বিশেষ সাক্ষা ৎ কার-আমরা চাই সব বাধা উঠে যাক by মানিক সরকার
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে অন্যদের মধ্যে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ কুমার গগৈ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময়ে প্রথম আলো তাঁদের মুখোমুখি হয়। আলাপচারিতায় উঠে আসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া, বাণিজ্য বৈষম্যসহ নানা বিষয়।
সাক্ষা ৎ কার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মশিউল আলম
মানিক সরকারের জন্ম ১৯৪৯ সালে, দক্ষিণ ত্রিপুরার রাধাকিশোরপুরে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ষষ্ঠবার ত্রিপুরায় সরকার গঠন করেছে। তিনি মার্ক্সবাদী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) পলিটব্যুরোর সদস্য। ছাত্রজীবনে তিনি সিপিএম-সমর্থিত সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও রাজ্য সম্পাদক ছিলেন।
প্রথম আলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকালে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো, তা এড়ানো যেত কি না?
মানিক সরকার দেখুন, আমি একটি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করি। এখান থেকে সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে বলার সুযোগ খুব কম। আমার মনে হয়, এড়ানোর সুযোগ থাকলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা নিত। আমি বলব, এটিও একটি শিক্ষা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলের ভাষণে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কারও স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে রকম একটি সমাধানে যেতে হবে। আমিও তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করি। দুই রাষ্ট্রের মানুষই যখন সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী, তখন সমাধান না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতির বন্ধন, তা-ই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে, সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।
প্রথম আলো সব টানাপোড়েন পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কটি সামনে এগোবে বলে বিরাট আশা জেগেছিল মানুষের মনে। এখন কি বিষয়টি পিছিয়ে গেল না?
মানিক সরকার পিছিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর এবং এবারও দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি হলো, তা সামনে এগোনোরই ইঙ্গিত। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই এবং তার বাস্তবায়ন সম্পর্ককে দৃঢ় করে, আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। যেসব বিষয়ে সমঝোতা বা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে দু্-একটি না হলেও অন্যান্য বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা গেছে। যেটি হলো না, তা নিয়ে হতাশ না হয়ে যেটি হলো, তা নিয়েই এগোতে হবে। আমরা আশা করছি, তিস্তার ব্যাপারেও একটা সুরাহা হয়ে যাবে।
প্রথম আলো শেষ মুহূর্তে এসে পশ্চিমবঙ্গ কেন আপত্তি করল?
মানিক সরকার আমাদের দেশে পানির বিষয়টি রাজ্য সরকারের আওতাধীন। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষ থেকে কেন আপত্তি করা হয়েছে, আমি তা বলতে পারব না। তারা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমস্যাটি তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার পরও বলেছেন, সব পক্ষের স্বার্থরক্ষা করেই সমাধান খুঁজে বের করা হবে। মানুষের জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসে, তাই বলে হতাশ হব কেন? আমরা অনুরোধ করব, একটু অপেক্ষা করুন। আমার ধারণা, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে পারবে?
প্রথম আলো তিস্তার কারণে ফেনী নদীর পানি বণ্টনও আটকে গেল। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মানিক সরকার চুক্তি হয়ে গেলে ভালো হতো। হয়নি। আমরা অপেক্ষা করব। ফেনীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল না।
প্রথম আলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত কি কেন্দ্রীয় সরকারকে বিব্রত করল না?
মানিক সরকার এ ব্যাপারে আমার দিক থেকে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনুরোধ করব, একটু অপেক্ষা করুন। আশা করছি দ্রুত এর সমাধান হবে।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি সই না হওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? বিশেষ করে, সফরসঙ্গী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে?
মানিক সরকার আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। দিল্লি থেকে আসার পথে বিমানে কথা হয়েছে। দুপুরে খাবারের সময়ও কথা হয়েছে।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ ট্রানজিট-সংক্রান্ত সম্মতিপত্রে সই করেনি। সে ক্ষেত্রে আপনারাও ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কি না?
মানিক সরকার আমরা বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চাইছি না। আমরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এসেছি। কিন্তু বিষয়টি দুটো রাষ্ট্রের। রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়েই সুরাহা হয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার রূপরেখা তৈরি হয়েছে। সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিত্তিতে আমরা সামনে এগিয়ে যাব।
প্রথম আলো দুটি দেশের মধ্যে যখন কোনো বিষয় নিয়ে চুক্তি হয়, তার পেছনে পটভূমি থাকে, দফায় দফায় আলোচনা হয়, দর-কষাকষি হয়। সবকিছু শেষ করেই কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে দুই পক্ষ সিদ্ধান্তে এসেছিল?
মানিক সরকার যখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী, তখন পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছেন। তারপর সোলস যখন মন্ত্রী ছিলেন, তিনি এসেছেন। আমাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কর্মকর্তা পর্যায়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। এবার তিস্তার চুক্তি হয়নি বলে সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেল বলা যাবে না। মনে করার কারণ নেই যে হঠা ৎ করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং হঠা ৎ করেই তা বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, তিস্তার ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো আছে, তা দূর করে চুক্তি হবে।
প্রথম আলো একজন সফরসঙ্গী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মানিক সরকার মূল্যায়ন করবেন আপনারা। তবে আমি বলব, তিস্তা চুক্তি না হলেও অনেক চুক্তি ও প্রটোকল সই হলো। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ঠিক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর আর বিষয়টি এগোয়নি। এবার বাস্তবায়িত হবে আশা করি।
তা ছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা। ভারত সরকার এবার ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্তসুবিধা দিয়েছে। এটি এখানে সীমিত থাকবে না, আরও সম্প্রসারিত হবে। এই অর্জনকে ছোট করে দেখার কারণ নেই। যতটুকু করা গেছে, সেখান থেকেই এগোতে হবে এবং যেটি করা গেল না, সে জন্য হতাশ হব না।
প্রথম আলো ত্রিপুরা বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী রাজ্য। ইতিমধ্যে ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও বাণিজ্য বেড়েছে। এর বাইরে আর কোন খাতে সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে?
মানিক সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। এ সম্পর্ক তো আর্থিক হিসাব-নিকাশ কষে পরিমাপ করা যাবে না। সকালে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠক ছিল। দেখলাম, দুই দেশের লোকজনই ইংরেজিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি অনুমতি নিয়ে বাংলায় বললাম।
সেই বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। আমি সমর্থন করলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে যোগাযোগও বাড়বে। বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তারা ত্রিপুরায় শিল্প স্থাপন করতে চান। আমরাও তাঁদের স্বাগত জানিয়াছি। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আইনগত কিছু সমস্যা আছে। সেটি তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। তিনিও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।
ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশ বিদ্যু ৎ পেতে পারে। আমি বলেছি, পলাটানা বিদ্যু ৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সেখানে যে বিদ্যু ৎ উ ৎ পাদিত হবে, তার মধ্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যু ৎ রাজ্য সরকার পাবে। আমরা সেই ২০০ মেগাওয়াট থেকে ১০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু সে জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
প্রথম আলো ৪৬টি পণ্যের ওপর শুল্ক-সুবিধা ঘোষণা করেছে ভারত। কিন্তু অশুল্ক বাধা দূর না হলে এর সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
মানিক সরকার আমরা তো চাই, সব বাধা উঠে যাক। কিন্তু সবকিছু আমাদের ওপর নির্ভর করে না। তবে এ ক্ষেত্রে ত্রিপুরা সব সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করে গেছে। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল ও নর্থ ইস্টার্ন রিজন কাউন্সিলের বৈঠকে আমি স্পষ্ট করে বলেছি, পরিকল্পনা কমিশনে বলেছি—বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা বাড়াতে হবে। এবং সে জন্য সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় বছরে আমদানি হয় ২৫৭ কোটি রুপির পণ্য, আর রপ্তানি হয় এক কোটি ৭৬ লাখ রুপির পণ্য।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভিসা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। আমরা কেন্দ্রকে বলেছি, কেন তোমরা এসব করছ? বড় ভাইসুলভ মনোভাব পরিত্যাগ না করলে সুসম্পর্ক হবে না।
প্রথম আলো ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্তসুবিধা দেওয়ায় ত্রিপুরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্য কতটা লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন। ট্রানজিট-সুবিধা পেলে?
মানিক সরকার এখনই বলা যাবে না। শুরু হলেই বোঝা যাবে। ট্রানজিট-সুবিধা হলে আমরা তো লাভবান হবই। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আমরা বহু সামগ্রী মূল ভূখণ্ড থেকে নিয়ে আসি, যে মানের পণ্য বাংলাদেশেও আছে। তাহলে আমরা ৫০০ কিলোমিটার সড়ক দিয়ে সেই পণ্য কেন আনব? বাংলাদেশ থেকে নিলে দাম অনেক কম হবে।
প্রথম আলো ট্রানজিটের জন্য ভারত খুব কম মাশুল দিতে চাইছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তারা যে প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
মানিক সরকার বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তারা এই সুবিধা কেন দেবে? ভারত যদি বন্ধুত্বই চায়, তাহলে এমন শর্ত কেন চাপিয়ে দেবে, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের ধারণা, ভারত বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়েই এগুলো চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য হবে পারস্পরিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে।
প্রথম আলো একসময় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। এখন একমাত্র ত্রিপুরায় আছে। কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?
মানিক সরকার দেখুন, ভোটের হিসাব বা কোন রাজ্যে বামফ্রন্ট কতটি আসন পেয়েছে, তা দিয়ে তো শক্তি নিরূপিত হয় না। আমরা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলেছি। আগেও আমাদের আদর্শের সংগ্রাম করতে হয়েছে, এখনো করছি।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মানিক সরকার ধন্যবাদ।
মানিক সরকারের জন্ম ১৯৪৯ সালে, দক্ষিণ ত্রিপুরার রাধাকিশোরপুরে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ষষ্ঠবার ত্রিপুরায় সরকার গঠন করেছে। তিনি মার্ক্সবাদী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) পলিটব্যুরোর সদস্য। ছাত্রজীবনে তিনি সিপিএম-সমর্থিত সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও রাজ্য সম্পাদক ছিলেন।
প্রথম আলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকালে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো, তা এড়ানো যেত কি না?
মানিক সরকার দেখুন, আমি একটি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করি। এখান থেকে সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে বলার সুযোগ খুব কম। আমার মনে হয়, এড়ানোর সুযোগ থাকলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা নিত। আমি বলব, এটিও একটি শিক্ষা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলের ভাষণে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে কারও স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে রকম একটি সমাধানে যেতে হবে। আমিও তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করি। দুই রাষ্ট্রের মানুষই যখন সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী, তখন সমাধান না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতির বন্ধন, তা-ই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে, সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।
প্রথম আলো সব টানাপোড়েন পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কটি সামনে এগোবে বলে বিরাট আশা জেগেছিল মানুষের মনে। এখন কি বিষয়টি পিছিয়ে গেল না?
মানিক সরকার পিছিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর এবং এবারও দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি হলো, তা সামনে এগোনোরই ইঙ্গিত। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই এবং তার বাস্তবায়ন সম্পর্ককে দৃঢ় করে, আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। যেসব বিষয়ে সমঝোতা বা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে দু্-একটি না হলেও অন্যান্য বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা গেছে। যেটি হলো না, তা নিয়ে হতাশ না হয়ে যেটি হলো, তা নিয়েই এগোতে হবে। আমরা আশা করছি, তিস্তার ব্যাপারেও একটা সুরাহা হয়ে যাবে।
প্রথম আলো শেষ মুহূর্তে এসে পশ্চিমবঙ্গ কেন আপত্তি করল?
মানিক সরকার আমাদের দেশে পানির বিষয়টি রাজ্য সরকারের আওতাধীন। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষ থেকে কেন আপত্তি করা হয়েছে, আমি তা বলতে পারব না। তারা হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সমস্যাটি তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তার পরও বলেছেন, সব পক্ষের স্বার্থরক্ষা করেই সমাধান খুঁজে বের করা হবে। মানুষের জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসে, তাই বলে হতাশ হব কেন? আমরা অনুরোধ করব, একটু অপেক্ষা করুন। আমার ধারণা, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে পারবে?
প্রথম আলো তিস্তার কারণে ফেনী নদীর পানি বণ্টনও আটকে গেল। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
মানিক সরকার চুক্তি হয়ে গেলে ভালো হতো। হয়নি। আমরা অপেক্ষা করব। ফেনীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল না।
প্রথম আলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত কি কেন্দ্রীয় সরকারকে বিব্রত করল না?
মানিক সরকার এ ব্যাপারে আমার দিক থেকে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনুরোধ করব, একটু অপেক্ষা করুন। আশা করছি দ্রুত এর সমাধান হবে।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি সই না হওয়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? বিশেষ করে, সফরসঙ্গী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে?
মানিক সরকার আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিশেষ করে, আমাদের রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। দিল্লি থেকে আসার পথে বিমানে কথা হয়েছে। দুপুরে খাবারের সময়ও কথা হয়েছে।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ ট্রানজিট-সংক্রান্ত সম্মতিপত্রে সই করেনি। সে ক্ষেত্রে আপনারাও ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কি না?
মানিক সরকার আমরা বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চাইছি না। আমরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এসেছি। কিন্তু বিষয়টি দুটো রাষ্ট্রের। রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়েই সুরাহা হয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার রূপরেখা তৈরি হয়েছে। সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিত্তিতে আমরা সামনে এগিয়ে যাব।
প্রথম আলো দুটি দেশের মধ্যে যখন কোনো বিষয় নিয়ে চুক্তি হয়, তার পেছনে পটভূমি থাকে, দফায় দফায় আলোচনা হয়, দর-কষাকষি হয়। সবকিছু শেষ করেই কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে দুই পক্ষ সিদ্ধান্তে এসেছিল?
মানিক সরকার যখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কেন্দ্রীয় পানিসম্পদমন্ত্রী, তখন পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছেন। তারপর সোলস যখন মন্ত্রী ছিলেন, তিনি এসেছেন। আমাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। কর্মকর্তা পর্যায়ে বহুবার আলোচনা হয়েছে। এবার তিস্তার চুক্তি হয়নি বলে সবকিছু ব্যর্থ হয়ে গেল বলা যাবে না। মনে করার কারণ নেই যে হঠা ৎ করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং হঠা ৎ করেই তা বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, তিস্তার ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো আছে, তা দূর করে চুক্তি হবে।
প্রথম আলো একজন সফরসঙ্গী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মানিক সরকার মূল্যায়ন করবেন আপনারা। তবে আমি বলব, তিস্তা চুক্তি না হলেও অনেক চুক্তি ও প্রটোকল সই হলো। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে চুক্তি হয়েছিল ঠিক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর আর বিষয়টি এগোয়নি। এবার বাস্তবায়িত হবে আশা করি।
তা ছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা। ভারত সরকার এবার ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্তসুবিধা দিয়েছে। এটি এখানে সীমিত থাকবে না, আরও সম্প্রসারিত হবে। এই অর্জনকে ছোট করে দেখার কারণ নেই। যতটুকু করা গেছে, সেখান থেকেই এগোতে হবে এবং যেটি করা গেল না, সে জন্য হতাশ হব না।
প্রথম আলো ত্রিপুরা বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী রাজ্য। ইতিমধ্যে ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও বাণিজ্য বেড়েছে। এর বাইরে আর কোন খাতে সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে?
মানিক সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। এ সম্পর্ক তো আর্থিক হিসাব-নিকাশ কষে পরিমাপ করা যাবে না। সকালে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠক ছিল। দেখলাম, দুই দেশের লোকজনই ইংরেজিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি অনুমতি নিয়ে বাংলায় বললাম।
সেই বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। আমি সমর্থন করলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে যোগাযোগও বাড়বে। বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তারা ত্রিপুরায় শিল্প স্থাপন করতে চান। আমরাও তাঁদের স্বাগত জানিয়াছি। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আইনগত কিছু সমস্যা আছে। সেটি তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। তিনিও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।
ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশ বিদ্যু ৎ পেতে পারে। আমি বলেছি, পলাটানা বিদ্যু ৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সেখানে যে বিদ্যু ৎ উ ৎ পাদিত হবে, তার মধ্যে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যু ৎ রাজ্য সরকার পাবে। আমরা সেই ২০০ মেগাওয়াট থেকে ১০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশকে দেওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু সে জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
প্রথম আলো ৪৬টি পণ্যের ওপর শুল্ক-সুবিধা ঘোষণা করেছে ভারত। কিন্তু অশুল্ক বাধা দূর না হলে এর সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
মানিক সরকার আমরা তো চাই, সব বাধা উঠে যাক। কিন্তু সবকিছু আমাদের ওপর নির্ভর করে না। তবে এ ক্ষেত্রে ত্রিপুরা সব সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করে গেছে। ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল ও নর্থ ইস্টার্ন রিজন কাউন্সিলের বৈঠকে আমি স্পষ্ট করে বলেছি, পরিকল্পনা কমিশনে বলেছি—বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসা বাড়াতে হবে। এবং সে জন্য সব ধরনের অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় বছরে আমদানি হয় ২৫৭ কোটি রুপির পণ্য, আর রপ্তানি হয় এক কোটি ৭৬ লাখ রুপির পণ্য।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভিসা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। আমরা কেন্দ্রকে বলেছি, কেন তোমরা এসব করছ? বড় ভাইসুলভ মনোভাব পরিত্যাগ না করলে সুসম্পর্ক হবে না।
প্রথম আলো ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্তসুবিধা দেওয়ায় ত্রিপুরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্য কতটা লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন। ট্রানজিট-সুবিধা পেলে?
মানিক সরকার এখনই বলা যাবে না। শুরু হলেই বোঝা যাবে। ট্রানজিট-সুবিধা হলে আমরা তো লাভবান হবই। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আমরা বহু সামগ্রী মূল ভূখণ্ড থেকে নিয়ে আসি, যে মানের পণ্য বাংলাদেশেও আছে। তাহলে আমরা ৫০০ কিলোমিটার সড়ক দিয়ে সেই পণ্য কেন আনব? বাংলাদেশ থেকে নিলে দাম অনেক কম হবে।
প্রথম আলো ট্রানজিটের জন্য ভারত খুব কম মাশুল দিতে চাইছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তারা যে প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
মানিক সরকার বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তারা এই সুবিধা কেন দেবে? ভারত যদি বন্ধুত্বই চায়, তাহলে এমন শর্ত কেন চাপিয়ে দেবে, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের ধারণা, ভারত বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়েই এগুলো চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য হবে পারস্পরিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে।
প্রথম আলো একসময় ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ছিল। এখন একমাত্র ত্রিপুরায় আছে। কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?
মানিক সরকার দেখুন, ভোটের হিসাব বা কোন রাজ্যে বামফ্রন্ট কতটি আসন পেয়েছে, তা দিয়ে তো শক্তি নিরূপিত হয় না। আমরা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলেছি। আগেও আমাদের আদর্শের সংগ্রাম করতে হয়েছে, এখনো করছি।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মানিক সরকার ধন্যবাদ।
No comments