গেরিলা : চলচ্চিত্রে মহাকাব্য by হরিপদ দত্ত
বাঙালি মহাকাব্য লিখেছে মহাকাব্যের যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর। এর পরও বিশ্বমানের মহাকাব্যের দৃষ্টান্ত এই জাতির হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে। সাহিত্যের বাইরে বাঙালির একমাত্র মহাকাব্য হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বীরত্ব, সর্বোচ্চ ত্যাগ, মৃত্যু, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, ঈর্ষা, বীভৎসতা, শোক, বিলাপ, মানবতার বিপর্যয়, ভয়ংকর যুদ্ধ, বিজয়, স্বদেশপ্রেম, উল্লাস,
ব্যক্তিমানুষের বাইরের এবং ভেতরের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ব্যঞ্জনা পাশাপাশি কিংবা একাকার হয়ে মহাকাব্যে মহান শিল্প হয়ে ওঠে। এমনই এক জটিল রাজনৈতিক মহাকাব্য নির্মাণের সাহস দেখিয়েছেন বাঙালি চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দীন ইউসুফ। কাজটি করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রায় চার দশক পর। এই লেখাটি আসলে 'গেরিলা' চলচ্চিত্রের তাত্তি্বক আলোচনা নয়। নয় বলেই চলচ্চিত্রের ব্যাকরণিক ভাষাও এই লেখায় মিলবে না। লেখাটির অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে গেরিলার সাহিত্যিক রূপরীতির অনুসন্ধান।
যুদ্ধের প্রায় ৪০ বছর পর এমন এক সময় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে, যখন স্বপ্নভঙ্গ বাঙালির দুর্দশা অতিক্রমের চেষ্টা চলছে। দর্শকের মনে হবে, এর দৃশ্যাবলি স্মৃতিকাতরতা নয়, বরং ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালির ইতিহাসের যুদ্ধ-প্রত্নভূমি থেকে উঠে আসা বিলুপ্ত নগরী বা হারিয়ে ফেলা প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কারের সামনে হকচকিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়া। আমাদের একাত্তর আজ কেবল উত্তর প্রজন্ম নয়, পূর্ব প্রজন্মেরও স্মৃতিভ্রষ্ট প্রত্ন-ইতিহাস। এটাই নির্মম বাস্তবতা। পরিচালক আজকের দিনে ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির বৈরী দ্বন্দ্বে আর ক্ষতবিক্ষত সত্যের রক্তাক্ত ভূমিতে দাঁড়িয়ে এক সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠীকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, কোনটি সত্য, আর কোনটি মিথ্যা।
চলচ্চিত্রটির কাহিনীতে তেমন নতুনত্ব নেই। পর্দায় যা ঘটেছে, তা আমাদের ইতিহাসেরই অক্ষর আর শব্দমালা। যা নতুনত্ব, যা অভূতপূর্ব, তা হচ্ছে চলচ্চিত্রটির পরতে পরতে ব্যবহৃত চিত্রকল্প এবং ব্যঞ্জনার্থ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এমন কাব্যময়তা ইতিপূর্বে কোনো কবি (পরিচালক) নির্মাণ করেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। পর্দায় আমরা দেখব অন্ধকার রাত, প্রবল বৃষ্টিপাত, যুদ্ধের আয়োজন, পাশাপাশি ঘাতক শক্তির তৎপরতা। এই বৃষ্টির চিত্রায়ণ বেশ দীর্ঘ। আমরা জানি, বৃষ্টি হচ্ছে উর্বরতার প্রতীক, বীজের অঙ্কুরোদয়ের আয়োজন। বৃষ্টি স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে, এই বঙ্গে ভবিষ্যতে যা ঘটতে যাচ্ছে। নগরবাসীর আতঙ্ক অথচ আশা মিলেমিশে বৃষ্টির শব্দের ভেতর, ছুটন্ত গাড়ির জল ছিটানো শব্দের ভেতর আর হেডলাইটের চকিত আলোয় যে চিত্রভাষ্য তৈরি হয়, তা বড় মাপের পরিচালক ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বৃষ্টির ভেতর পানির স্রোতকে কখনো মনে হবে রক্তস্রোত, কখনো বা জ্যোৎস্নাভেজা নদীর বুক। এখানে নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি ভাসে মুক্তির স্বপ্ন।
রাস্তার পাশে বসা উলঙ্গ একটি শিশু এবং সামনে দিয়ে হত্যার জন্য ঘাতকদের নিরস্ত্র মানুষকে টেনে নেওয়া কিংবা জীবন রক্ষার কাতরতার দৃশ্যের ভেতর শিশুর কৌতূহলী দৃষ্টির চিত্রভাষ্যটি গভীর তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে, যার ব্যাখ্যা সহজ নয়। ঘাতকরা আর হত্যার জন্য বন্দি অবস্থায় মানুষ যা জানে, শিশুটি তা জানে না। এ যেন একাত্তরের বোধশূন্য বিশ্বমানবতা। 'বিলকিস' চরিত্রের আড়ালে জয়া আহসানকে আমরা দেখতে পাব জলেশ্বরী যাত্রায় ট্রেনের ভেতর। ঘাতকদের জাত-ধর্ম তল্লাশির ভেতর এক মহিলার দুর্দশার দৃশ্যে বিলকিস ঘৃণায়-ক্রোধে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে নিজ বোরকাটি উন্মোচন করে। কিন্তু এর বাইরে দর্শকের মনে হবে বিকল্প ব্যঞ্জনার কথা। বোরকাবিহীন বিলকিস বুঝি তার নিজ ধর্মীয় পরিচয় পরিত্যাগ করেছে এবং কালো অন্ধকার বন্দি গুহা থেকে মুক্তি নিয়ে স্বাধীনতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেনটি যদিও তাকে জলেশ্বরীর ট্র্যাজেডির দিকে টেনে নিচ্ছিল, বাস্তবে কিন্তু শিল্পব্যঞ্জনায় তার যাত্রা ছিল পরম মুক্তির পথে। মাঝপথে ব্রিজ ভাঙার ঘটনাটি আমাদের চিন্তাকে নাড়া দেয়। তবে কি পরিচালক দূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে?
জলেশ্বরীর জলযাত্রায় নৌকায় বসা বিলকিসের স্থির চোখের দৃষ্টি যেন এক মহাকাব্যের জগৎ। ওখানে দুশ্চিন্তার স্থির জলরাশিতে যেন লুটিয়ে পড়েছে জলেশ্বরীর ওপরের অপার-অনন্ত আকাশটা। বিলকিস যখন শুকনো মাছের আড়তে তৃষ্ণা-ক্ষুধায় কাতর হয়ে অখাদ্য খেতে গিয়ে বমি করে এবং সেই বমির শব্দ আর নায়িকার শরীরী ব্যাকরণ স্পষ্ট শনাক্ত করে, সেই মুক্তি আর স্বাধীনতার ভ্রূণ গর্ভে ধারণ করেছে। এমনই শত শত চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে এই চলচ্চিত্র মহাকাব্যে।
খুবই প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন উঠে আসতে পারে 'গেরিলা' চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের বিবেচনায়। এটাকে কি সাহিত্যের তত্ত্ব নিউ হিস্টোরিসিজম বা নব্য ইতিহাসবাদ ডিসকোর্সের কোনো না কোনো পয়েন্টে ফেলে বিবেচনা করা যায় না? এ কাজে অবশ্যই মেধাবী চলচ্চিত্র ব্যাখ্যাকারের হাত লাগবে, কাজটি জটিল বলেই। কেননা, এখানে ইতিহাস আছে দূর, নিকট-অতীতের। স্থিরচিত্রে আমরা মহান বাঙালি অতীত নেতাদের, অখণ্ড উপমহাদেশের ভাবুক-চিন্তক নেতাদের পাশাপাশি লেনিন-স্ট্যালিনের ছবিও এক ঝলক দেখতে পাই। পরিচালকের একটা সমন্বয়-চিন্তা ধরা পড়ে। জাতীয়তাবাদী নেতাদের পাশাপাশি মার্কসবাদী মহান বিশ্বনেতাদেরও তিনি আমাদের দেখান। এ কি তবে বাঙালি মানস বা জাতীয় চরিত্রের সমন্বয়পন্থী দৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত? অবশ্য এই চলচ্চিত্রে এর ব্যাখ্যা নেই। অথচ একাত্তরের যুদ্ধ তো কেবল জাতীয়তাবাদীরাই করেনি, করেছে মার্কসবাদীরাও। কেন নেই তবে ওরা?
জোর দিয়েই বলা চলে, বহুদিন পর বাঙালি দর্শক একজন ধ্রুপদী নায়িকার সাক্ষাৎ পেল। তিনি হলেন বিলকিসের প্রতিকল্পে জয়া আহসান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের পরিচালক গৌতম ঘোষ 'মালা' চরিত্রে দেখিয়েছিলেন চম্পাকে। আর্টফিল্মের বাইরে সাম্প্রতিককালে এপার-ওপার বাংলার কোনো নায়িকা এমন উঁচুমানের অভিনয় করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বলা যায়, এই একটি মাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জয়া আহসান যা অর্জন করেছেন, তার অভিঘাত বহু বছর বাঙালি মানসে বেঁচে থাকবে, যদি তিনি আর কোনো দিন অভিনয় না-ও করেন। তা ছাড়া পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আহমেদ রুবেল, অপূর্ব মজুমদার, কচি খন্দকার, দেবাংশু হোর, নুসরাত জাহান ডায়না, সুদীপ ব্যানার্জি তাঁদের নিজেদের অতিক্রম করেছেন অবশ্যই। আইয়ুব বাচ্চু, জালাল আহমেদ এবং আলিফ লায়লার শব্দ-সুর মহাকাব্যের বীররস আর করুণরসের এক মহাজগৎ সৃষ্টি করেছে সারা চলচ্চিত্র ভূমিতেই।
আবারও বলতে হয়, এই আলোচনা চলচ্চিত্রের কোনো তাত্তি্বক আলোচনা নয়; কেবল একজন সাধারণ দর্শকের অনুভূতি। এই ছবিটি নির্মাণ করে নাসির উদ্দীন ইউসুফ এক মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। বিনোদনচিত্রের দর্শক, যারা চলচ্চিত্রের দর্শন বোঝে না, তাদেরও নাড়া দেবে; এবং আত্মজিজ্ঞাসায় তাড়িত হবে তারা। এই ছবির অভিঘাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মরা গাঙে জোয়ার সৃষ্টি না হোক, অন্তত নদীটা তো নতুন পানিতে ভরাট হবে। সমাজে রাজনীতির ক্ষয়টা শনাক্ত হবে এবং পতনের শঙ্কাটা দূরে সরে যাবে। ছবিটির অপূর্ণতা যা কিছু আছে, তা হয়তো পরিচালকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই। কিন্তু অর্জনটা যা হয়েছে, তার নামই শিল্প। এখানেই সত্যজিৎ-ঋতি্বক ঘটকের মুখ ভেসে ওঠে। মহান একটি চলচ্চিত্র কেবল পরিচালকই নয়, এর কাহিনীকার বা সাহিত্যিককেও অমরত্ব দান করে থাকে। সাহিত্যের মৃত শব্দেরা একজন কথাশিল্পীকে যা দিতে পারে না, চলচ্চিত্রের জীবন্ত ক্যামেরা তা পারে। সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান' এবং পরিচালক এখানেই অমরত্ব লাভ করবেন।
লেখক : গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক
যুদ্ধের প্রায় ৪০ বছর পর এমন এক সময় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে, যখন স্বপ্নভঙ্গ বাঙালির দুর্দশা অতিক্রমের চেষ্টা চলছে। দর্শকের মনে হবে, এর দৃশ্যাবলি স্মৃতিকাতরতা নয়, বরং ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালির ইতিহাসের যুদ্ধ-প্রত্নভূমি থেকে উঠে আসা বিলুপ্ত নগরী বা হারিয়ে ফেলা প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কারের সামনে হকচকিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়া। আমাদের একাত্তর আজ কেবল উত্তর প্রজন্ম নয়, পূর্ব প্রজন্মেরও স্মৃতিভ্রষ্ট প্রত্ন-ইতিহাস। এটাই নির্মম বাস্তবতা। পরিচালক আজকের দিনে ইতিহাসের সঙ্গে বাঙালির বৈরী দ্বন্দ্বে আর ক্ষতবিক্ষত সত্যের রক্তাক্ত ভূমিতে দাঁড়িয়ে এক সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠীকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, কোনটি সত্য, আর কোনটি মিথ্যা।
চলচ্চিত্রটির কাহিনীতে তেমন নতুনত্ব নেই। পর্দায় যা ঘটেছে, তা আমাদের ইতিহাসেরই অক্ষর আর শব্দমালা। যা নতুনত্ব, যা অভূতপূর্ব, তা হচ্ছে চলচ্চিত্রটির পরতে পরতে ব্যবহৃত চিত্রকল্প এবং ব্যঞ্জনার্থ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এমন কাব্যময়তা ইতিপূর্বে কোনো কবি (পরিচালক) নির্মাণ করেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। পর্দায় আমরা দেখব অন্ধকার রাত, প্রবল বৃষ্টিপাত, যুদ্ধের আয়োজন, পাশাপাশি ঘাতক শক্তির তৎপরতা। এই বৃষ্টির চিত্রায়ণ বেশ দীর্ঘ। আমরা জানি, বৃষ্টি হচ্ছে উর্বরতার প্রতীক, বীজের অঙ্কুরোদয়ের আয়োজন। বৃষ্টি স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে, এই বঙ্গে ভবিষ্যতে যা ঘটতে যাচ্ছে। নগরবাসীর আতঙ্ক অথচ আশা মিলেমিশে বৃষ্টির শব্দের ভেতর, ছুটন্ত গাড়ির জল ছিটানো শব্দের ভেতর আর হেডলাইটের চকিত আলোয় যে চিত্রভাষ্য তৈরি হয়, তা বড় মাপের পরিচালক ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বৃষ্টির ভেতর পানির স্রোতকে কখনো মনে হবে রক্তস্রোত, কখনো বা জ্যোৎস্নাভেজা নদীর বুক। এখানে নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি ভাসে মুক্তির স্বপ্ন।
রাস্তার পাশে বসা উলঙ্গ একটি শিশু এবং সামনে দিয়ে হত্যার জন্য ঘাতকদের নিরস্ত্র মানুষকে টেনে নেওয়া কিংবা জীবন রক্ষার কাতরতার দৃশ্যের ভেতর শিশুর কৌতূহলী দৃষ্টির চিত্রভাষ্যটি গভীর তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে, যার ব্যাখ্যা সহজ নয়। ঘাতকরা আর হত্যার জন্য বন্দি অবস্থায় মানুষ যা জানে, শিশুটি তা জানে না। এ যেন একাত্তরের বোধশূন্য বিশ্বমানবতা। 'বিলকিস' চরিত্রের আড়ালে জয়া আহসানকে আমরা দেখতে পাব জলেশ্বরী যাত্রায় ট্রেনের ভেতর। ঘাতকদের জাত-ধর্ম তল্লাশির ভেতর এক মহিলার দুর্দশার দৃশ্যে বিলকিস ঘৃণায়-ক্রোধে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করে নিজ বোরকাটি উন্মোচন করে। কিন্তু এর বাইরে দর্শকের মনে হবে বিকল্প ব্যঞ্জনার কথা। বোরকাবিহীন বিলকিস বুঝি তার নিজ ধর্মীয় পরিচয় পরিত্যাগ করেছে এবং কালো অন্ধকার বন্দি গুহা থেকে মুক্তি নিয়ে স্বাধীনতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেনটি যদিও তাকে জলেশ্বরীর ট্র্যাজেডির দিকে টেনে নিচ্ছিল, বাস্তবে কিন্তু শিল্পব্যঞ্জনায় তার যাত্রা ছিল পরম মুক্তির পথে। মাঝপথে ব্রিজ ভাঙার ঘটনাটি আমাদের চিন্তাকে নাড়া দেয়। তবে কি পরিচালক দূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে?
জলেশ্বরীর জলযাত্রায় নৌকায় বসা বিলকিসের স্থির চোখের দৃষ্টি যেন এক মহাকাব্যের জগৎ। ওখানে দুশ্চিন্তার স্থির জলরাশিতে যেন লুটিয়ে পড়েছে জলেশ্বরীর ওপরের অপার-অনন্ত আকাশটা। বিলকিস যখন শুকনো মাছের আড়তে তৃষ্ণা-ক্ষুধায় কাতর হয়ে অখাদ্য খেতে গিয়ে বমি করে এবং সেই বমির শব্দ আর নায়িকার শরীরী ব্যাকরণ স্পষ্ট শনাক্ত করে, সেই মুক্তি আর স্বাধীনতার ভ্রূণ গর্ভে ধারণ করেছে। এমনই শত শত চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে এই চলচ্চিত্র মহাকাব্যে।
খুবই প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন উঠে আসতে পারে 'গেরিলা' চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের বিবেচনায়। এটাকে কি সাহিত্যের তত্ত্ব নিউ হিস্টোরিসিজম বা নব্য ইতিহাসবাদ ডিসকোর্সের কোনো না কোনো পয়েন্টে ফেলে বিবেচনা করা যায় না? এ কাজে অবশ্যই মেধাবী চলচ্চিত্র ব্যাখ্যাকারের হাত লাগবে, কাজটি জটিল বলেই। কেননা, এখানে ইতিহাস আছে দূর, নিকট-অতীতের। স্থিরচিত্রে আমরা মহান বাঙালি অতীত নেতাদের, অখণ্ড উপমহাদেশের ভাবুক-চিন্তক নেতাদের পাশাপাশি লেনিন-স্ট্যালিনের ছবিও এক ঝলক দেখতে পাই। পরিচালকের একটা সমন্বয়-চিন্তা ধরা পড়ে। জাতীয়তাবাদী নেতাদের পাশাপাশি মার্কসবাদী মহান বিশ্বনেতাদেরও তিনি আমাদের দেখান। এ কি তবে বাঙালি মানস বা জাতীয় চরিত্রের সমন্বয়পন্থী দৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত? অবশ্য এই চলচ্চিত্রে এর ব্যাখ্যা নেই। অথচ একাত্তরের যুদ্ধ তো কেবল জাতীয়তাবাদীরাই করেনি, করেছে মার্কসবাদীরাও। কেন নেই তবে ওরা?
জোর দিয়েই বলা চলে, বহুদিন পর বাঙালি দর্শক একজন ধ্রুপদী নায়িকার সাক্ষাৎ পেল। তিনি হলেন বিলকিসের প্রতিকল্পে জয়া আহসান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের পরিচালক গৌতম ঘোষ 'মালা' চরিত্রে দেখিয়েছিলেন চম্পাকে। আর্টফিল্মের বাইরে সাম্প্রতিককালে এপার-ওপার বাংলার কোনো নায়িকা এমন উঁচুমানের অভিনয় করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বলা যায়, এই একটি মাত্র চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জয়া আহসান যা অর্জন করেছেন, তার অভিঘাত বহু বছর বাঙালি মানসে বেঁচে থাকবে, যদি তিনি আর কোনো দিন অভিনয় না-ও করেন। তা ছাড়া পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আহমেদ রুবেল, অপূর্ব মজুমদার, কচি খন্দকার, দেবাংশু হোর, নুসরাত জাহান ডায়না, সুদীপ ব্যানার্জি তাঁদের নিজেদের অতিক্রম করেছেন অবশ্যই। আইয়ুব বাচ্চু, জালাল আহমেদ এবং আলিফ লায়লার শব্দ-সুর মহাকাব্যের বীররস আর করুণরসের এক মহাজগৎ সৃষ্টি করেছে সারা চলচ্চিত্র ভূমিতেই।
আবারও বলতে হয়, এই আলোচনা চলচ্চিত্রের কোনো তাত্তি্বক আলোচনা নয়; কেবল একজন সাধারণ দর্শকের অনুভূতি। এই ছবিটি নির্মাণ করে নাসির উদ্দীন ইউসুফ এক মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। বিনোদনচিত্রের দর্শক, যারা চলচ্চিত্রের দর্শন বোঝে না, তাদেরও নাড়া দেবে; এবং আত্মজিজ্ঞাসায় তাড়িত হবে তারা। এই ছবির অভিঘাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মরা গাঙে জোয়ার সৃষ্টি না হোক, অন্তত নদীটা তো নতুন পানিতে ভরাট হবে। সমাজে রাজনীতির ক্ষয়টা শনাক্ত হবে এবং পতনের শঙ্কাটা দূরে সরে যাবে। ছবিটির অপূর্ণতা যা কিছু আছে, তা হয়তো পরিচালকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই। কিন্তু অর্জনটা যা হয়েছে, তার নামই শিল্প। এখানেই সত্যজিৎ-ঋতি্বক ঘটকের মুখ ভেসে ওঠে। মহান একটি চলচ্চিত্র কেবল পরিচালকই নয়, এর কাহিনীকার বা সাহিত্যিককেও অমরত্ব দান করে থাকে। সাহিত্যের মৃত শব্দেরা একজন কথাশিল্পীকে যা দিতে পারে না, চলচ্চিত্রের জীবন্ত ক্যামেরা তা পারে। সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান' এবং পরিচালক এখানেই অমরত্ব লাভ করবেন।
লেখক : গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক
No comments