারণেই সেটা হয়ে থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম নিয়ে রিপোর্টে সেটা থাকলে সমালোচনার কোনো জায়গা থাকত না। রিপোর্টে প্লেসমেন্টের ব্যাপারে অনেকের নাম এসেছে। কিন্তু মূল কারসাজি যারা করেছেন, তাঁদের নাম আসেনি। হ্যাঁ, প্লেসমেন্ট কোনো অপরাধ নয়। দেখতে হবে অনিয়ম হয়েছে কি না। তবে আমার জানা মতে, তাঁর তদন্ত রিপোর্টে অনিয়মের ব্যাপারে স্টক একচেঞ্জ এন্ডে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু প্রক্রিয়াধীন।
কালের কণ্ঠ : ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ১৫টি মামলার অধিকাংশই এখনো ঝুলে আছে বলে জানা যায়। মামলাগুলোর অবস্থা কী?
মো. শাকিল রিজভী : আমি যতটুকু জানি মামলাগুলো বিচারাধীন। এর বাইরে আমার এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই।
কালের কণ্ঠ : বাজারে যে ২৬ সরকারি কম্পানির শেয়ার আসার কথা ছিল সেগুলো কী অবস্থায় আছে?
মো. শাকিল রিজভী : আমি যতটুকু জানি অনেক কম্পানি এখন বাজারে আসার জন্য তৈরি হয়েছে। কাগজে-কলমে বাজারে আসার জন্য তারা প্রস্তুত। আমার ধারণা কম্পানিগুলো উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছে। সময় হলেই তারা বাজারে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে উপযুক্ত সময়টা কখন? একটু লেনদেন প্রক্রিয়া ভালো হলে, বাজার একটু স্থিতিশীল হলে তারা বাজারে আসবে বলে আমার ধারণা। বাজারের এখন যে অস্থিরতা, এটা কেটে গেলেই হয়তো বাজারে আসবে তারা। এখন আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, অস্থিরতা কাটবে কবে? হ্যাঁ, যদি দেখা যায় যে টার্নওভার বাড়ছে, ওঠানামা খুব বেশি করছে না_তাহলে বাজার স্থিতিশীল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : সূচক নিয়ে কথা বলা যাক। সূচকের এই যে ওঠানামা, যখন স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটা রোধ করা যায় কিভাবে?
মো. শাকিল রিজভী : এই বাজারকে অন্য বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। শেয়ারবাজার এত গতিশীল যে, কোনো জায়গায় স্থির করে রাখা যায় না। কারণ, শেয়ারবাজারের সঙ্গে অন্য অনেক কিছু জড়িত। যদি অন্য বিষয়গুলো জড়িত না থাকত, তাহলে হয়তো বলে দেওয়া যেত সূচক কত হতে পারে। সুদের হার পরিবর্তনের প্রভাব পড়বেই স্টক মার্কেটে। ক্যাপ উঠিয়ে দিলে এক রকম প্রভাব পড়বে, ক্যাপ দিয়ে দিলে তার প্রভাব ভিন্ন হবে। আমাদের বিকাশমান অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। তার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়বেই। অর্থনীতি যদি পরিবর্তনের মধ্যে থাকে, তাহলে শেয়ারবাজার কেমন করে স্থিতিশীল হবে? সার্বিক অর্থনীতির একটা প্রভাব আছে না? তিন মাস আগে ডলারের যে দাম ছিল, সেটা তো এখন নেই। বাজারদর কি এক সপ্তাহ আগের জায়গায় আছে? আপনি শেয়ারবাজারকে এর বাইরে রাখবেন কেমন করে? আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। অনেকে বলে থাকেন, সূচকটা পাঁচ হাজার বা ছয় হাজারে তুলে রেখে দেন। এটা তুলে রাখার কোনো সেলফ নেই। এটা রাখার জিনিসও নয়। ইনডেঙ্ আসে শেয়ারের দাম থেকে। এখানে কারো কোনো হাত নেই। প্রত্যেকটি কম্পানির পারফরম্যান্স যদি ভালো হয়, ডিভিডেন্ট হয়, আস্থা আসে, তাহলে মানুষ ওই শেয়ারটা কিনবে। তাহলে ইনডেঙ্ উঠবে। কম্পানির লাভের দিকে দেখতে হবে। সেটার ওপর নির্ভর করছে ইনডেঙ্। আবার, যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে, ডলারের দাম বাড়ে, বিদ্যুৎ না থাকে, যদি উৎপাদন বিঘি্নত হয়, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল না থাকে_এর প্রভাব তো কম্পানির লাভের ওপর পড়বে। লাভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া মানে সূচক পড়বে। হ্যাঁ, না হয় বাড়িয়ে দিলাম সূচক। সেটা তো স্থিতিশীল হবে না। নিচের দিকে আসবেই।
কালের কণ্ঠ : লাভের জায়গাটি নিয়ে কথা বলা যাক। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ষান্মাসিক রিপোর্ট, যেটা অডিট করা হয় না, সেখানে অনেক লুকোছাপা করা হয়। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ কি আছে?
মো. শাকিল রিজভী : এই রিপোর্টটা তো অডিট ছাড়াই করা হয়, কাজেই এককথায় নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। তবে বিনিয়োগকারীকে বিষয়টি নিজে থেকে বুঝে নিতে হবে। তবে বিনিয়োগকারীর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এমন অনেক বিষয় আছে, সেগুলো আমাদের করপোরেট বিভাগ তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। বিনিয়োগকারীকে অনেক কিছু জানতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে।
কালের কণ্ঠ : মূল্যসূচক নিয়ে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। এক সময় সার্কিট ব্রেকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাজার চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এমন কেন ঘটল?
মো. শাকিল রিজভী : যখন বাজারে বিনিয়োগকারী বেড়েছে, নতুন কিছু লোক ঢুকেছে বাজারে, তখন তো সার্কিট ব্রেকার দিয়েও ঠেকানো যায়নি। এটা কিন্তু স্বাভাবিক প্রবণতা। আবার বাজার থেকে যখন বিনিয়োগকারীরা বেরিয়ে গেছে, তখনও ঠিক সেই একই অবস্থা ঘটেছে। বাজারের পতন যাতে সহনীয় হয়, তার চেষ্টা করা হয়েছে। সার্কিট ব্রেকার দিয়ে এসইসি চেষ্টা করেছে সহনীয় করতে। ভুল যে একটা হয়েছে, এটা মেনে নিতে হবে। যে পতন আমরা এখন দেখছি এটা দুই বা তিন মাসেই শেষ হয়ে যেত। এটা এখন এক বছর ধরে হচ্ছে। সার্কিট ব্রেকার না থাকলে এটা দুই মাসেই হয়ে যেত। তবে বাজার আবার আপন শক্তিতেই ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ, ভালো ভালো অনেক কম্পানি আছে। কম্পানিগুলোর সম্পদ আছে, আয় আছে, লাভও আছে। ব্যাংক আছে, ইনস্যুরেন্স কম্পানি আছে। বাজার ঘুরবেই।
কালের কণ্ঠ : অনেকে বলে থাকেন ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এই অভিযোগের জবাবে কী বলবেন?
মো. শাকিল রিজভী : হ্যাঁ, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী আমাদের আছে। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগকারী ৩৩ লাখ নয়। এর মধ্যে ১০ লাখ আইপিও করেন। তাঁরা কিন্তু সত্যিকার অর্থে লোকসান করেননি। তাঁরা এই বাজার থেকে লাভ করেছেন। ধরুন বাজারে একটা শেয়ার এলো। ১০ টাকার শেয়ার। ১০ টাকার শেয়ারে ১০ টাকা প্রিমিয়াম পেল সেই কম্পানি। এই ১০ টাকা প্রিমিয়াম পাওয়ার ব্যাপারটি এসইসির কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা যখন সেকেন্ডারি মার্কেটে এলো, দাম হয়ে গেল ১৫০ টাকা। আমরা যারা সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে এটা কিনছি, তাঁরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই না করেই কিনছি। আমি মনে করি এসইসি যা প্রিমিয়াম দেবে তার চেয়ে সহনীয় ঊর্ধ্বমূল্যে কিনলে তবেই আমি নিরাপদ। ধরা গেল বাজার ঊর্ধ্বমুখী, ঠিক আছে, আমি সেটা ২৫ টাকা দিয়ে কিনব। কিন্তু কিনছি ১৫০ টাকা। এই যে বেড়ে গেল, এ ক্ষেত্রে লোকসানের সম্ভাবনা থেকেই যায়। ২০১০-এর শেষের দিকে যাঁরা সেকেন্ডারি মার্কেটে এসেছেন, তাঁরাই বেশি লোকসান করেছেন।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে একগুচ্ছ ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো কি কার্যকর হয়েছে। ২১ দফা ঘোষণার বাস্তবায়ন তো এসইসির দায়িত্ব। তারা কতটুকু করতে পেরেছে?
মো. শাকিল রিজভী : এসইসি অনেকগুলোই বাস্তবায়ন করেছে। কিছু প্রক্রিয়াধীন আছে। ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কম্পানিগুলোর প্রণোদনা প্যাকেজ কী অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিছু আছে সংস্কারের ব্যাপার। এটা সহজ নয়। সংস্কারের সুফল একসময় পাওয়া যাবে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। স্টক মার্কেটের সংস্কার খুব কঠিন কাজ। এতে শুরুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমার ধারণা, বাজারে যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখেই সংস্কারের কাজ করছে এসইসি। এসইসি অনেক কাজই দৃঢ়তার সঙ্গে করেছে। অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সব দুর্নীতি-অনিয়মের বৈধতা দিয়েছে এসইসি_তদন্ত কমিটির এমন মন্তব্যের জবাবে কী বলবেন?
মো. শাকিল রিজভী : বলার অপেক্ষা রাখে না, আগের এসইসির বেশ কিছু ভুল আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসইসিতে পরিবর্তনও হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান, নতুন সদস্য দেওয়া হয়েছে। কিছু অনিয়ম হয়েছে বলেই আমি মনে করি। এসইসি সেগুলো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এটা আগের এসইসির ব্যর্থতা। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও আগের এসইসিকে ঠিকমতো সহযোগিতা করেনি। আগের এসইসি কিন্তু রেগুলেটর ব্যাংকের কাছ থেকে সে রকম সহযোগিতা পায়নি। দুই রেগুলেটরি সংস্থা একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে কাজ করবে, সেটা দেখা যায়নি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে অনিয়ম, দুর্নীতি। অনিয়ম, দুর্নীতি যে হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি একমত। অনিয়ম, দুর্নীতি না হলে চোখের সামনে কেন ডাইরেক্ট লিস্টিং, বুক বিল্ডিংয়ের এই অরাজকতা চলবে? নিজের অনেক কাজ ফেলে রেখে অন্যদিকে বেশি নজর দিয়েছে এসইসি। মার্জিন রেশিও কমানো-বাড়ানো, এটা এসইসির কাজ নয়। এটা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো করবে। এসব করতে যাওয়া ভুল ছিল। তবে সব দোষ আগের এসইসিকে না দিয়ে অন্যদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। অন্যদেরও কিছু ভুল ছিল। এসইসির ওপরও কিছু রেগুলেটর হয়ে গিয়েছিল। সুপার রেগুলেটর সেজে বসার একটা প্রবণতা তখন দেখা গেছে। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। ভবিষ্যতেও এটা হলে সেটাও হবে দুঃখজনক। এসইসিকে শক্তিশালী করতে হবে। কমিশনকে কমিশনের মতো সম্মান দিতে হবে। কারো কোনো বক্তব্য থাকলে সেটা এসইসির মাধ্যমে দিতে হবে। এমন কোনো ঘোষণা কেউ দিতে পারবেন না, যেটা বাজারে প্রভাব ফেলবে। সবারই উচিত এসইসিকে সাপোর্ট দেওয়া। এসইসি যত শক্তিশালী হবে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা তত বাড়বে। আবার বেশি দামে শেয়ার কিনে এসইসিকে দোষ দেওয়াটাও ঠিক নয়। বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন হতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এসইসিকে আরো শক্তিশালী করার ব্যবস্থা কী হতে পারে?
মো. শাকিল রিজভী : এই দায়িত্বটা সরকারের। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বটা এসইসিকে দিয়ে দিতে হবে। সোজা কথা, অর্থ মন্ত্রণালয় বলে দেবে, আমাদের কাছে এসে কোনো লাভ নেই। শেয়ারবাজারের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত এসইসি নেবে। এসইসি শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক। সব সিদ্ধান্ত, দায়-দায়িত্ব এসইসির।
কালের কণ্ঠ : কারসাজিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া নাম, ভুতুড়ে অমনিবাস অ্যাকাউন্ট। এই ভুতুড়ে অ্যাকাউন্টধারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া গেছে?
মো. শাকিল রিজভী : ভুতুড়ে অমনিবাস অ্যাকাউন্টধারীদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নেই। এমন কোনো অ্যাকাউন্ট সম্পর্কেও আমার ধারণা নেই। যদি এমন অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, সেটা শক্ত হাতে দেখা উচিত।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এখন কী অবস্থায় আছে? মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো যে বিনিয়োগ করেছিল সেগুলোর এখন কী অবস্থা? ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে কিছু ফান্ড আসার কথা ছিল। সেগুলোর কী অবস্থায় আছে?
মো. শাকিল রিজভী : প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আছে। একসময় একসঙ্গে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ঢুকেছিল, সেভাবে নতুন কেউ ঢুকছে না। এখন যাদের কাছে শেয়ার আছে, তাদেরও বোধ হয় বেশি দামে কেনা আছে। ব্যাংকগুলো দুই বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার মতো এই বাজার থেকে লাভ করেছে বলে শোনা যায়। সেটা তারা নিয়ে গেছে। তাদের অংশগ্রহণ এখন আর তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। অংশগ্রহণ সক্রিয় নয়। এখন নিয়ন্ত্রণ অনেক কঠিন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে জোর করারও সুযোগ বোধ হয় নেই। প্রণোদনা প্যাকেজে ব্যাংকগুলো অনেক সুযোগ নিয়েছিল। যারা লাভ করেছে, নৈতিক কারণেই তাদের কিছু দায়িত্ব কিন্তু থেকেই যায়। কারণ একদিকে যেমন ব্যাংকগুলো নিজের পোর্টফোলিও থেকে লাভ করেছে, অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালকরাও ভালো টাকা তুলে নিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে এত বেশি চলে গেছে যে তাতে একধরনের অসাম্য দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তখন সত্যিকার অর্থে অসুবিধায় ছিল। ওই সময়ে ছাড় না নিলে অসুবিধায় পড়ত। কিন্তু কমিটমেন্ট করে সেটা কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তা এখন বিবেচনা করতে হবে। কমিটমেন্ট রক্ষিত না হলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তবে ব্যাংকগুলোর উচিত কমিটমেন্ট রাখা। আমি আশাবাদী, তারা কমিটমেন্ট রক্ষা করবে। দৃশ্যমান কিছু দেখানো গেলে বাজারের আস্থা ফিরে আসবে।
কালের কণ্ঠ : কম্পানিগুলোর এজিএম, লভ্যাংশ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে কি যথার্থ মনিটরিং হয়েছে?
মো. শাকিল রিজভী : ২০১০ সালে অনেকগুলো মনিটরিং করে এসইসিকে দেওয়া হয়েছিল। এসইসি তখন কতটুকু সতর্কতার সঙ্গে কাজ করেছে সেটা দেখার ব্যাপার। হয়তো কিছু কম্পানি জালিয়াতি করতে পারে। অনেকেই তো ডিভিডেন্ট দেয়। অনেকে আবার শেয়ারবাজারের নিয়মকানুন জানেই না। এগুলো তাদের জানানো উচিত। তবে মনিটরিং হওয়া উচিত। শক্তভাবে দেখা উচিত। আবার কম্পানি যদি সত্যিকার অর্থে লোকসান করে সেটা শেয়ারহোল্ডারদের মানতে হবে। অনিয়ম যদি থাকে সেটা যেমন দেখতে হবে, তেমনি বিনিয়োগকারী হিসেবে লাভ-লোকসানও বিনিয়োগকারীদের দেখতে হবে। তবে কেউ বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রাখতে পারবেন না। তথ্য সঠিকভাবে দেওয়াটা জরুরি। ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীকে বিভ্রান্ত করা বা প্রলুব্ধ করা যাবে না। এটা আইনের লঙ্ঘন।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজারে দরপতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করে থাকেন। আপনার মত কী?
মো. শাকিল রিজভী : সুদের হার কমালে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে বা হতে পারে, এ নিয়ে কোনো দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ছিল না। কিছু বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আগেই দেখা উচিত ছিল। নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কি না সেটা দেখা উচিত ছিল। সচেতন করা উচিত ছিল। রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বিভিন্ন কম্পানির পরিচালকদের শেয়ার কেনার কথা ছিল। সময়টা কেন ছয় মাস করা হলো? পরিচালকদের শেয়ার কেনার সুযোগ তৈরির জন্যই বাজারে দরপতন ঘটানো হচ্ছে_এ অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
মো. শাকিল রিজভী : এটা আগের আইনে ছিল না। প্রত্যিটি কম্পানির একটা আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম আছে। সেখানে বলা আছে, পরিচালকদের কতটা শেয়ার কিনতে হবে। আগের শেয়ার নিয়মের মধ্যেই আছে। এখন নতুন এসইসি একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এখন তো একটা সুযোগ দিতে হবে। সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেই চলবে না। আমার মনে হয় ছয় মাস সময় খুব বেশি সময় না। পরিবর্তন করলেই তো হলো না। টাকার ব্যবস্থা তো করতে হবে। অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণও কিন্তু বাজারের জন্য ভালো নয়। ছয় মাস যৌক্তিক সময় বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয় এই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে? বিকল্প কর্মসংস্থানের একটি জায়গা হবে? কেমন করে সেটা সম্ভব? সূচক ৮০০০ পয়েন্ট ছাড়িয়েছিল একসময়। এখন গড়ে ৪২০০। ঘুরে দাঁড়ানো বলতে অনেকে ৮০০০ পয়েন্টে পেঁৗছানোকে বোঝেন। আপনার কী মত?
মো. শাকিল রিজভী : আগেই বলেছি এই বাজার গতিশীল। ওঠানামার ভেতর দিয়ে নতুন বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করবে। ফ্রেশ বিনিয়োগকারী তো আসবেই বাজারে। এখন বাজারের পিই রেশিও ১১। বলা যায় এটা সহনীয়। এটা যদি ২০ থাকত, তাহলে বলা যেত সংশোধনের সময় এসেছে। আমি মনে করি নতুন বিনিয়োগকারী এলেই বাজার ভালো হবে। ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে বাজার নিরাপদ হলেই বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করা যাবে। প্রতিদিনের বেচাকেনার লোক নয়, বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগকারী। শেয়ার ধরে রাখার মতো বিনিয়োগকারী দরকার। তবে এ বাজারে ঝুঁকি কিন্তু সব সময় থাকে। তবে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পিই রেশিও অনুযায়ী এটাই বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট সময়।
কালের কণ্ঠ : সব সময় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারের সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়কে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। এটা কতটা যৌক্তিক? পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক এসইসিকে কি ইচ্ছে করেই আড়াল করা হচ্ছে?
মো. শাকিল রিজভী : কথায় কথায় পদত্যাগের দাবি তোলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। পলিসিগত কারণে কোনো সমস্যা হলে তার সমালোচনা করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট বিষয়ে সমালোচনা করতে হবে। তবে বিনিয়োগকারীকে সচেতন হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অধিক দামে শেয়ার কিনে সেটা বিক্রি করতে না পারলে কাউকে দায়ী করা যাবে না। এটাকে আপনার কর্মসংস্থানের জায়গা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে বিনিয়োগ করতে হবে উদ্বৃত্ত অলস টাকা। হ্যাঁ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা দায়িত্ব তো আছেই। পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এসইসির সঙ্গে বসা উচিত। প্রতিক্রিয়া নিয়ে অন্তত ভাবা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক সিকিউরিটিজ উইং করতে পারে। হ্যাঁ, স্টক মার্কেট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব চিন্তা থাকতে পারে। সেটা আগেই জনসমক্ষে চলে আসা উচিত নয়। একটা সমন্বয় থাকা উচিত। এখানে ঘাটতি থাকা উচিত নয়। গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত। সিদ্ধান্ত দেবে এসইসি। অন্য কেউ নয়। সবার চিন্তা এসইসির কাছ থেকে যাবে।
কালের কণ্ঠ : যেকোনো বিনিয়োগ সংরক্ষণের প্রাথমিক দায়িত্ব বিনিয়োগকারীর নিজের। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে কি এর ব্যত্যয় ঘটেছে?
মো. শাকিল রিজভী : এখানে আমাদেরও কিছু ঘাটতি আছে। মার্কেটের ব্যাপারে যথাযথ উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই। বিদেশে উপদেশ দেওয়ার জন্য অ্যাডভাইজরি সার্ভিস আছে। আমাদের দেশে নেই। বিনিয়োগকারীকে তাই নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কিছু বিশেষজ্ঞ তৈরি করা দরকার। আমাদের বন্ড মার্কেট সক্রিয় নয়। আইন থাকলেও এখানে মার্কেট মেকার নেই। ফলে বিনিয়োগকারী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : পুঁজিবাজার পরিচালনাকারী ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কি যথাযথ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন আপনি?
মো. শাকিল রিজভী : স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব বেচাকেনা দেখা। সেটা নিশ্চিত করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। দাম কী হবে সেটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। স্টক এক্সচেঞ্জ তার কাজ ঠিকমতোই করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। কিছু কার্যক্রম চলছে। স্টক এক্সচেঞ্জের একটা ট্রেনিং একাডেমী আছে। সেটা সক্রিয়। সরকার পিপিপির আওতায় একটি ট্রেনিং একাডেমী করেছে। সব মিলিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালিত হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসইসি, ভারতে সেবি (ঝঊইও) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে মাথা ঘামাতে হয় না। এখানে ভিন্ন চিত্র কেন?
মো. শাকিল রিজভী : উন্নত বিশ্বে সরকারের নীতিনির্ধারকরা স্টক মার্কেট নিয়ে মাথা ঘামাতে যান না। এটা তাঁদের কাজও না। উন্নত বিশ্বে এসইসি বা সেবি স্বাধীন। সেখানেও কিন্তু শেয়ারের দাম ওঠানামা করে। দামের ব্যাপারে এসইসির কিছু করার নেই। এসইসির দায়িত্ব অনিয়ম দেখা। এসইসি শক্তিশালী হলে অনেক সমস্যা চলে যাবে। বাজারের অনিয়ম এসইসি দেখবে। এখানে ভিন্ন চিত্র যদি থেকেই থাকে, সেটা পাল্টাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. শাকিল রিজভী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments