সবাইকে নিয়ে কাজ করার মানসিকতা চাই-অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার প্রধান দায় যে নয়াদিল্লির, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণে চুক্তি থেকে সরে আসায় ভারত সরকারের সমালোচনা করেছে সে দেশের গণমাধ্যমও। মনমোহন সিং নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে দেওয়া ভাষণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন।


তবে এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার তথা নীতিনির্ধারকদের বড় শিক্ষণীয় বিষয় আছে, অবশ্য যদি তাঁরা তা মনে করেন। সফল পররাষ্ট্রনীতির প্রথম শর্ত হলো জাতীয় মতৈক্য। দ্বিতীয় কথা, কূটনৈতিক সম্পর্ক হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের। সরকার বা প্রধানমন্ত্রী সেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা সদিচ্ছা যে ফলপ্রসূ হয় না, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়া কিংবা দর-কষাকষির কাজটি করা উচিত সবার মতামতের ভিত্তিতে। তাতে সরকারে শক্তি বাড়ে ছাড়া কমে না। ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি প্রয়োজন এ কারণে যে এ নিয়ে দেশে পরস্পরবিরোধী মত রয়েছে। কূটনীতির দুটি পর্যায় আছে—একটি গোপনীয়, অন্যটি প্রকাশ্য। গোপনীয় বিষয়টি সব সময় কূটনৈতিক পর্যায়ে হয়ে থাকে। যেসব বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করলে উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব বিষয় বৃহৎ পরিসরে না আনাই শ্রেয়। কিন্তু যেসব বিষয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে দর-কষাকষিতে সরকারের অবস্থান সংহত করবে, সেসব বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়েই আলোচনা হওয়া কর্তব্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ ও গোপন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক এই আলোচনায় কয়েকজন উপদেষ্টা ও মুষ্টিমেয় সরকারি কর্মকর্তার বাইরে কাউকে রাখা হয়নি। এমনকি অনেক বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ছিল অন্ধকারে।
এ ধরনের ঘটনায় দেশের নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ, গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করার রেওয়াজ আছে। আলোচনার অর্থ এই নয় যে, তাদের মত গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের মনোভাবও জানতে পারে। মনমোহনের ঢাকা সফরের আগে ভারত সরকার সে দেশের তো বটেই, এমনকি বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেছে। অথচ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা তার প্রয়োজন বোধ করেননি। সবকিছু দু-চারজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে চুক্তি সইয়ে সক্ষম হলে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাহবা নিতেন। এখন ব্যর্থতার দায় এড়াবেন কীভাবে?
ভবিষ্যতে কেবল ভারত নয়, যেকোনো দেশের সঙ্গে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির আগে সরকার সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করবে এবং জনগণকে অন্ধকারে রাখবে না বলে আমাদের প্রত্যাশা। যেসব বিষয়ের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ জড়িত, সে বিষয়ে সরকার কী করছে, তা জানার অধিকার জনগণের আছে। গত কয়েক দিনে প্রথম আলোসহ মূলধারার গণমাধ্যমগুলো আবারও প্রমাণ করেছে, সরকার গণমাধ্যমকে যতই এড়িয়ে চলুক কিংবা অচ্ছুৎ ভাবুক, দেশের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে তারা কখনোই পিছপা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.