বিশেষ সাক্ষা ৎ কার-বাংলাদেশের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ by তরুণ কুমার গগৈ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে অন্যদের মধ্যে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ কুমার গগৈ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময়ে প্রথম আলো তাঁদের মুখোমুখি হয়। আলাপচারিতায় উঠে আসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া, বাণিজ্য বৈষম্যসহ নানা বিষয়।
সাক্ষা ৎ কার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মশিউল আলম
ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ কুমার গগৈয়ের জন্ম আসামের জোরহাট জেলায় ১৯৩৬ সালে। কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি লোকসভার জোরহাট নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৭১ সালে। ছয়বার লোকসভার সদস্য গগৈ আসামের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তৃতীয় মেয়াদে। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য দপ্তরেরও মন্ত্রী ছিলেন।
প্রথম আলো প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে, ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এবং আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী হিসেবে এই সফর সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
তরুণ কুমার গগৈ শুভসূচনা—দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন এক দিক উন্মোচন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগেও ভালো ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ আগ্রহে বাংলাদেশ সব রকমের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চেয়েছেন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো করতে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তাঁর ভারত সফরের পর থেকে সুসম্পর্কের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। তিনি দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়াতে চান, যেন উভয় দেশের মানুষের দারিদ্র্য, বেকারত্বসহ অনেক সমস্যা লাঘব করা যায়। দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হলে মানুষ উপকৃত হবে, উভয় পক্ষের উপকার হবে। এ কারণেই আগ্রহটা বেশি। এই সফরে এসে আমার যেটা মনে হলো, উভয় প্রধানমন্ত্রী, উভয় সরকারই সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী।
প্রথম আলো কিন্তু সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে ভারতের আন্তরিক আগ্রহ আছে, বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ তো পাওয়া গেল না। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল; অন্যদিকে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার সম্মতিপত্রে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করার কথা ছিল। কোনোটাই হলো না।
তরুণ কুমার গগৈ তিস্তা চুক্তি গতকাল হয়নি, কিন্তু আমি এখনই এটাকে ব্যর্থতা বলতে চাই না। সমস্যা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যটি শেষ মুহূর্তে আপত্তি জানিয়েছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান নেই, তা তো নয়। ভারত একটি ফেডারেল-ব্যবস্থার দেশ, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, রাজ্যগুলোরও সম্মতির প্রয়োজন হয়। তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তো বাংলাদেশকে বলে দেয়নি যে এই কারণে তিস্তা চুক্তি হবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন। পশ্চিমবঙ্গের সম্মতি আদায় করেই ভবিষ্যতে এই চুক্তি হবে। এখনই এটা নিয়ে হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। আমরাও আশা করেছিলাম, ট্রানজিট পাব। কিন্তু হলো না।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণেই ট্রানজিট হলো না। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য ভাগ না পেলে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?
তরুণ কুমার গগৈ বিষয়টি জেদাজেদির নয়; আমি এটিকে জটিল করে দেখতে চাই না। একটা বাড়ির মধ্যেই সমস্যা থাকে, দুটো দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কথা হচ্ছে, সবাই মিলে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রথম আলো আমরা খবর পেলাম, আপনি এই সফরে যোগ দিয়েছেন বলে আসামে কিছু মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে। তারা মমতা ব্যানার্জির অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, আপনার অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।
তরুণ কুমার গগৈ করেছে, আমি জানি। আমি আসার আগেই তারা বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এসেছি। কারণ আমি মনে করি, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আরও বাড়ানো দরকার, সম্পর্কটাকে আরও সহযোগিতামূলক করা দরকার। তাতে আসামেরও লাভ হবে, বাংলাদেশেরও লাভ হবে, ভারতেরও লাভ হবে।
প্রথম আলো ভারতের একটি বড় সমস্যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী ত ৎ পরতা। আমাদের জানা ছিল, ভারত চায় এসব ত ৎ পরতা দমনে বাংলাদেশ ভারতকে সহযোগিতা করুক। আমরা তা করলে আমাদের দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানে ভারত এগিয়ে আসবে। আমাদের বর্তমান সরকার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা কী পেলাম?
তরুণ কুমার গগৈ সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রটোকল সই তো হলো...
প্রথম আলো সেই প্রটোকলে সময় নির্ধারণ করা হয়নি, কখন থেকে অপদখলীয় জমি ও ছিটমহলগুলো বিনিময় শুরু হবে...
তরুণ কুমার গগৈ অনেকগুলো সমস্যা আছে বেশ পুরোনো, সেই সাতচল্লিশ সাল থেকেই আছে। সেগুলো এক দিনে সমাধান হবে না, আস্তে আস্তে হবে। ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ, স্বৈরতান্ত্রিক দেশ নয়। সেখানে জনগণের মতামত নিতে হয়। জনগণকে বোঝাতে হবে, রাজি করাতে হবে। এগুলো সময়ের ব্যাপার, এক দিনের ব্যাপার নয়। পুরোনো ব্যাধির মতো অনেক সমস্যা জমে উঠেছে দীর্ঘদিনে। দুই দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক রয়েছে, সেটা বজায় থাকলে ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। যখন দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া বেড়ে যাবে, মানুষে মানুষে মেলামেশা বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য হবে, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হবে, তখন মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে যে সুসম্পর্ক থেকে উভয় পক্ষেরই লাভ হয়। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বেড়ে যাবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে, শিক্ষাদীক্ষাও বেড়ে যাবে। সে জন্য আমরা বলি, যোগাযোগ (কানেকটিভিটি) বাড়ানো খুব প্রয়োজন।
প্রথম আলো ভারতের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এখন আর বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে না। আসামের উলফা গোষ্ঠীর কয়েকজন নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। উলফাসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যে এখন ভারত সরকারের সঙ্গে আপস-সমঝোতায় আসছে, এর পেছনে বাংলাদেশেরও অবদান আছে। এ দেশের মানুষ মনে করে, এগুলো ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো করার আগ্রহের প্রমাণ। কিন্তু ভারতের দিক থেকে সেই আগ্রহের কোনো প্রমাণ তো দেখা যাচ্ছে না।
তরুণ কুমার গগৈ ভারত বাংলাদেশকে ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ঋণসুবিধার প্রস্তাব তো আছেই। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ভাগাভাগিও নিশ্চয়ই হবে, এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতেই হবে। কারণ সবাই জানে, অভিন্ন নদীগুলোর পানির ওপর দুই দেশের জনগণেরই অধিকার আছে। তবে আমার মনে হয় না, এই একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই দুই দেশের সম্পর্ক আবর্তিত হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে বাংলাদেশ ভারতকে সহযোগিতা করেছে, এটা তো আমরা স্বীকার করছি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেনও যে এ জন্য আমরা বাংলাদেশের কাজে কৃতজ্ঞ। তবে এটা নয় যে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলেই উলফা বাধ্য হয়ে আলোচনায় এসেছে।
প্রথম আলো আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য যা করেছে তা বড় কিছু নয়?
তরুণ কুমার গগৈ না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশ অবশ্যই এই ক্ষেত্রে ভারতকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছে, সে জন্য আমরা বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে উলফার প্রভাব এমনিতেই কমে গেছে। শুধু উলফা নয়, আরও কিছু কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলোচনার পথে আসছে। আবার কিছু কিছু গোষ্ঠী আসছে না, ত ৎ পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেত ভুটানের কাছ থেকে। ভুটান সেটা বন্ধ করে দিলে তারা এল বাংলাদেশে। এখন বাংলাদেশে সুবিধা করতে না পারলে যাবে মিয়ানমার। কিছু কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ থেকেই যাচ্ছে।
প্রথম আলো সফর শেষ করে আজ আপনারা চলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
তরুণ কুমার গগৈ বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বন্ধুব ৎ সল, অতিথিপরায়ণ। আসাম তো বাংলাদেশ থেকে বেশি দূরে নয়; সিলেট তো একসময় আসামেরই অংশ ছিল। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবকিছুই খুব কাছের। আগে আমাদের আসা-যাওয়া, মেলামেশা অনেক বেশি ছিল। আসাম থেকে কত লোক আসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। ঐতিহাসিক কারণে ভারত বিভাগের পর থেকে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন আমরা চাই দূরত্বটা কমিয়ে আনতে। আর এই দূরত্ব কমাতে হলে সরকারি পর্যায়েই শুধু নয়, আমি বলি কানেকটিভিটি অব মাইন্ডও প্রয়োজন। শুধু সরকারে সরকারে যোগাযোগ হলে তো হবে না, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। রাস্তাঘাট হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য হোক, শিক্ষাদীক্ষার আদান-প্রদান হোক, তাহলেই আমাদের বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি, ভালোবাসা আরও বেড়ে যাবে। আমাদের উন্নতি হবে, উভয় দেশে সমৃদ্ধি আসবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
তরুণ কুমার গগৈ ধন্যবাদ।
ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ কুমার গগৈয়ের জন্ম আসামের জোরহাট জেলায় ১৯৩৬ সালে। কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি লোকসভার জোরহাট নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৭১ সালে। ছয়বার লোকসভার সদস্য গগৈ আসামের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তৃতীয় মেয়াদে। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য দপ্তরেরও মন্ত্রী ছিলেন।
প্রথম আলো প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে, ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এবং আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী হিসেবে এই সফর সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
তরুণ কুমার গগৈ শুভসূচনা—দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন এক দিক উন্মোচন। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগেও ভালো ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ আগ্রহে বাংলাদেশ সব রকমের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চেয়েছেন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো করতে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তাঁর ভারত সফরের পর থেকে সুসম্পর্কের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। তিনি দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক বাড়াতে চান, যেন উভয় দেশের মানুষের দারিদ্র্য, বেকারত্বসহ অনেক সমস্যা লাঘব করা যায়। দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হলে মানুষ উপকৃত হবে, উভয় পক্ষের উপকার হবে। এ কারণেই আগ্রহটা বেশি। এই সফরে এসে আমার যেটা মনে হলো, উভয় প্রধানমন্ত্রী, উভয় সরকারই সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে আগ্রহী।
প্রথম আলো কিন্তু সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যে ভারতের আন্তরিক আগ্রহ আছে, বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ তো পাওয়া গেল না। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল; অন্যদিকে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার সম্মতিপত্রে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করার কথা ছিল। কোনোটাই হলো না।
তরুণ কুমার গগৈ তিস্তা চুক্তি গতকাল হয়নি, কিন্তু আমি এখনই এটাকে ব্যর্থতা বলতে চাই না। সমস্যা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যটি শেষ মুহূর্তে আপত্তি জানিয়েছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান নেই, তা তো নয়। ভারত একটি ফেডারেল-ব্যবস্থার দেশ, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, রাজ্যগুলোরও সম্মতির প্রয়োজন হয়। তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তো বাংলাদেশকে বলে দেয়নি যে এই কারণে তিস্তা চুক্তি হবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন। পশ্চিমবঙ্গের সম্মতি আদায় করেই ভবিষ্যতে এই চুক্তি হবে। এখনই এটা নিয়ে হতাশ হওয়া ঠিক হবে না। আমরাও আশা করেছিলাম, ট্রানজিট পাব। কিন্তু হলো না।
প্রথম আলো তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কারণেই ট্রানজিট হলো না। বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য ভাগ না পেলে ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?
তরুণ কুমার গগৈ বিষয়টি জেদাজেদির নয়; আমি এটিকে জটিল করে দেখতে চাই না। একটা বাড়ির মধ্যেই সমস্যা থাকে, দুটো দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কথা হচ্ছে, সবাই মিলে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রথম আলো আমরা খবর পেলাম, আপনি এই সফরে যোগ দিয়েছেন বলে আসামে কিছু মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে। তারা মমতা ব্যানার্জির অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, আপনার অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।
তরুণ কুমার গগৈ করেছে, আমি জানি। আমি আসার আগেই তারা বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এসেছি। কারণ আমি মনে করি, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আরও বাড়ানো দরকার, সম্পর্কটাকে আরও সহযোগিতামূলক করা দরকার। তাতে আসামেরও লাভ হবে, বাংলাদেশেরও লাভ হবে, ভারতেরও লাভ হবে।
প্রথম আলো ভারতের একটি বড় সমস্যা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী ত ৎ পরতা। আমাদের জানা ছিল, ভারত চায় এসব ত ৎ পরতা দমনে বাংলাদেশ ভারতকে সহযোগিতা করুক। আমরা তা করলে আমাদের দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানে ভারত এগিয়ে আসবে। আমাদের বর্তমান সরকার ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা কী পেলাম?
তরুণ কুমার গগৈ সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রটোকল সই তো হলো...
প্রথম আলো সেই প্রটোকলে সময় নির্ধারণ করা হয়নি, কখন থেকে অপদখলীয় জমি ও ছিটমহলগুলো বিনিময় শুরু হবে...
তরুণ কুমার গগৈ অনেকগুলো সমস্যা আছে বেশ পুরোনো, সেই সাতচল্লিশ সাল থেকেই আছে। সেগুলো এক দিনে সমাধান হবে না, আস্তে আস্তে হবে। ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ, স্বৈরতান্ত্রিক দেশ নয়। সেখানে জনগণের মতামত নিতে হয়। জনগণকে বোঝাতে হবে, রাজি করাতে হবে। এগুলো সময়ের ব্যাপার, এক দিনের ব্যাপার নয়। পুরোনো ব্যাধির মতো অনেক সমস্যা জমে উঠেছে দীর্ঘদিনে। দুই দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক রয়েছে, সেটা বজায় থাকলে ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। যখন দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া বেড়ে যাবে, মানুষে মানুষে মেলামেশা বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য হবে, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হবে, তখন মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে যে সুসম্পর্ক থেকে উভয় পক্ষেরই লাভ হয়। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বেড়ে যাবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে, শিক্ষাদীক্ষাও বেড়ে যাবে। সে জন্য আমরা বলি, যোগাযোগ (কানেকটিভিটি) বাড়ানো খুব প্রয়োজন।
প্রথম আলো ভারতের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এখন আর বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে না। আসামের উলফা গোষ্ঠীর কয়েকজন নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। উলফাসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যে এখন ভারত সরকারের সঙ্গে আপস-সমঝোতায় আসছে, এর পেছনে বাংলাদেশেরও অবদান আছে। এ দেশের মানুষ মনে করে, এগুলো ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো করার আগ্রহের প্রমাণ। কিন্তু ভারতের দিক থেকে সেই আগ্রহের কোনো প্রমাণ তো দেখা যাচ্ছে না।
তরুণ কুমার গগৈ ভারত বাংলাদেশকে ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ঋণসুবিধার প্রস্তাব তো আছেই। অভিন্ন নদীগুলোর পানির ভাগাভাগিও নিশ্চয়ই হবে, এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতেই হবে। কারণ সবাই জানে, অভিন্ন নদীগুলোর পানির ওপর দুই দেশের জনগণেরই অধিকার আছে। তবে আমার মনে হয় না, এই একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই দুই দেশের সম্পর্ক আবর্তিত হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে বাংলাদেশ ভারতকে সহযোগিতা করেছে, এটা তো আমরা স্বীকার করছি এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেনও যে এ জন্য আমরা বাংলাদেশের কাজে কৃতজ্ঞ। তবে এটা নয় যে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলেই উলফা বাধ্য হয়ে আলোচনায় এসেছে।
প্রথম আলো আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশ ভারতের জন্য যা করেছে তা বড় কিছু নয়?
তরুণ কুমার গগৈ না, আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি, বাংলাদেশ অবশ্যই এই ক্ষেত্রে ভারতকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছে, সে জন্য আমরা বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে উলফার প্রভাব এমনিতেই কমে গেছে। শুধু উলফা নয়, আরও কিছু কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আলোচনার পথে আসছে। আবার কিছু কিছু গোষ্ঠী আসছে না, ত ৎ পরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেত ভুটানের কাছ থেকে। ভুটান সেটা বন্ধ করে দিলে তারা এল বাংলাদেশে। এখন বাংলাদেশে সুবিধা করতে না পারলে যাবে মিয়ানমার। কিছু কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ থেকেই যাচ্ছে।
প্রথম আলো সফর শেষ করে আজ আপনারা চলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
তরুণ কুমার গগৈ বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বন্ধুব ৎ সল, অতিথিপরায়ণ। আসাম তো বাংলাদেশ থেকে বেশি দূরে নয়; সিলেট তো একসময় আসামেরই অংশ ছিল। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবকিছুই খুব কাছের। আগে আমাদের আসা-যাওয়া, মেলামেশা অনেক বেশি ছিল। আসাম থেকে কত লোক আসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। ঐতিহাসিক কারণে ভারত বিভাগের পর থেকে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন আমরা চাই দূরত্বটা কমিয়ে আনতে। আর এই দূরত্ব কমাতে হলে সরকারি পর্যায়েই শুধু নয়, আমি বলি কানেকটিভিটি অব মাইন্ডও প্রয়োজন। শুধু সরকারে সরকারে যোগাযোগ হলে তো হবে না, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। রাস্তাঘাট হোক, ব্যবসা-বাণিজ্য হোক, শিক্ষাদীক্ষার আদান-প্রদান হোক, তাহলেই আমাদের বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি, ভালোবাসা আরও বেড়ে যাবে। আমাদের উন্নতি হবে, উভয় দেশে সমৃদ্ধি আসবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
তরুণ কুমার গগৈ ধন্যবাদ।
No comments