শ্রদ্ধাঞ্জলি-বিলকিস নাসিরউদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা
‘ওই মালতীলতা দোলে/ পিয়ালতরুর কোলে পুব হাওয়াতে’ অথবা ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া—/ দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী-বাওয়া।’—আমার খুব ছোটবেলায় শোনা এই গান দুটির লেখক যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা জানলাম আর একটু পরে। বেসুরো গলায় বড় ভাবি গাইতেন।
তাঁর আঁচল ধরে ছায়ার মতো থাকতাম তাঁর সঙ্গে। আমাদের শোবার ঘর থেকে পদ্মা দেখা যেত।
আমার শৈশব-কৈশোর কাটে বাংলাদেশে নয়—বলতে গেলে বাংলাদেশের হূদয়ে, একেবারে তার বুকের ভেতরে। সেই বাংলায় ছিল বিস্তীর্ণ নদী, যেখানে সারা বছর অফুরন্ত পানি। বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত অবারিত সবুজের সমারোহ: আউশ-আমন ধানের খেত, পাট, তিল, কাউন প্রভৃতি। পৃথিবীর সবচেয়ে অপরূপ সবুজ ছিল অথৈ পানিতে ভাসা আমন ধানের খেত। এখন কৃষকের চাষাভ্যাস বদলে গেছে। ইরি-বোরো শব্দের সঙ্গে পরিচয় ষাটের দশকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম সীমাহীন পদ্মা। তাতে অগণিত নৌকা: ছোট ছোট জেলে ডিঙি থেকে প্রকাণ্ড ছান্দি নৌকা। তাতে অমল ধবল পাল শুধু নয়, নানা রঙের পাল, তাতে বিচিত্র তালি। বাংলাদেশ থেকে সেই দৃশ্য আজ বিলীন হয়ে গেছে।
রেডিওতে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শোনা শুরু করি মধ্য-পঞ্চাশ থেকে। আকাশবাণীতে অনেক বিখ্যাত শিল্পী, ঢাকা বেতার কেন্দ্রের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হাতেগোনা। তাঁদের মধ্যে আফসারী খানম, বিলকিস নাসিরউদ্দিন, সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মালেকা আজিম খান, জাহানারা ইসলাম, হুসনা বানু খানমদের গান আমাদের মুগ্ধ করত। আবদুল আহাদ ও কলিম শরাফী ছিলেন বহু রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর শিক্ষক। তাঁদের গাওয়া গানের আবেদন ছিল অন্য রকম।
পাকিস্তানি আমলে যাঁরা পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা করেছেন তাঁদের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। সাবলীলভাবে রবীন্দ্রচর্চার জন্য সেটি ছিল প্রতিকূল পরিবেশ। সেই পরিবেশে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বিলকিস নাসিরউদ্দিন তাঁর রবীন্দ্রসংগীত সাধনা অব্যাহত রাখেন।
গত কিছুকাল যাবৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করে পঞ্চাশের দশকের কিছু কথা শুনব বলে ভাবছিলাম। সেকালের আরেক খ্যাতিমান রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মালেকা আজিম খানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাও বলি। খবর পাই তিনি খুবই অসুস্থ। একদিন শুনলাম তিনি হাসপাতালে আছেন। বেশি বয়সে নানা অসুবিধা নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে যান, আবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। বিলকিস নাসিরউদ্দিন এবার ফেরেননি। ১ সেপ্টেম্বর রাতে আরেক রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী নাসরীন চৌধুরী, নজরুলের স্নেহধন্য লেখক-রাজনীতিক হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর মেয়ে, আমাকে ফোনে জানান যে বিকেলে বিলকিস আপা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
বিলকিস নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বহু বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক আমার অগ্রজপ্রতিম প্রয়াত আমান-উজ জামান খানের (বেবী জামান) ফ্ল্যাটে। সেখানে বেবী ভাইয়ের অগ্রজ আশরাফ-উজ জামান খান ও আমীর-উজ জামানও ছিলেন। গত ২০-২২ বছরে তাঁর সঙ্গে আর সামনাসামনি কথা হয়নি। আত্মপ্রচারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। আড়ালে থাকতে পছন্দ করতেন। তবে এটাও ঠিক, তাঁর অবদানের উপযুক্ত স্বীকৃতি আমরা দিইনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের সময় অল্পের জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। অতিকষ্টে তিনি এসেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আমি তখন কী এক দাবিতে মানববন্ধন করতে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ছিলাম। মালেকা আপার কাছে পরে শুনলাম তাঁর শরীর খুবই দুর্বল। অবশ্য বয়সও হয়েছিল। আশির অনেক ওপরে।
বিলকিস আপা দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলেন। তাঁর মা-বাবার পরিবার ও শ্বশুর পরিবার দুই-ই ছিল সংস্কৃতিমান। নিজে ছিলেন মেধাবী। পড়াশোনায় অসামান্য উৎসাহ ছিল। ১৯৪৭-এর আগে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বাবার কর্মস্থলগুলোতে ছিলেন। লেখাপড়া করেছেন কলকাতা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে, লেডি ব্রেবোর্স কলেজে এবং দার্জিলিং ও লোরেটো কনভেন্টে। ইংরেজি ভাষায় ভালো দখল ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে বহিরাগত প্রার্থী হিসেবে বিএ পাস করেন ডিসটিংশনসহ। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং শিক্ষায়ও মাস্টার্স করেন। যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেন। শিক্ষকতায় ছিলেন আজীবন। শেষ জীবনে আবুধাবিতে ছোট ছেলের কাছে ছিলেন অনেক দিন।
স্বামী নাসিরউদ্দিন সাহেব ছিলেন বহুজাতিক কোম্পানি বার্ডস বাংলাদেশের বড়কর্তা। শিল্প-সংস্কৃতিতে অসামান্য আগ্রহ। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। পঞ্চাশের দশকে কলিম শরাফী কয়েক বছর চট্টগ্রাম খাস্তগীর স্কুলে গানের শিক্ষক ছিলেন। কলকাতা থেকে আসার পর কলিম শরাফীর কাছে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের তালিম নেন।
ছোটবেলায় রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড শুনে গান শিখেছেন। বিভিন্ন শিক্ষকের কাছেও তালিম নিয়েছেন। কলকাতায় থাকার সময় তিনি গান শিখেছেন সন্তোষ সেনগুপ্তের কাছে।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে যোগ দেন। গান গাইতে মাসে অন্তত দুবার চাটগাঁ থেকে ঢাকা আসতে হতো। মালেকা আজিম খানও চট্টগ্রামের মানুষ। জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে তাঁদের যাতায়াত ভাতাও দেওয়া হতো।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের গান কিছু বাংলাদেশ বেতারে সংরক্ষিত আছে কি না জানি না। থাকা উচিত। যদি না থাকে, তা হবে চরম বেদনাদায়ক। যদি থাকে, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততমবর্ষে এবং বিলকিস নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর সেকালে গাওয়া গান পরিবেশন করতে অনুরোধ জানাই।
অতি সামান্য মানুষের মৃত্যুতে আমাদের শাসকশ্রেণী ও সংস্কৃতিজগতের কর্তারা শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। বিলকিস নাসিরউদ্দিনের ক্ষেত্রে তা দেখা গেল না। অথচ এবারই জানা গেল, বাংলাদেশের উপজেলা কর্মকর্তা ও দলীয় কর্মীরা পর্যন্ত গভীর রবীন্দ্রপ্রেমিক।
বিভাগোত্তর সময়ে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রসংগীতচর্চা, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের রবীন্দ্রসংগীত সাধনার ইতিহাসে বিলকিস নাসিরউদ্দিন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ
No comments