ভারত অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে by মাহফুজ আনাম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বহুল আলোচিত ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে সেই চুক্তি সই হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
আজ প্রকাশ করা হলো ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের বিশ্লেষণ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে এবার যে ব্যাপক আলোচনা হলো, তার একটি পটভূমি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন গেছে, অনেক টানাপোড়েন ও ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের জনগণের স্বার্থেই সেই অবস্থার উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সত্যিকারভাবেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন হোক, তা চায়নি। আগেরবার শেখ হাসিনার সরকারও সম্পর্কোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এবার নিয়েছে।
২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর মাধ্যমে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি নতুনধারা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সীমান্ত নিরাপত্তাসহ ভারতের যেসব উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল, সেগুলো দূর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং করেছেনও।
ভারতে আমাদের যেসব বন্ধু সাংবাদিক, কূটনীতিক ও গবেষক আছেন; ব্যক্তিগত আলোচনা কিংবা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশ শুধু তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাটুকু দিক, বাংলাদেশের ভূমি ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত হবে না, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র যাবে না—এই নিশ্চয়তা পেলে আর তাদের কিছু চাওয়ার নেই। ভারত সরকারের মনোভাবও ছিল তা-ই। আমি বলব, শেখ হাসিনা সেই নিশ্চয়তা পুরোপুরি দিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, আমরা যে ভারতকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলাম, বিনিময়ে ভারত আমাদের কী দিল? ২০১০ সালের জানুয়ারির যুক্ত ইশতেহারে ভারত কতগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তার বাস্তবায়ন আশা করা গিয়েছিল মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ে।
দুই দেশের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়ার প্রধান বিষয়—নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও ট্রানজিট-সুবিধা। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আগেই দেওয়া হয়েছে। ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারেও বাংলাদেশ নীতিগত সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের চাওয়ার প্রধান বিষয়—অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বাণিজ্য-বৈষম্য কমানো। দ্বিতীয়ত, ভারত কেন ট্রানজিট চাইছে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। আমরা কেন পানি চাইছি? আমাদের উন্নয়নের জন্য ভারত সেটি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছে, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ আপত্তি জানিয়েছে। সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা আলোচনা করেছি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি থাকলে তা কেন্দ্রকেই মেটাতে হবে। আজ পানি চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ আপত্তি করেছে, কাল হয়তো বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে মহারাষ্ট্র আপত্তি করবে, পরশু অন্য কিছু নিয়ে কর্ণাটক আপত্তি করবে। তাহলে তো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন হবে না।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা জরুরি। এই যে তিস্তা নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দিল, চুক্তি সইয়ের প্রশ্নটি কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। এর আগে অনেক আলোচনা হয়েছে, দুই পক্ষে দর-কষাকষি, তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে। সবকিছু শেষ করেই দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় এসেছিল বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এবং আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে তিস্তা চুক্তি হলো না, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর বড় আঘাত।
এর অর্থ এই নয় যে আমরা ভারতের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেব। অবশ্যই আলোচনা করব। কিন্তু যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, তা যে বাধাগ্রস্ত হলো, সে বিষয়টি ভারতকে স্বীকার করতে হবে। এখন আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। দুই প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক সহযোগিতা রূপরেখায় সই করেছেন। দেখতে হবে সেই রূপরেখা বাস্তবায়নে ভারত কী কী করতে পারে, আমরা কী কী করতে পারি—সব বিষয়ে একসঙ্গে বসতে হবে এবং সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আগের মতো একটি-দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে সহযোগিতা হবে না। ছোট প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের দর-কষাকষির জায়গা থাকবে না।
আগে বৃহৎ ও ছোট প্রতিবেশীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রধান নিয়ামক ছিল। একুশ শতকে সেই অবস্থা নেই। এখন অর্থনীতিই চালিকাশক্তি। আমরা মালয়েশিয়ার পাশে যদি সিঙ্গাপুরকে দেখি, কিংবা চীনের পাশে ভিয়েতনামকে। তাদের মধ্যে অনেক টানাপোড়েন সত্ত্বেও সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। অতএব, ভারতকে এগিয়ে যেতে হলে ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশকেও সঙ্গে নিতে হবে।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। কেননা দেশটি এখন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন পেতেও আগ্রহী। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যদি এমন ধারণা হয় যে ভারত প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারে না, তাহলে তার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। আরেকটি বিষয় ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগে ভারত ছিল অনেকটা পাকিস্তানমুখী, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন পাকিস্তানে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, জঙ্গিবাদী তৎপরতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে, তাতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা নেই। আফগানিস্তানের অবস্থা আরও নাজুক। নেপাল ও ভুটান ছোট রাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদার হতে পারে—বাংলাদেশই। নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা বাড়ানো উচিত। কিন্তু মনমোহনের সফরে নয়াদিল্লি সেই দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি হলে তা ভারতের জন্য লাভজনক। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় বছরে চার থেকে সাড়ে চার শ ডলার। আর এখানে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় যদি ৬০০ ডলারে উন্নীত হয়, ভারতের বাণিজ্য তখন তো ১০ বিলিয়ন ডলার পৌঁছে যাবে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভারতের জন্য যেমন আকর্ষণীয় বাজার, তেমনি বিনিয়োগেরও উজ্জ্বল গন্তব্য। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবেই ভাবতে হবে ভারতকে।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি বাংলাদেশ কেন আগে জানল না? ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি না জেনে থাকেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর না জানা তেমন দোষণীয় নয়। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যর্থতা হলো, এত বড় দ্বিপক্ষীয় একটি বিষয়কে এগিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি মোটেই স্বচ্ছ ছিল না। কূটনীতিতে দুটি বিষয় আছে—একটি গোপনীয়, আরেকটি প্রকাশ্য। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কাজটি ছোট্ট একটি গ্রুপ শুরু করতে পারে কিন্তু এর রূপরেখা বা কাঠামো নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা হতে পারত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক কিছু কর্মকর্তা, দু-একজন উপদেষ্টার মধ্যেই তৎপরতা সীমিত ছিল। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তেমন কিছু জানতেন না। বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে আলোচিত হয়নি, বিরোধী দলের কথা না-হয় বাদই দিলাম, ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিকদের সঙ্গেও কেউ কথা বলেননি। গণমাধ্যমকেও কিছু জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি সরকার। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা না হওয়া। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কি তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের ওপরও আস্থা রাখতে পারেননি?
অন্যদিকে ভারত সরকার বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলেছে। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে। সংসদে আলোচনা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলেছেন। আমাদের সরকার তার দেশের গণমাধ্যমকে এতই তুচ্ছ ও নগণ্য ভাবে!
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক, ডেইলি স্টার।
No comments