চারদিক-সীমান্তের শেষ গাছ
সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই ডা. আকতারুল আলম বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে একটি চম ৎ কার নিদর্শন দেখাব। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা তেঁতুলিয়া বাজারে চলে এলাম। সবাই গাড়ি থেকে নামল। আকতারুল আলম আমাদের একটি তেঁতুলগাছের নিচে দাঁড় করালেন। বললাম, এই গাছের বিশেষত্ব কী?
তিনি বললেন, মূলত এই গাছকে ঘিরেই এ অঞ্চলের নাম তেঁতুলিয়া। দারুণ ব্যাপার তো, তেঁতুলগাছের নামেই এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে! ভালো করে লক্ষ করে দেখি, গাছটি বেশ পুরোনো। সিমেন্ট দিয়ে গোড়া বাঁধানো। পাশঘেঁষেই বড় রাস্তা। আরেক পাশে দোকানপাট। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অনেকটাই অরক্ষিত। তা ছাড়া অনেক কাছ থেকে গাছের গোড়া সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। এই ব্যবস্থা গাছের প্রাণশক্তি কমায়, ক্ষেত্রবিশেষে আয়ুও। আমাদের সামনে দিয়েই আখবোঝাই একটি গরুর গাড়ি চলে গেল। এই আখগুলো হয়তো যাবে কোনো চিনিকলে কিংবা কোনো গৃহস্থের আঙিনায়। এসব অঞ্চলে অনেকেই নিজস্ব পদ্ধতিতে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই তেঁতুলিয়ার তেঁতুলগাছ দেখা শেষ। আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা সীমান্ত। তবে সীমান্তে যাওয়ার আগেই সীমান্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছি। কিছু দূর যেতে না যেতেই বাঁ পাশের মহানন্দা নদী আমাদের সঙ্গী হলো। নদীর ওপারেই ভারত। এখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার এবং ভারতীয়দের চলাফেরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শুকনো মৌসুম হওয়ায় মহানন্দার পানি কোথাও কোথাও তলানিতে আবার কোথাও কোথাও একেবারে শুকনো খটখটে। এখানে মহানন্দাই দুই দেশের প্রধান বিভাজক। এদিকে লোকবসতি কম। আরও খানিকটা যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি বাঁ দিকে একটা টিলার ওপর উঠে এল। স্থানটি ডিসির বাংলো নামে পরিচিত। বেশ খোলামেলা, সুন্দর জায়গা। একপাশে একটি পুরোনো অশ্বত্থগাছ। এখানেই কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’ কবিতার সিমেন্টে মুদ্রিত একটি ফলক আছে। দেখে ভালোই লাগল। টিলার পাশঘেঁষে মহানন্দা নদী। নদীর পাড় ধরে অনেক দূর অবধি হাঁটা যায়। এখানে অনেকেই বেড়াতে আসেন। শীতকালে অনেক দূর থেকে আসে বনভোজনের দলগুলো। নদীর দুই পাশের সব জায়গাই এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত। বর্ষায় এখানকার রূপ নিশ্চয় বদলে যায়।
তারপর আবার ছুটে চলা। বিজিবির চেকপোস্ট পেরিয়ে বাংলাদেশের শেষ বিন্দুর কাছে চলে গেলাম সবাই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সীমান্তে কোনো ত ৎ পরতা চোখে পড়ল না। অফিস ঘরগুলো বিরান পড়ে আছে। আমাদের এই পাশ যতটা অরক্ষিত, ততটাই সুরক্ষিত ওপাশ। বাংলাদেশের যে অংশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তা একটি ছোট্ট করিডরের মতো। দুই পাশে খুব কাছেই ভারত। বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে পঞ্চগড়ের এ স্থানটি খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। সবাই পরম কাঙ্ক্ষিত বাংলাবান্ধা ‘০ কি. মি.’ মাইলফলকটি ছুঁয়ে দেখল, ছবি তুলল। এই ফলকের উল্টোপিঠে লেখা আছে টেকনাফ ১০২১ কি. মি., ঢাকা ৫৩২ কি. মি. এবং তেঁতুলিয়া ১৭ কি. মি.। অর্থা ৎ ভারত থেকে যাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন, তাঁরা তা ৎ ক্ষণিকভাবে এই তথ্যটুকু জানতে পারবেন। এই ফলকটির মাত্র কয়েক হাত দূরেই বাংলাদেশের শেষ গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। ডান পাশেও একই গাছ, নাম জিকা। একসময় গ্রামের মানুষ সীমানা নির্ধারণে এই গাছটিই বেশি ব্যবহার করত। সম্ভবত এমন ধারণা থেকেই দুই পাশে এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে। তা ছাড়া জিকাগাছের প্রাণশক্তিও অফুরান। কোনোমতে একটা ডাল পুঁতে দিলেই বেঁচে যায়। জিকাগাছের কয়েক গজ দূরে ভারত সীমানায় কলাগাছের ঝোপ আর বাঁশঝাড়। শীত মৌসুম হওয়ায় জিকাগাছ একেবারেই নিষ্পত্র। শেষ প্রান্তের এই গাছগুলো খুব একটা বয়সী না হলেও অপেক্ষাকৃত পেছনের কয়েকটি গাছ মাঝবয়সী।
বাঁ দিকের পথের পাশে আরও আছে কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস ও একটি অশ্বত্থ। অশ্বত্থগাছে একটি পরিণত পরজীবী লতার গাছ চোখে পড়ল। কাষ্ঠল লতার এই গাছটি তা ৎ ক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা গেল না। বয়সের কারণে পাতার আকৃতি ও বর্ণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। মূলত অশ্বত্থ আর ওই লতার খোলসের আড়ালে হারিয়ে গেছে প্রকৃত গাছটা। আর ডান দিকে জিকাগাছ ছাড়া আরও আছে একটা মেহগনি ও কৃষ্ণচূড়া। সব মিলিয়ে মাত্র এই কয়েকটা গাছ আমাদের সীমান্তের শেষ বিন্দুতে। তাও আবার হয়তো বা কেউ দয়া করে এই কটা গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন বলেই শেষরক্ষা! না হয় তো ন্যাড়াই থাকত জায়গাটা। অথচ এখানে আমাদের দেশ তথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে যথাযথভাবে রিপ্রেজেন্ট করে এমন কয়েকটি গাছ থাকলে মন্দ হয় না। যেমন: নাগেশ্বর, স্বর্ণচাঁপা, দেবদারু এমনকি আম-কাঁঠালও হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পুরো রাস্তার দুই পাশে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়ন করাও জরুরি। তেঁতুলিয়ার কোনো একটি সামাজিক সংস্থাও এই দায়িত্ব নিতে পারে।
প্রতিদিন এখানে যেহেতু অনেক পর্যটক আসে, সেহেতু অদূরে দু-একটি প্রয়োজনীয় স্থাপনাও তৈরি করা যেতে পারে। নাগরিক সুবিধাসংবলিত এসব স্থাপনা অনেক দূর থেকে আসা একজন পর্যটককে নানাভাবে সহায়তা করবে। একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে সরকারও যেমন কিছু রাজস্ব আয় করতে পারে, তেমনি সাধারণ মানুষও উপকৃত হতে পারে।
মোকারম হোসেন
অল্প সময়ের মধ্যেই তেঁতুলিয়ার তেঁতুলগাছ দেখা শেষ। আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা সীমান্ত। তবে সীমান্তে যাওয়ার আগেই সীমান্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছি। কিছু দূর যেতে না যেতেই বাঁ পাশের মহানন্দা নদী আমাদের সঙ্গী হলো। নদীর ওপারেই ভারত। এখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার এবং ভারতীয়দের চলাফেরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শুকনো মৌসুম হওয়ায় মহানন্দার পানি কোথাও কোথাও তলানিতে আবার কোথাও কোথাও একেবারে শুকনো খটখটে। এখানে মহানন্দাই দুই দেশের প্রধান বিভাজক। এদিকে লোকবসতি কম। আরও খানিকটা যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি বাঁ দিকে একটা টিলার ওপর উঠে এল। স্থানটি ডিসির বাংলো নামে পরিচিত। বেশ খোলামেলা, সুন্দর জায়গা। একপাশে একটি পুরোনো অশ্বত্থগাছ। এখানেই কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’ কবিতার সিমেন্টে মুদ্রিত একটি ফলক আছে। দেখে ভালোই লাগল। টিলার পাশঘেঁষে মহানন্দা নদী। নদীর পাড় ধরে অনেক দূর অবধি হাঁটা যায়। এখানে অনেকেই বেড়াতে আসেন। শীতকালে অনেক দূর থেকে আসে বনভোজনের দলগুলো। নদীর দুই পাশের সব জায়গাই এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত। বর্ষায় এখানকার রূপ নিশ্চয় বদলে যায়।
তারপর আবার ছুটে চলা। বিজিবির চেকপোস্ট পেরিয়ে বাংলাদেশের শেষ বিন্দুর কাছে চলে গেলাম সবাই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সীমান্তে কোনো ত ৎ পরতা চোখে পড়ল না। অফিস ঘরগুলো বিরান পড়ে আছে। আমাদের এই পাশ যতটা অরক্ষিত, ততটাই সুরক্ষিত ওপাশ। বাংলাদেশের যে অংশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তা একটি ছোট্ট করিডরের মতো। দুই পাশে খুব কাছেই ভারত। বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে পঞ্চগড়ের এ স্থানটি খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। সবাই পরম কাঙ্ক্ষিত বাংলাবান্ধা ‘০ কি. মি.’ মাইলফলকটি ছুঁয়ে দেখল, ছবি তুলল। এই ফলকের উল্টোপিঠে লেখা আছে টেকনাফ ১০২১ কি. মি., ঢাকা ৫৩২ কি. মি. এবং তেঁতুলিয়া ১৭ কি. মি.। অর্থা ৎ ভারত থেকে যাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন, তাঁরা তা ৎ ক্ষণিকভাবে এই তথ্যটুকু জানতে পারবেন। এই ফলকটির মাত্র কয়েক হাত দূরেই বাংলাদেশের শেষ গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। ডান পাশেও একই গাছ, নাম জিকা। একসময় গ্রামের মানুষ সীমানা নির্ধারণে এই গাছটিই বেশি ব্যবহার করত। সম্ভবত এমন ধারণা থেকেই দুই পাশে এই গাছগুলো লাগানো হয়েছে। তা ছাড়া জিকাগাছের প্রাণশক্তিও অফুরান। কোনোমতে একটা ডাল পুঁতে দিলেই বেঁচে যায়। জিকাগাছের কয়েক গজ দূরে ভারত সীমানায় কলাগাছের ঝোপ আর বাঁশঝাড়। শীত মৌসুম হওয়ায় জিকাগাছ একেবারেই নিষ্পত্র। শেষ প্রান্তের এই গাছগুলো খুব একটা বয়সী না হলেও অপেক্ষাকৃত পেছনের কয়েকটি গাছ মাঝবয়সী।
বাঁ দিকের পথের পাশে আরও আছে কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস ও একটি অশ্বত্থ। অশ্বত্থগাছে একটি পরিণত পরজীবী লতার গাছ চোখে পড়ল। কাষ্ঠল লতার এই গাছটি তা ৎ ক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা গেল না। বয়সের কারণে পাতার আকৃতি ও বর্ণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। মূলত অশ্বত্থ আর ওই লতার খোলসের আড়ালে হারিয়ে গেছে প্রকৃত গাছটা। আর ডান দিকে জিকাগাছ ছাড়া আরও আছে একটা মেহগনি ও কৃষ্ণচূড়া। সব মিলিয়ে মাত্র এই কয়েকটা গাছ আমাদের সীমান্তের শেষ বিন্দুতে। তাও আবার হয়তো বা কেউ দয়া করে এই কটা গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন বলেই শেষরক্ষা! না হয় তো ন্যাড়াই থাকত জায়গাটা। অথচ এখানে আমাদের দেশ তথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে যথাযথভাবে রিপ্রেজেন্ট করে এমন কয়েকটি গাছ থাকলে মন্দ হয় না। যেমন: নাগেশ্বর, স্বর্ণচাঁপা, দেবদারু এমনকি আম-কাঁঠালও হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পুরো রাস্তার দুই পাশে পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষায়ন করাও জরুরি। তেঁতুলিয়ার কোনো একটি সামাজিক সংস্থাও এই দায়িত্ব নিতে পারে।
প্রতিদিন এখানে যেহেতু অনেক পর্যটক আসে, সেহেতু অদূরে দু-একটি প্রয়োজনীয় স্থাপনাও তৈরি করা যেতে পারে। নাগরিক সুবিধাসংবলিত এসব স্থাপনা অনেক দূর থেকে আসা একজন পর্যটককে নানাভাবে সহায়তা করবে। একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে সরকারও যেমন কিছু রাজস্ব আয় করতে পারে, তেমনি সাধারণ মানুষও উপকৃত হতে পারে।
মোকারম হোসেন
No comments