চরাচর-শোভা বাড়াত যে বড়শি by সাইফুল ইসলাম
প্রায় ২০০ বছর আগে জার্মানি থেকে এ দেশে বড়শির আমদানি ঘটে। বড়শি দিয়ে বিভিন্নভাবে মাছ ধরা প্রমাণ করে, কত উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী এই বাঙালি জাতি। ছিপের সঙ্গে বড়শি বেঁধে মাছ ধরার প্রচলনই ছিল এ দেশে সবচেয়ে বেশি। সাধারণত ছয়-সাত হাত লম্ব্বা হতো এসব ছিপ। ছিপের মাথায় আট-দশ হাত লম্ব্বা সুতার সঙ্গে বাঁধা হতো বড়শি।
সুতার মাঝামাঝি বা নিচের দিকে বাঁধা থাকত পাটকাঠি বা ভাতশোলার ছোট্ট 'পাতারি'। বড়শিতে 'আধার' (মাছের খাদ্য) হিসেবে দেওয়া হতো পিঁপড়ার ডিম বা কেঁচো। খাদ্যের লোভে মাছ এসে ঠোকর দিত এ আধারে। এ খবর জানান দিতে টিপ পড়ত পাতারিতে। একসময় খাদ্য গিলে ছুট দিলে খোট্টা দিয়ে মাছ তুলে ফেলা হতো ডাঙায়। একসময় প্রতিটি কিষান বাড়িতে ঘরের বেড়া বা চালের সঙ্গে গুঁজে থেকে শোভা বাড়াত এ বড়শিগুলো। অবসরে-বিনোদনে, এমনকি মন খারাপ থাকলেও কিষান এই বড়শি নিয়ে বসে যেত নদী বা জলাশয়ের ধারে। বর্ষাকালে নতুন পানির সঙ্গে যখন বড় বড় বোয়াল, আইড়, গজার মাছ ভেসে বেড়াত তখন মাছ ধরার ধরন কিছুটা পাল্টে যেত। নদীর পাড়জুড়ে পুঁতে দেওয়া হতো বড় বড় ছিপ। পানি ছুঁয়ে থাকা বড়শিতে আধার হিসেবে দেওয়া হতো তাজা ছোট ছোট টাকি, পুঁটি, টেংরা মাছ। আরো বড় বড়শিতে কেউ কেউ বিঁধিয়ে দিত আস্ত ব্যাঙ। এসব তাজা মাছ বা ব্যাঙকে বলা হতো 'জিয়ালা'। তাজা মাছের নড়াচড়ার খলবল আওয়াজে ছুটে আসত বড় বড় মাছ। খপ করে জিয়ালা ধরতে গিয়ে একসময় আটকা পড়ত নিজেই। কোথাও কোথাও এসব বড়শির নাম ছিল 'ডগি'। সারা দিন জিয়ালা সংগ্রহ করে বিকেলে শুরু হতো মাছ ধরার আসল আয়োজন। এ সময় বড়শিতে জিয়ালা লাগিয়ে দেওয়া হতো। দু-তিনজনে রাত জেগে পাহারা দিতে নদীর পাড়েই গড়ে নিত ছোট অস্থায়ী ঘর। যখনই বড়শিতে মাছ আটকা পড়ে উথাল-পাথাল শুরু করত, তখন ত্রস্তে এসে ধরে ফেলা হতো মাছ। আরো একধরনের বড়শি দেখা যেত লম্ব্বা রশির সঙ্গে ছোট ছোট সুতায় বাঁধা। ভরা বর্ষায় জমিতে পানির মধ্যে দু-এক শ হাত দূরত্বের দুটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো লম্বা রশি। আর ওই রশিতে এক হাত অন্তর অন্তর পানি ছুঁইছুঁই করে বেঁধে দেওয়া হতো এসব বড়শি। এসব বড়শিতে আধার হিসেবে দেওয়া হতো কখনো কেঁচো, কখনো বা ছোট মাছ। পানির মধ্যে পাতা থাকত বলে এসব বড়শির তদারকি হতো নৌকা বা কলার ভেলায়। ধরা পড়ত ছোট ছোট বোয়াল, আইড়, পাবদা, গোলসা, টেংরা ইত্যাদি। কোথাও কোথাও এ বড়শিকে বলা হতো 'দাইনা'। আরো একধরনের মাছ ধরা অনেকের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। এ পদ্ধতিতে নদীর কূলে বসে লম্ব্বা সুতার সঙ্গে বড়শি বেঁধে ছুড়ে দেওয়া হতো গহিন অংশে। বড়শিতে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো ঝিনুকের মধ্যে থাকা মাংসল অংশ। ধ্যানি বকের মতো নদীর কূলে বসে বড়শির সুতাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হতো যে কখন টান পড়বে সুতায়। যখন লম্বা সুতায় টান পড়ত তখন হ্যাঁচকা টানে আটকে ফেলা হতো মাছ। বড় মাছ হলে সহজে তোলা যেত না। কখনো সুতা ঢিল দিয়ে, কখনো বা টান দিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লেই তোলা যেত মাছটি। কোথাও কোথাও এসব বড়শিকে বলা হতো তাগা বা সুত বড়শি। বড়শি দিয়ে এমনি আরো অনেক পদ্ধতিতেই মাছ ধরা হতো। কিন্তু নদী হারিয়ে বড়শি দিয়ে বিভিন্নভাবে মাছ ধরার কথা এখন ভুলতে বসেছি আমরা।
সাইফুল ইসলাম
No comments