গণমাধ্যম-সাংস্কৃতিক যোগাযোগ by উম্মে মুসলিমা

ভারতের বাংলা টিভি চ্যানেল ‘তারা মিউজিক’ এ দেশের অনেকের জনপ্রিয় চ্যানেল। এ দেশের সংগীতশিল্পীরা তাঁদের আমন্ত্রণে গিয়ে লাইভ অনুষ্ঠানে গান করেন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সঙ্গে টেলিফোনে গানের অনুরোধ রক্ষাসহ স্মৃতিচারণায় অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকেও অনেক সংগীতানুরাগী টেলিফোন করে থাকেন, যাঁদের মধ্যে পুরুষই বেশি।


মনে হয়, আগ্রহ যতটা না উপস্থিত শিল্পীর সঙ্গে কথা বলার, তার চেয়ে বেশি সঞ্চালক প্রিয়দর্শিনী, প্রিয়ংবদা তরুণীদের সঙ্গে। সঞ্চালক-শিল্পীদের মধ্যে এত কথা হয়, এত গান, এত ফোন, দুই বাংলাকে এত নিবিড়ভাবে উপস্থাপনে ‘তারা’ টিভির এমনধারা প্রয়াস; কিন্তু এ দেশ থেকে যাওয়া অতিথিশিল্পীরা একবারও কেন তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন না ‘আচ্ছা, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান আপনাদের কেমন লাগে?’ জিজ্ঞাসা করবেন কীভাবে? আমাদের চ্যানেলগুলো তো তাঁদের ওখানে রীতিমতো নিষিদ্ধ। ‘তারা’ চ্যানেল দুই বাংলার সংস্কৃতির মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। বিভিন্ন রাষ্ট্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘তারা’র প্রতিবেদক-সাংবাদিকেরা এ দেশ থেকে ছবি-সংবাদ তুলে নিয়ে তাঁদের চ্যানেলে প্রচার করেন, ‘তারা মিউজিক’ ছাড়াও ‘তারা’র অন্য অনুষ্ঠানে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনের বিজ্ঞজনদের আমন্ত্রণ জানিয়ে টক শো করা হয়। কিন্তু ভুলেও বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ওখানে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় না। এ কেমন ধারার সাংস্কৃতিক লেনদেন?
যাহোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো, আমরা তাদের চ্যানেলগুলো দেখি। বেশ আগে হিন্দি ধারাবাহিকগুলোর দর্শক ছিলেন এ দেশের গৃহব্যবস্থাপক বধূরা। এখনো কেউ কেউ দেখেন। তবে গৃহপরিচারিকারাই এখন এসব হিন্দি ধারাবাহিকের প্রকৃত দর্শক-শ্রোতা। বাংলা ধারাবাহিকের মধ্যে সুবর্ণলতা অনেকেই দেখেন। কিন্তু অন্যগুলোর কাহিনি যা-ই হোক, একটা সাধারণ বিষয় হিন্দি-বাংলা সবগুলোর মধ্যেই থাকে, তা হলো কাহিনিগুলোর হিংসুটে ও ঈর্ষাপরায়ণ ঝগড়াটে নিষ্ঠুর নারী চরিত্র। নায়ক-নায়িকাকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা এরা প্রায়ই করে থাকে। এ রকম নির্দয় পুরুষ চরিত্র থাকে না বললেই চলে। পুরুষগুলো প্রায় প্রত্যেকেই মহান। নায়িকাদের সচরাচর পতিপরায়ণ ধার্মিকরূপে চিত্রায়ণ করা হয়। এ যুগে বাস্তবে যৌথ পরিবারের প্রথা নেই বললেই চলে। অথচ নাটকগুলোয় যৌথ পরিবারের কুরুক্ষেত্র প্রদর্শিত হয়; আর সেই সঙ্গে পরকীয়ার জয়জয়কার। আরও আছে নাচ ও গানের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। কিশোর-যুবদের নিয়ে নাচ-গানে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আপত্তি শিশুদের দিয়ে যা করানো হচ্ছে, সেগুলোর প্রতি। হিন্দি-বাংলা সিনেমার একজন প্রতিষ্ঠিত পড়তি বয়সের নায়ক শিশুদের নিয়ে প্রতিবছর নাচের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করেন। মহাগুরু কর্তৃক পাঁচ বছর বয়স থেকে ১১-১২ বছর বয়সী শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক বানানোর এ এক মহাযজ্ঞ! সংবেদনশীল যাঁরা এ অনুষ্ঠান দেখেছেন, এসব শিশুর সাজ-পোশাক এবং আবেদনময় ভাবভঙ্গি দেখে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ! এরা কি শিশু? যেন একেকজন খুদে হেলেন, ঋত্বিক রোশন, মাধুরী দীক্ষিত অথবা মল্লিকা শেরাওয়াত! তাদের নাচের অনুষঙ্গ গানগুলোও বড়দের এবং বলাই বাহুল্য, যৌন আবেদনময়। সঞ্চালক ছয় বছরের এক কন্যাশিশু প্রতিযোগীকে ‘বউ’ বলে সম্বোধন করেন। দর্শকের আসনে বসে ওই শিশুর মা-বাবা আহ্লাদে আটখানা! একজন মনোবিজ্ঞানী বলছিলেন, শিশুদের, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের দিয়ে যুবতীর চরিত্রে নৃত্য পরিবেশন করানো একধরনের বিকৃতি এবং একই সঙ্গে চাইল্ড অ্যাবিউজমেন্ট। শিশুশ্রমের দায়ে প্রযোজক-পরিচালকদের অভিযুক্তও করা যায়।
আমরা অনুকরণ করি; হলিউডকে বলিউড, বলিউডকে টালিউড এবং টালিউডকে ঢালিউড। তবে আমাদের মাত্র একটি চ্যানেল ছাড়া হিন্দি সিরিয়ালের অনুকরণ অন্য কোনো চ্যানেল করে না। ভয় হয়, অনুকরণের ধারাবাহিকতায় আমরাও আবার না ওই রকম শিশু-অপব্যবহার শুরু করে দিই! ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও ভারতীয় দূরদর্শনের মধ্যে অনুষ্ঠান বিনিময়ের চুক্তি হয়েছে। আমাদের অনুরোধ থাকবে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলো যাতে ভারতে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু বাণিজ্য, যোগাযোগ, ট্যারিফ, ট্রানজিট, পানি বণ্টন নয়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে একে-অন্যের বন্ধুত্ব পাকাপোক্ত করতে হবে।
আমরা টিভির সংবাদ পরিবেশন, নাটক, লাইভ প্রোগ্রাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোথায় পৌঁছেছি, তাদের জানা দরকার। আমরা একতরফা তাদেরটাই দেখব, তারা আমাদেরটা দেখবে না—তথ্যপ্রযুক্তির প্রবহমানতায় এ ঠিক মেলে না। তাদের ভালো কিছুর অনুসরণে আমরা ভালো কিছু সৃষ্টি করতে পারব। আমাদের ভালোগুলো দেখে ওরা অনুপ্রাণিত হবে, তুলনামূলক দর্শক তৈরি হবে, তা না হলে ‘দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে’ হবে কী করে? সুসংস্কৃতি আর মানবিকতা তো হাত ধরাধরি করে চলে। তাই সীমান্ত চুক্তি হলেও দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপিত না হলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
‘তাদের দুটো পালন করা ভেড়া চরে বেড়ায় আমার বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া, কোলের পরে নেই তাহারে তুলে’—কি সম্ভব হবে?
উম্মে মুসলিমা: গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.