দূরদেশ-নয়-এগারোর দশক: আত্মজিজ্ঞাসার সময় এখন by আলী রীয়াজ
১১ সেপ্টেম্বরের দশম বর্ষপূর্তি সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যত্র গণমাধ্যম ও রাজনীতির বিশ্লেষকেরা ফিরে তাকাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা এবং গত এক দশকে এর প্রভাবের দিকে। হামলায় যে দুই হাজার ৯৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে কেবল ওই দিনই নয়, গত এক দশকের প্রতিটি মুহূর্তই হচ্ছে প্রিয়জন
হারানোর বেদনায় ভরা সময়। আর বিশ্বের অন্যদের জন্য এটি একটি যুগান্তরকারী দিন। এর প্রভাব গত এক দশকেও শেষ হয়ে যায়নি। যেকোনো ঐতিহাসিক দিনের তা ৎ পর্যই ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে ভিন্ন ভিন্ন রকম। তার পরও ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকেরা এ রকম ঘটনার প্রভাব ও তা ৎ পর্য বোঝার এবং বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন।
১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার প্রভাব যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমিত থেকেছে তা নয়, এই সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা যেমন হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, হামলায় নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় যেমন আছে প্রায় ৫৫টি দেশের মানুষ, তেমনি তার প্রভাবও পড়েছে সারা পৃথিবীতে। বিশ্বব্যাপী এই প্রভাবের পেছনে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় নয়, কাজ করেছে হামলা-পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ হামলার প্রণেতা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সন্ত্রাসী হামলার প্রত্যুত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপ জন্ম দিয়েছে তিনটি যুদ্ধের। আল-কায়েদার ত ৎ কালীন ঘাঁটি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হামলার মধ্য দিয়ে এসব যুদ্ধের সূচনা। ১১ সেপ্টেম্বরকে অভ্যুত্থান হিসেবে দাঁড় করিয়ে জর্জ বুশের নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার মিত্রদের জোট ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে ২০০৩ সালে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলোয় তা আস্তে আস্তে বিস্তারিত হয়েছে পাকিস্তানেরও এক অংশে, প্রতিনিয়ত চলা এই সংঘাতকে ‘তৃতীয় যুদ্ধ’ বলে গণমাধ্যমে বর্ণনা করা না হলেও তাকে অন্য কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
এক দশক ধরে চলা এসব যুদ্ধ কি বিশ্বকে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ করেছে? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদাকে সমূলে বিনাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কি সফল হয়েছে? প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব যুদ্ধ এবং যুদ্ধসংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ থেকে পৃথিবী ও যুক্তরাষ্ট্র কি শিক্ষা নিয়েছে? ১১ সেপ্টেম্বরে দশম বর্ষপূর্তিতে এসব প্রশ্নই সবার সামনে উপস্থিত। এসব প্রশ্নের বিশদ ও বিস্তারিত উত্তর নিয়ে গবেষণা এবং বিতর্ক চলছে দশ বছর ধরেই। কিন্তু ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এসব প্রশ্নকে আরও বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে একধরনের আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র—তার মিত্র দেশগুলো, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ৩১ হাজার ৭০০ জনের বেশি সেনা ও নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু মোট প্রাণহানির মাত্র সামান্য অংশকেই তুলে ধরে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর ৭০ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাবমতে, আফগানিস্তান ও ইরাকে এক লাখ ৩৭ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের নেওয়া ‘কস্ট অব ওয়ার’ (যুদ্ধের ব্যয়) প্রকল্পের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, আহত ও নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা যোগ করলে তা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রায় ৭৮ লাখ মানুষ এই তিনটি দেশে শরণার্থী হয়ে পড়েছে, তাদের নিজ দেশে বা দেশের বাইরে।
আর্থিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই এই যুদ্ধ এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই প্রকল্পের হিসাব এবং তা সর্বশেষ হালনাগাদ করে অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ বলেছেন, তা পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যুদ্ধাহত সেনাদের চিকি ৎ সা ও অন্যান্য ভাতা বাবদই খরচ হবে প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে ইরাকের বিধ্বস্ত হওয়া অবকাঠামো, আফগানিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি কিংবা পাকিস্তানের অব্যাহত সামরিক ব্যয়ের কিছুই ধরা হয়নি। এসবকে একত্র করলে তা আরও কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার যে হবে, তা অনুমান করা যায়।
জর্জ বুশের প্রশাসন ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ যে নাড়ি ও কৌশল সূচনা করেছে এবং যার অনেক কিছু ওবামাও অব্যাহত রেখেছেন, তাতে কেবল প্রাণহানি ও অর্থ ব্যয়ই হচ্ছে না, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিক-অধিকার খর্ব হয়েছে অভাবনীয়ভাবে। বিভিন্ন আইনকানুন, প্রক্রিয়া-পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের এমন সব দিক সংকুচিত করা হয়েছে, যা নিয়ে একসময় যুক্তরাষ্ট্র গর্ব করতে পারত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী পদক্ষেপ, যেমন—বন্দীদের ওপর নির্যাতন, রেনডিশন বা আটক ব্যক্তিদের তৃতীয় দেশের হাতে অর্পণের মাধ্যমে নির্যাতনের মুখোমুখি করা। সর্বোপরি রয়েছে বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত গোপন কারাগার বা ব্ল্যাক সাইট। গুয়ানতানামোর বন্দিশালা প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেয় যে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এক দশক ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব আচরণ অন্য দেশগুলোকেও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য, নাগরিক অধিকার খর্ব এবং অত্যাচারে উ ৎ সাহ ও সাহস জুগিয়েছে।
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র একটা সাফল্য দাবি করতে পারে, তা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার সাংগঠনিক ভিত্তিকে তারা কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি কেন্দ্রীভূত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদার অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হয়েছে কিংবা আর কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হবে না। ইতিমধ্যেই আমরা দেখছি, আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আঞ্চলিকভাবে গড়ে উঠেছে এবং তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিতও হচ্ছে। সহিংস রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদের উত্থান হয়েছে অনেক আগে, তাকে নির্মূল করার কল্পনা বা চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদকে যারা কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা, তাদের জনসমর্থনবঞ্চিত করার কাজে সাফল্য অর্জন করা গেলেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমন করা যাবে।
প্রভাব ও গুরুত্বের বিবেচনায় ২০১১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর কেবল একটি মর্মান্তিক ঘটনার দশক পূর্তি নয়, বরং গত এক দশকের নীতি ও কৌশলগুলোর ব্যাপারে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার সময়। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম, সাধারণ জনগণ ও বিশ্লেষকদের মধ্যেই তার তাগিদ স্পষ্ট—নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছাবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
ইলিনয়, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার প্রভাব যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই সীমিত থেকেছে তা নয়, এই সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা যেমন হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, হামলায় নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় যেমন আছে প্রায় ৫৫টি দেশের মানুষ, তেমনি তার প্রভাবও পড়েছে সারা পৃথিবীতে। বিশ্বব্যাপী এই প্রভাবের পেছনে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় নয়, কাজ করেছে হামলা-পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ হামলার প্রণেতা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সন্ত্রাসী হামলার প্রত্যুত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপ জন্ম দিয়েছে তিনটি যুদ্ধের। আল-কায়েদার ত ৎ কালীন ঘাঁটি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের হামলার মধ্য দিয়ে এসব যুদ্ধের সূচনা। ১১ সেপ্টেম্বরকে অভ্যুত্থান হিসেবে দাঁড় করিয়ে জর্জ বুশের নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার মিত্রদের জোট ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে ২০০৩ সালে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলোয় তা আস্তে আস্তে বিস্তারিত হয়েছে পাকিস্তানেরও এক অংশে, প্রতিনিয়ত চলা এই সংঘাতকে ‘তৃতীয় যুদ্ধ’ বলে গণমাধ্যমে বর্ণনা করা না হলেও তাকে অন্য কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
এক দশক ধরে চলা এসব যুদ্ধ কি বিশ্বকে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপদ করেছে? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদাকে সমূলে বিনাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কি সফল হয়েছে? প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব যুদ্ধ এবং যুদ্ধসংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ থেকে পৃথিবী ও যুক্তরাষ্ট্র কি শিক্ষা নিয়েছে? ১১ সেপ্টেম্বরে দশম বর্ষপূর্তিতে এসব প্রশ্নই সবার সামনে উপস্থিত। এসব প্রশ্নের বিশদ ও বিস্তারিত উত্তর নিয়ে গবেষণা এবং বিতর্ক চলছে দশ বছর ধরেই। কিন্তু ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এসব প্রশ্নকে আরও বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে একধরনের আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র—তার মিত্র দেশগুলো, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ৩১ হাজার ৭০০ জনের বেশি সেনা ও নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু মোট প্রাণহানির মাত্র সামান্য অংশকেই তুলে ধরে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোর ৭০ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাবমতে, আফগানিস্তান ও ইরাকে এক লাখ ৩৭ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের নেওয়া ‘কস্ট অব ওয়ার’ (যুদ্ধের ব্যয়) প্রকল্পের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, আহত ও নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা যোগ করলে তা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রায় ৭৮ লাখ মানুষ এই তিনটি দেশে শরণার্থী হয়ে পড়েছে, তাদের নিজ দেশে বা দেশের বাইরে।
আর্থিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই এই যুদ্ধ এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই প্রকল্পের হিসাব এবং তা সর্বশেষ হালনাগাদ করে অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ বলেছেন, তা পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যুদ্ধাহত সেনাদের চিকি ৎ সা ও অন্যান্য ভাতা বাবদই খরচ হবে প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে ইরাকের বিধ্বস্ত হওয়া অবকাঠামো, আফগানিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি কিংবা পাকিস্তানের অব্যাহত সামরিক ব্যয়ের কিছুই ধরা হয়নি। এসবকে একত্র করলে তা আরও কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার যে হবে, তা অনুমান করা যায়।
জর্জ বুশের প্রশাসন ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ যে নাড়ি ও কৌশল সূচনা করেছে এবং যার অনেক কিছু ওবামাও অব্যাহত রেখেছেন, তাতে কেবল প্রাণহানি ও অর্থ ব্যয়ই হচ্ছে না, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নাগরিক-অধিকার খর্ব হয়েছে অভাবনীয়ভাবে। বিভিন্ন আইনকানুন, প্রক্রিয়া-পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের এমন সব দিক সংকুচিত করা হয়েছে, যা নিয়ে একসময় যুক্তরাষ্ট্র গর্ব করতে পারত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী পদক্ষেপ, যেমন—বন্দীদের ওপর নির্যাতন, রেনডিশন বা আটক ব্যক্তিদের তৃতীয় দেশের হাতে অর্পণের মাধ্যমে নির্যাতনের মুখোমুখি করা। সর্বোপরি রয়েছে বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালিত গোপন কারাগার বা ব্ল্যাক সাইট। গুয়ানতানামোর বন্দিশালা প্রতিদিন স্মরণ করিয়ে দেয় যে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এক দশক ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব আচরণ অন্য দেশগুলোকেও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য, নাগরিক অধিকার খর্ব এবং অত্যাচারে উ ৎ সাহ ও সাহস জুগিয়েছে।
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র একটা সাফল্য দাবি করতে পারে, তা হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার সাংগঠনিক ভিত্তিকে তারা কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি কেন্দ্রীভূত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদার অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদ পরাজিত হয়েছে কিংবা আর কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হবে না। ইতিমধ্যেই আমরা দেখছি, আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আঞ্চলিকভাবে গড়ে উঠেছে এবং তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিতও হচ্ছে। সহিংস রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সন্ত্রাসবাদের উত্থান হয়েছে অনেক আগে, তাকে নির্মূল করার কল্পনা বা চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদকে যারা কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা, তাদের জনসমর্থনবঞ্চিত করার কাজে সাফল্য অর্জন করা গেলেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দমন করা যাবে।
প্রভাব ও গুরুত্বের বিবেচনায় ২০১১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর কেবল একটি মর্মান্তিক ঘটনার দশক পূর্তি নয়, বরং গত এক দশকের নীতি ও কৌশলগুলোর ব্যাপারে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়ার সময়। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম, সাধারণ জনগণ ও বিশ্লেষকদের মধ্যেই তার তাগিদ স্পষ্ট—নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছাবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
ইলিনয়, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments